বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতায় ভেঙ্গে গেছে যশোরের বোরো চাষীদের স্বপ্ন

  04-05-2017 09:53PM

পিএনএস, যশোর প্রতিনিধি : যশোরে ধান কাটার শুরুতে কৃষকের চোখে-মুখে ছিল আনন্দের ঝিলিক। ক্ষেতের সোনালি ধান উঠবে ঘরে। পানি ও সার দোকানীর পাওনা। সমিতির লোন। ধান বিক্রির টাকায় শোধ হবে মহাজনের দেনা। সংসারে আসবে স্বচ্ছলতা। কয়েক দিনের বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতায় সৃষ্টি হওয়ায় কৃষকের সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে। পানিতে তলিয়ে গেছে এড়েলের বিলের ৩৬০ মৌজার ও ৩৬৫ গ্রামের ৩০ হাজার বিঘা জমির পাকা ধান।

যশোর সদর উপজেলারদোগাছিয়া,ইসলামপুর,নলডাঙ্গা,শ্যামনগর,ঝাউদিয়া,আব্দুল্লাপুর, সাজিয়ালী, চান্দুটিয়া,আরিজপুর, মালিগাতি, সরিষাগাতিসহ ৩৬৫টি গ্রামের হাজার হাজার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক পরিবারে এখন শুধুই হাহাকার। চোখে-মুখে শুধু হতশা। আর এ জলাবদ্ধতার জন্য দায়ী খাল নব্যতা না থকা ও দখল । কৃষকরা খাল খননের দাবি জানান।

যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, যশোর অঞ্চলে এবার ৩ লাখ ৫৫ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। এ মধ্যে যশোর জেলার আট উপজেলায় আবাদ হয়েছে ১ লাখ ৫১ হাজার ৮০৫ হেক্টর জমিতে। আর উপাদনের লক্ষ্যমাত্র ধরা হয়েছে ৬ লাখ ১১ হাজার ৮২১ মেট্রিক টন। বৃষ্টি ও ঝড়ে আক্রান্ত হয়েছে ৩২ হাজার ৬৪০ হেক্টর জমি। গত আমন মৌসুমে জলাবদ্ধতার অধিকাংশ আমন ধানের জমি তলিয়ে যাওয়ায় কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। বোরো আবাদ করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার লক্ষ্য ছিল কৃষকের। কিন্তু শেষ সময়ে বৈরী আবহাওয়ায় কৃষকের স্বপ্ন শেষ।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বিস্তীর্ণ এ বিলে সোনলী ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিতে ভাসছে কাটা ধান। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক ক্ষতি খানিকটা পুষিয়ে নিতে প্রাণান্ত চেষ্টায় চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা পানির মধ্যে কাঁচি চালাচ্ছেন। তবে তীব্র শ্রমিক সংকটের কারণে বহু কৃষকের ধান পচে নষ্ট হচ্ছে পানিতেই। আর মাঠের রাস্তা কাদা থাকায় তারা ধান বাড়িতে আনতে পারছে না। মাঠের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে দেখা যায় রাস্তা ও খালের দুই ধারে লম্বা ধানের সারি। এ ধানে গাছ গজিয়ে গেছে। ধান দিয়ে পাচা দূর্গন্ধ বের হচ্ছে।

বিলের ভিতর প্রায় তিন কিলোমিটার গিয়ে খইতলা কালভার্টের কাছে গিয়ে দেখি ১৫ থেকে ২০ জন কৃষক-কৃষাণী বসে আছে। বসে দেখছে তাদের সোনালী স্বপ্নের মৃত্যুর করুন দৃশ্য। তারা জানান, সব শেষ। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। ধার-দেনা করে আবাদ করেছিলাম। পাওনাদাররা প্রতিদিন আসছে বাড়িতে। পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এনজিও কিস্তি দিতে পারছি না।

দেখা গেছে, পানির নিচে তলিয়ে রয়েছে হাজার হাজার বিঘা জমির ধান। পাকা ধান কলিয়ে গেছে। পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে কেউ ধান কাটছেন। আবার কেউ কেউ কলারভ্যায় করে ধান পানিতে ভাসিয়ে টেনে তুলছেন উপরে। এ কাজে যে শুধু পুরুষেরাই নিয়োজিত রয়েছেন তা নয়। ধান রক্ষা করতে নারীরাও যোগ দিয়েছেন।

ইসলামপুর গ্রামের কৃষক আবু সাঈদ (বর্গচাষি) জানান তিনি এ বার ১৬ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। জমিতে প্রায় ৩৫০ মণ ধান হতো। যার দাম তিন লাখ ত্রিশ হাজার টাকা। সব ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। বাড়িতে এক ছাটাক ধান তুলতে পারিনি।

তিনি জানান, ১৬ বিঘা ধান করতে পানি, সারসহ মোট খরচ হয়েছে দেড় লাখ টাকা। তিনটি দোকান থেকে সার নিয়েছি। সে খানে এক লাখ টাকা ও পানি খরচ বাকি ৪৮ হাজার। এ ছাড়া আড়ৎ মালিক খলিল ও সেলিম পাবে প্রায় ১০ হাজার টাকা। আর জমির মালিক চুড়ামনকাটি দাদু, সেলিম ও শাহ আলমকে দিতে হবে বিঘা প্রতি ৫ মণ হিসাবে ৮০ মণ ধান। এ কথা বলার সময় তার দু,চাখের দিয়ে অঝরে পানি ঝরতে থাকে। নিঃস্ব হয়ে গেছি। সব স্বপ্ন পানিতে তলিয়ে গেছে। ইসলামপুর গ্রামের হেলাল সরদার বলেন, বিলে এখন কোমর পানি। ছয় বিঘা জমির ধান পানিতে ভাসছে।

একই গ্রামের গাজী আলমগীর সিদ্দিকীর এক বিঘা, খলিল হোসেনের তিন বিঘা, নুর ইসলামের তিন বিঘা, মোহম্মদ আলীর চার বিঘা,আনোয়ার হোসেনের পাঁচ বিঘা, বাবুর আলীর দুই বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে। এমন আবস্থা নাম না জানা বিলের হাজার কৃষকের।

দোগাছিয়া গ্রামের আব্দুল সাত্তার বলেন, মাঠে ১২ বিঘা জমির কাটা ধান পানিতে ভাসছে। ব্যাংক থেকে ৫০ হাজার টাকা লোন নিয়ে আবাদ করেছি। ধান মাড়াই করে তা পরিশোধ করতে চেয়ে ছিলাম। কিন্তু পানিতে স্বপ্ন শেষ। কৃষক ইসলাম দফাদার, রোস্তম আলী, আমজাদ হোসেন, আব্দুল হামিদ বলেন, এখন আর মাঠে যেয়ে লাভ নেই। ধান পানিতে ভাসছে। তারা বলেন, এই এলাকার কৃষকের প্রধান ফসল ধান। যুগযুগ ধরে এই মাঠের কামাই আমরা খেয়ে বেঁচে আছি। এলাকার সিংগহভাগ খাদ্যার ঘাটতি পুরণ করে থাকি এই বিল থেকে। কিন্ত এই মাঠের ধান পানির নিচে তলিয়ে আছে। এবার আমাদের কি হবে।

কৃষক ইসমাইল হোসেন বলেন, ধানে কাঁচি লাগাতে পারেননি। কত বিঘা জমির ধান তলিয়ে গেছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এড়েলের বিলে ৩৬৫ গ্রামের কৃষকের জমি আছে। এ বিলে ১২০টির মত ডিপ বা পাম্প রয়েছে। প্রতিটি পাম্পে গড়ে ২৫০ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। তাদের হিসাব মতে ৩০ হাজার বিঘা জমির সব ধান পানির নিচেয়। ইসলামপুর গ্রামের মোহম্মদ আলী বলেন, গোবিন্দপুর ও ঝাউদিয়া গ্রামে খাল ভরাট হওয়ায় তা দখল করে ধান চাষ করছে অনেকেই। এছাড়া দেখা গেছে অনেক স্থানে পাটা দিয়ে মাছ শিকার করা হচ্ছে। যা পানির গতি পথে বাধার সৃষ্টি করছে। এ সব কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

ইসলামপুর গ্রামের শতাবর্ষীয় নেওয়াবালি বলেন, আগে এ বিলে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হত না।এখন খালে নব্যতা না থাকায় গত কয়েক দিনের বৃষ্টির পানি জমে পাকা ধান তলিয়ে গেছে। তিনি বলেন, জগহাটি থেকে ঝাউদিয়া (তেঁতুলতলা) পর্যন্ত খাল খনন করা হলে এ সমস্যা হতো না।

কৃষক আনোয়ার হোসেন, রোস্তম আলী, আব্দুল হামিদ বলেন, এড়েলের বিলের একাধিক খাল রয়েছে। বড় খালটি বুকভরা বাওয়াড়ের সাথে যুক্ত হয়েছে। খালটি ভরাট হয়ে গেছে । তার কারনে এ জলাবদ্ধতার সৃষ্টি। খালটি খনন করার দাবি জানান তারা।

এনজিও কর্মী রানা জানান, দোগাছিয়া ও সাজিয়ালী গ্রামে সমিতি আর আর এফ এর তিন ইউনিট বা কেন্দ্র রয়েছে। তিন কেন্দ্রের সদস্য প্রায় এক শত। সদস্যরা সমিতি থেকে এক কালীন কৃষি লোন নিয়েছে। নেওয়ার ছয় মাস পর কিস্তি দিতে হয়। ধান কাটার পর তাদের কিস্তি দিতে হবে। শুধু আর আর এফ নয় এমন এনজিও আছে আরও অনেক।

কৃষক রোস্তম আলী বলেন, গ্রামীন ব্যাংক থেকে ১৫ হাজার টাকা নিয়েছি। ধান কাটা হলেই শোধ করতে হবে। কিন্তু ধান এখন পানিতে ভাসছে। খাবারই ঘরে উঠছে না। সমিতির টাকা কি ভাবে শোধ করবো ভেবে পারছি না।

দোগাছিয়া বাজারের সার দোকানের কর্মচারি সিরাজুল ইসলাম বলেন, এ এলাকার কৃষকরা মৌসুমী বাকি নেই। মৌসুমী বাকি বলতে তিনি বলেন, ধান রোপণ থেকে পাকা পর্যন্ত একটা মৌসুম। এ দোকানে ৩০০ জন কৃষক কেনাকাটা করে। তাদের কাছে এ মৌসুমে বাকি প্রায় ৩০ লাখ টাকা। ধান উঠলে মালিক হালখাতা করবে। কিন্তু মাঠের যে আবস্থা তাতে এ বার টাকা উঠবে কি না তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। এ দিকে কালবৈশাখীর ছোবলে চৌগাছা, মনিরামপুরে বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

বাঘারপাড়ার জলেশ্বর ও ধলধলিয়া বিলের চাষিদের স্বপ্ন ভেসে গেছে ভারি বৃষ্টিতে। বিস্তীর্ণ ওই দুই বিলের ধান এখন পানির নিচে। শ্রমিক সংকটের কারণে বহু কৃষকের ধান পচে নষ্ট হচ্ছে পানিতেই। এ বিলে ৯০ ভাগ ধানই তলিয়ে যায় সাম্প্রতিক বৃষ্টিতে।

এ ব্যাপরে যশোর আঞ্চলিক কৃষি অফিসের অতিরিক্ত পরিচালক কৃষিবিদ চন্ডী দাস কুন্ডু ঝড়-বৃষ্টি এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে কি করা। কৃষকদের আগাম ধান কাটার পরামর্শা দেয়া হচ্ছে। এতে উৎপাদনে প্রভাব পড়তেও পারে। তবে তার পরিমান নিদিষ্ট করে এখনই বলা সম্ভব নয়।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন