গুলশান-বনানী-বারিধারা: আবাসিক প্লটকে বাণিজ্যিক বৈধতা দিচ্ছে রাজউক!

  06-11-2016 08:29AM


পিএনএস ডেস্ক: হলি আর্টিজান হামলার পর নিরাপত্তা ইস্যুতে রাজধানীর অভিজাত গুলশান, বনানী ও বারিধারার আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক স্থাপনা অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এর অংশ হিসেবে প্রায় ১৩ হাজার বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদের নোটিসও দেয় সংস্থাটি। যদিও সে সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে রাজউক। আয় বাড়াতে নির্ধারিত ফির বিনিময়ে ভূমি ব্যবহারের শ্রেণী পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে তারা। রাজউকের সর্বশেষ বৈঠকে কাঠাপ্রতি ৫০ লাখ টাকার বিনিময়ে এসব প্লট বাণিজ্যিক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

যদিও রাজউক চাইলেই ফির বিনিময়ে ইচ্ছামতো ভূমির শ্রেণী পরিবর্তন করতে পারে না বলে মনে করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলছেন, একটি শহর গড়ে ওঠার সময় তার প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন বিষয় বিন্যস্ত করা হয়। এ ধরনের শ্রেণী পরিবর্তনের আগে গণশুনানির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট এলাকায় বসবাসরতদের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন। তাছাড়া এর সঙ্গে কূটনৈতিক পাড়ার নিরাপত্তার বিষয়টিও জড়িত।

গত ১ জুলাই গুলশানে জঙ্গি হামলার পর নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিদেশী কূটনীতিকরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে কূটনৈতিক পাড়ায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। তল্লাশি বাড়ানো হয় গুলশান, বনানী ও বারিধারার প্রবেশমুখগুলোয়। পুলিশের নিরাপত্তাচৌকির পাশাপাশি দেয়া হয় কাঁটাতারের ব্যারিকেড। যানবাহনও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এ এলাকার জন্য নামানো হয়েছে আলাদা বাস ও রিকশা। অস্থায়ী দোকানপাট তুলে দেয়া হয়েছে, উচ্ছেদ করা হয়েছে হকার। গুরুত্বপূর্ণ ৩০০ পয়েন্টে বসানো হয়েছে ৬৫০টি সিসি ক্যামেরা। রাজউকও আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে।

যদিও গুলশান, বনানী ও বারিধারার মতো আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন রয়েছে বলে এখন দাবি করছে রাজউক। যুক্তি হিসেবে তারা বলছে, কোনো ধরনের অনুমোদন ছাড়াই এত দিন এসব এলাকার আবাসিক প্লট বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছিল। এগুলোর বৈধতা দিলে রাজউকের রাজস্ব বাড়বে।

যোগাযোগ করা হলে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন ও পরিকল্পনা) আবদুর রহমান বলেন, বেশকিছু সড়কে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে বৈধতা দিতে চাই আমরা। বোর্ডের সর্বশেষ বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। আমরা সুপারিশ করে মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। মন্ত্রণালয়ই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

২০০৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, গুলশান শুটিং ক্লাব থেকে গুলশান ২ নম্বর চত্বর পর্যন্ত; বনানীর কামাল আতাতুর্ক এভিনিউ, গুলশান-বনানী সংযোগ ব্রিজ থেকে গুলশান-বারিধারা ব্রিজ পর্যন্ত এবং গুলশান-মহাখালী ব্রিজ থেকে বাড্ডা লিংক রোড (গুলশান দক্ষিণ এভিনিউ) পর্যন্ত উভয় পাশের প্লট বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহারে রাজউকের অনুমোদন রয়েছে। এছাড়া বনানী ১১ নম্বর সড়কের উভয় পাশের প্লটগুলো বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমোদন রয়েছে। তবে এগুলোর বাইরে গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকায় বিভিন্ন সড়কে বিপুল সংখ্যক আবাসিক প্লট রাজউকের অনুমোদন না নিয়েই বাণিজ্যিক ব্যবহার হচ্ছে। অনুমোদন ছাড়াই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করায় কোনো ফি পাচ্ছে না রাজউক।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজউকের অনুমোদন না নিয়েই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে গুলশান আবাসিক এলাকার ৪১ নম্বর সড়কের (৩৫ নম্বর সড়ক সংযোগস্থল থেকে পশ্চিম প্রান্তে গুলশান বনানী-লিংক রোড ব্রিজের উভয় পাশ পর্যন্ত) তিনটি প্লট। ৯৬, ১০৪ ও ১১৩ নম্বর সড়কের উভয় পাশে ৮৫টি প্লটের মধ্যে ১৮টি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে।

বনানী আবাসিক এলাকার ১৭ নম্বর সড়কে (৪ নম্বর সড়কের সংযোগস্থল থেকে ১২ নম্বর সড়কের সংযোগস্থল পর্যন্ত দক্ষিণ পাশ) প্লট রয়েছে ৩৫টি।

এর মধ্যে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে ২৯টি। ১০ নম্বর সড়কের (কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর সংযোগস্থল থেকে ১১ নম্বর সড়কের সংযোগ পর্যন্ত দুই পাশ) ২১টি প্লটের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে ১৮টি। ১২ নম্বর সড়কের (কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর সংযোগস্থল থেকে ১১ নম্বর সড়কের সংযোগ পর্যন্ত দুই পাশ) ২১টি প্লটের মধ্যে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে ১৭টি। বনানী ২৭ নম্বর সড়কে (কামাল আতাতুর্ক এভিনিউর সংযোগস্থল থেকে বিমানবন্দর সড়কের সংযোগস্থল পর্যন্ত দুই পাশ) প্লট রয়েছে মোট ৫১টি, যার মধ্যে ৩০টি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া বারিধারা আবাসিক এলাকায় ব্লক জেতে (প্রগতি সরণি-সংলগ্ন পূর্ব পাশের প্লট) প্লট রয়েছে ৫২টি। এর মধ্যে ৪৫টিই বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে।

রাজউক বলছে, গুলশান, বনানী ও বারিধারা আবাসিক এলাকার এসব সড়কের অধিকাংশ প্লটই অনুমোদন না নিয়ে বাণিজ্যিক হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ এসব প্লট বাণিজ্যিক হিসেবে ঘোষণা করলে রাজউকের রাজস্ব বাড়বে।

তবে কেবল রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি পরিকল্পনার মূল বিষয় হতে পারে না বলে মনে করেন স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি বলেন, পরিকল্পিত নগরায়ণের স্বার্থে ভূমির যথোপযুক্ত ব্যবহার নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গুলশান, বনানী ও বারিধারা আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম এক ধরনের নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করেছে। এ কারণে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ অভিযানও শুরু করে রাজউক। এখন অর্থের বিনিময়ে আবাসিক প্লট বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের অনুমোদন দেয়া হলে তা হবে স্ববিরোধী। তাই রাজউককে অবশ্যই তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসার ব্যাখ্যা দিতে হবে। পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতিদের সঙ্গে আলোচনা করে যথাযথ সমীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ভূমি ব্যবহারের শ্রেণী ইচ্ছামতো পরিবর্তনের সুযোগ নেই।

গত ১ জুলাই গুলশানের কূটনৈতিক পাড়ায় জঙ্গি হামলার ঘটনায় আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলে বিভিন্ন মহল থেকে মত আসে। ভূমি ব্যবহারের শ্রেণী পরিবর্তন করে গুলশান, বনানী ও বারিধারার আবাসিক প্লট বাণিজ্যিক ব্যবহারের বৈধতা দিলে নিরাপত্তার জন্য তা হুমকি হবে কিনা জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (ডিসি মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, রাজধানীর গুলশান, বনানী ও বারিবাধারার আবাসিক এলাকায় আগে থেকে যেভাবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে, জমির শ্রেণী পরিবর্তনের পরও সেভাবেই তা ব্যবহার হবে। কাগজপত্রে পরিবর্তন হলেও বাস্তবে কার্যক্রম একই থাকছে। এক্ষেত্রে নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য তা কোনো হুমকি হবে না। কারণ প্রত্যেকটি বাড়ি কিংবা মার্কেট বা শপিং মলে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা দিয়ে যাচ্ছে। সূত্র: বণিক বার্তা

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন