ডিমওয়ালা ইলিশ নিধন; উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা

  21-09-2016 04:33PM

পিএনএস ডেস্ক : সাগর উপকূলে ১৫ দিন ধরে ডিমওয়ালা ইলিশ ধরা পড়ায় আসন্ন মূল প্রজনন মওসুমে জাতীয় এ মাছের উৎপাদন ব্যাহত করতে পারে। কয়েক মাসের খরা কাটিয়ে ভাদ্রের মধ্য-ভাগ থেকেই বঙ্গোপসাগরে সংযুক্ত বিভিন্ন নদ-নদীর মোহনা এবং অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ছে। বিগত শীত মওসুমের পর লাগাতর দুঃসহ তাপপ্রবাহ আর খরার পরে মওসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি বৃষ্টিপাত ইলিশ প্রজনন ও এর উৎপাদনে যথেষ্ট সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছেন মৎস্য বিজ্ঞানীগণ। কিন্তু ডিমওয়ালা ইলিশের আগাম বিচরণ ও আহরণ আসন্ন মূল প্রজনন মওসুমের সময়টিতে যথেষ্ট বিরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন মৎস্য বিজ্ঞানীগণ।

অভিপ্রায়নী মাছ ইলিশ সারা বছর ধরেই ডিম ছাড়লেও আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে পরেই সর্বাধিক প্রজনন করে থাকে। আর ভাদ্র ও আশ্বিনেই উপকূলভাগসহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে সবচেয়ে বেশি ইলিশ পরিভ্রমণকালে ধরা পড়ে। আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগের তিন দিন ও পরের ১১ দিনকে মৎস্য বিজ্ঞানীগণ ইলিশের প্রধান প্রজননকাল মনে করে থাকেন। এর পরবর্তী পূর্ণিমার অনুরূপ সময়কালকেও মৎস্য বিজ্ঞানীগণ ইলিশের দ্বিতীয় সর্বাধিক প্রজননকাল বলে চিহ্নিত করেছেন।

সে হিসেবে আগামী ১৩ অক্টোবর থেকে ১৫ দিন উপকূলের ৭ হাজারর বর্গকিলোমিটার এলাকায় ইলিশসহ সব ধরনের মাছ আহরণ নিষিদ্ধ থাকবে। এসময় সারা দেশে ইলিশের পরিবহন ও বিপণনও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হবে। এ লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সহায়তায় সব ধরনের প্রস্তুতিও গ্রহণ করতে শুরু করেছে মৎস্য অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।
কিন্তু চলতি বছর আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে ভাগেই প্রচুর প্রজননক্ষম ইলিশ দেশের উপকূলীয় নদ-নদী মোহনা এবং অভ্যন্তরীণ নদীগুলোতে উঠে আসায় গত দিন পনের ধরে তা ধরাও পড়ছে। অনেকটা আকস্মিকভাবে বিপুল ইলিশ পেয়ে জেলেরা যথেষ্ট খুশি। তবে জেলেদের চেয়েও বেশি খুশি বিভিন্ন মোকামের দাদনদারগণ। সারা বছর এরা জেলেদের আগাম অর্থ দিয়ে আহরিত মাছ তাদের নিজেদের নির্ধারিত দরেই কিনে নেয়। এত দিন জালে মাছ কম ধরা পড়ায় জেলেরা ঋণমুক্ত হতে পারেননি। দাদনদারদের কপালে ছিল দুশ্চিন্তার ভাঁজ। কিন্তু অনেকটা আকস্মিকভাবেই সাগর থেকে প্রচুর ইলিশ উপকূলভাগ হয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ নদ-নদীতে উঠে আসায় তাদের দুশ্চিন্তা লাঘব হতেও শুরু করেছে।

কিন্তু প্রচুর ইলিশ ধরা পড়লেও বাজারে এর খুব একটা প্রভাব লক্ষ করা যায়নি। এখনো বরিশালের ইলিশের পাইকারি মোকামে এক কেজি সাইজের প্রতি মণ ইলিশ ৩৯-৪০ হাজার টাকা। কেজির ওপরের সাইজের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫৫ হাজার টাকার ওপরে। এলসি ৬০০ গ্রাম থেকে ৯৫০ গ্রাম ওজনের প্রতি মণ ইলিশ গতকাল বিক্রি হয়েছে ২৫ হাজার ২০০ টাকা, সে হিসেবে ওই সাইজের এক কেজি ইলিশের দাম পড়ে ৬০০ টাকা। ভ্যালকা ৪০০ গ্রাম থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশের মণ বিক্রি হয়েছে ১৮ হাজার ২০০ টাকা। বোটলা বিক্রি হয়েছে ১৪ হাজার ২০০ টাকা। আর কথিত নজরদারির পরও বাজারে যে জাটকা আসছে তার পাইকারি দর প্রতি মণ ৮-১০ হাজার টাকা। ফলে খুচরা বাজারেও মধ্যম সাইজের ইলিশ এখনো প্রতি কেজি ৮ শ’ টাকার নিচে নয়। কেজি সাইজের একটি ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৯ শ’ থেকে হাজার টাকার কাছাকাছি। তবে প্রচুর ইলিশ পড়লেও বাজারে দাম তেমন একটা কমেনি বলে ক্রেতারা জানান। অপর দিকে সাগর থেকে ধরা ইলিশের দাম স্থানীয় নদ-নদী থেকে ধরা ইলিশের দাম মণপ্রতি ৬-৭ হাজার টাকা কম।

তবে দাম যাই হোক, মূল প্রজনন মওসুমের সামান্য আগে সাগর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ উঠে আসা এবং তা উপকূলীয় ও অভ্যন্তরীণ নদ-নদী মোহনায় ধরা পড়ার ঘটনাকে খুব ভালো বলে মনে করছেন না মৎস্য গবেষকগণ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক মৎস্যবিজ্ঞানী ‘আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার মূল প্রজনন সময়ের আগে বিপুল ইলিশ আহরণের এ ঘটনাকে আগামীতে দেশের বৃহৎ এ মৎস্য প্রজাতির উৎপাদন ব্যাহত করতে পারে’ বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, বাজারে গত দিন পনেরো ধরে যে ইলিশ আসছে তার ৯০ ভাগই ডিমওয়ালা। আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগে-পরে এসব প্রজননক্ষম ইলিশ ডিম ছাড়ার কথা। কিন্তু আগাম বিচরণের ফলে তা জেলেদের জালে ধরা পড়ছে। ফলে মূল প্রজনন সময়টিতে এবার ইলিশের প্রজনন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকগণ।

তবে এর বিকল্পও এ মুহূর্তে কারো কাছে নেই। কারণ আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার আগের তিন দিন ও পরের ১১ দিনসহ মোট ১৫ দিন ইলিশ আহরণ, পরিবহন ও বিপণন বন্ধ রাখা হয় দেশের বৃহৎ একক প্রজাতির এ মাছের প্রজননকে নিরাপদ ও নির্বিঘ্নে রাখার লক্ষ্যে। তাই বিপুল ইলিশ ধরা পড়লেও এ মুহূর্তে কিছু করণীয় না থাকায় ভবিষ্যতে বিষয়টি নিয়ে ভেবে দেখার তাগিদ দিয়েছেন মৎস্য বিজ্ঞানীরা।

গত অর্থবছর দেশে ইলিশের আহরণ ছিল ৩ লাখ ৯০ হাজার টনের কাছাকাছি, যার বাজারমূল্য প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার মতো। আমাদের জিডিপিতে ইলিশের একক অবদান ১ শতাংশের মতো। আর গোটা মৎস্য সেক্টরে এ মাছের অবদান ১২ থেকে ১৩ শতাংশ। মৎস্য অধিদফতরের মতে, দেশের ৪০টি জেলার ১৪৫টি উপজেলার দেড় হাজার ইউনিয়নের প্রায় সাড়ে ৪ লাখ জেলে ইলিশ আহরণের সাথে জড়িত। এর ৩২ শতাংশ সার্বণিক ও ৬৮ শতাংশ খণ্ডকালীন ইলিশ আহরণে সম্পৃক্ত বলে মৎস্য অধিদফতর জানিয়েছে। এ ছাড়াও ইলিশ বিপণন, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, জাল ও নৌকা তৈরিসহ মেরামতকাজেও আরো প্রায় ২০-২৫ লাখ মানুষ কাজ করছেন। এর মধ্যে শুধু বরিশাল বিভাগেরই প্রায় দেড় লাখ জেলে এ পেশার সাথে জড়িত বলে মৎস্য অধিদফতর জানিয়েছে। এদের ৬৫ শতাংশ সার্বণিকভাবে ইলিশ আহরণে জড়িত।

পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন