এনসিসি ব্যাংকের পরিচালকরাই শেয়ার ব্যবসার নিয়ন্ত্রক

  28-11-2016 09:20AM


পিএনএস ডেস্ক: এনসিসি ব্যাংকের পরিচালকরাই প্রতিষ্ঠানটির সাবসিডিয়ারি কোম্পানি এনসিসিবি সিকিউরিটিজের পরিচালক হন। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) আইন ভঙ্গ করে তাঁরা উভয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হয়ে নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করেন ব্যাংকের শেয়ার ব্যবসা। অভিযোগ রয়েছে, এভাবে শেয়ার ব্যবসার মুনাফা গ্রাহকদের না দিয়ে নিজেরাই পকেটস্থ করছেন তাঁরা। এ ছাড়া ব্যাংক পরিচালকরা যোগসাজশ করে বেনামে নিজেরা শত শত কোটি টাকার ঋণ নিয়েছেন, যার বড় একটি অংশই খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

জানা গেছে, প্রতিবছর ব্যাংকের প্রায় শত কোটি টাকা মুনাফা হলেও সাধারণ গ্রাহকরা এর প্রকৃত লভ্যাংশ পাচ্ছে না। বিএসইসি থেকে একাধিকবার এনসিসি ব্যাংকের পর্ষদকে এনসিসিবি সিকিউরিটিজের পর্ষদ থেকে আলাদা করার নির্দেশ দেওয়ার পর ব্যাংকটি তা করতে বাধ্য হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, শেয়ারবাজারে তফসিলি ব্যাংকের ব্যবসার বিষয়ে ২০১০ সালে নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে ব্যাংকগুলোকে সরাসরি ব্রোকারেজ ব্যবসা ও মার্চেন্ট ব্যাংকিং থেকে বিরত থাকতে বলা হয়। আলাদা সহযোগী প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে এসব ব্যবসা পরিচালনার নির্দেশনাও দেওয়া হয়। ওই নির্দেশনার পর ব্যাংকগুলো নিজেদের প্রতিষ্ঠান থেকে ব্রোকারেজ ব্যবসা আলাদা করে। এনসিসি ব্যাংক কর্তৃপক্ষও নির্দেশনা মেনে পৃথক সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠান করে। কিন্তু এর পরিচালনায় ব্যাংকের পরিচালকরাই বসে যান। বিএসইসির নির্দেশনা অনুযায়ী কোনো সাবসিডিয়ারি কম্পানিতে মূল প্রতিষ্ঠানের পর্ষদ সদস্যদের মধ্য থেকে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত থাকতে পারবেন এবং সম্পূর্ণ আলাদাভাবে পর্ষদ গঠন করতে হবে। কিন্তু এনসিসি ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি ওই কম্পানির সব পর্ষদ সদস্যই ছিলেন মূল প্রতিষ্ঠানের পরিচালক।

বর্তমানে এনসিসিবি সিকিউরিটিজ অ্যান্ড ফিন্যানশিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন ব্যাংকের পরিচালক মো. আমিরুল ইসলাম। তিনি আবার মূল প্রতিষ্ঠানের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান। এর আগে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন আবু মহসিন। যিনি বর্তমানে এনসিসিবি সিকিউরিটিজের পরিচালক এবং ব্যাংকের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ারম্যান। এ ছাড়া এনসিসিবি সিকিউরিটিজ পর্ষদের অন্য সদস্যরা হলেন মো. নূরুন নেওয়াজ, আবদুস সালাম, ইয়াকুব আলী, মো. আবুল বাশার, খায়রুল আলম চাকলাদার, আমজাদ ফেরদৌস চৌধুরী, আবু মহসিন, সোহেলা হোসেইন ও মো. মাঈনউদ্দিন মোনেম। সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী (সিইও) হিসেবে আছেন মিজানুর রহমান।

আগে যখন ব্যাংকগুলো সরাসরি শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারত, তখন বড় ধরনের জালিয়াতি ও শেয়ার কারসাজি হয়েছে বলে খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদের তদন্ত প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়। এরপর ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগে লাগাম টেনে নতুন নির্দেশনা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এনসিসি ব্যাংকের পরিচালকরা ওই নিয়মকেই এখন বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছেন। ব্যাংকের মাধ্যমে না করে এখন নিজেদের সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শেয়ার কারসাজি করছেন। নিজেদের নামে-বেনামে বিনিয়োগ করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন। সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে সাধারণ শেয়ার গ্রাহকদের পর্ষদে ঢুকতে দিচ্ছেন না। সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানে কী পরিমাণ মুনাফা দেখানো হবে তা ব্যাংকের পর্ষদ নির্ধারণ করে দেয়। আর ব্যাংকের অডিট কমিটির চেয়ারম্যান সাবসিডিয়ারি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হওয়ায় হিসাব জালিয়াতি করতে কোনো সমস্যা হয় না। ব্যাংকটির পরিচালকদের এই অনিয়মের বিষয়ে বিএসইসি থেকে বারবার নোটিশ দিলেও তাঁরা কোনো কর্ণপাত করেননি। বরং বিএসইসিতে পর্ষদ সদস্য হিসেবে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। এরপর গত জানুয়ারি মাসে বিএসইসি থেকে এনসিসি ব্যাংককে শোকজ নোটিশ দেওয়া হয়। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, গত বছর এনসিসি ব্যাংকের নিট মুনাফা হয়েছে ৮৩ কোটি টাকা। অথচ সাধারণ শেয়ার গ্রাহকদের ডিভিডেন্ড দিয়েছে মাত্র ১২ শতাংশ। এর আগের বছর প্রায় শত কোটি টাকা মুনাফা হলেও ডিভিডেন্ড দিয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ।

এনসিসিবি সিকিউরিটিজের সিইও মিজানুর রহমানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনিও স্বীকার করেন, পর্ষদ সদস্য সবাই ছিলেন ব্যাংকের। তাঁরাই পুরো বিষয় নিয়ন্ত্রণ করেন। এনসিসিবি সিকিউরিটিজের চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলামকে বারবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানটির পরিচালকরা যোগসাজশ করে শত শত কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করছেন। বেনামে ঋণ নিয়েছেন ব্যাংকটির একাধিক পরিচালক। এসব ঋণের একটি বড় অংশ এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। সাধারণ গ্রাহকদের যে ঋণ দেওয়া হয়েছে সেখানে কোনো খেলাপি ঋণ নেই। কিন্তু পরিচালকদের বেনামে নেওয়া এসব ঋণের বেশির ভাগই খেলাপি। ব্যাংকের ঋণ বিতরণ ও বিভিন্ন কার্যক্রম নিয়ে পরিচালকদের মধ্যে দ্বন্দ্বও চলছে। বর্তমান পর্ষদের মধ্যে একাধিক পরিচালক এসব ঋণে বাধা দেওয়ায় কয়েকটি পর্ষদ সভা বাতিল করতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ এনসিসি ব্যাংকের পরিচালকদের ঋণ জালিয়াতি নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।

জানা গেছে, এনসিসি ব্যাংকের মোট ঋণ বিতরণের পরিমাণ প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ‘লোন এগেইনস্ট ট্রাস্ট রিসিভ’ বা এলটিআর ঋণের নামে বিতরণ করা হয়েছে এক হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকটির কয়েকজন পরিচালকের বেনামে নেওয়া হয়েছে এর একটি বড় অংশ, যা এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের সাবেক এক পরিচালকও এই ঋণ নিয়েছেন, যা আর ফেরত দেননি।

বাংলাদেশ ব্যাংক এই ঋণ সম্পর্কে জানতে কয়েক দফা শোকজ নোটিশ দিয়েছে। এর পরও ঋণের অর্থ আদায় করতে পারেনি ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে উঠে এসেছে, আমদানির বিপরীতে দেওয়া প্রায় ৮০০ কোটি টাকার ঋণ পুরোপুরি জালিয়াতি করে দেওয়া হয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এলটিআর জালিয়াতির সঙ্গে আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের এক পরিচালকও জড়িত রয়েছেন, যিনি চট্টগ্রামের একটি ব্যবসায়ী গ্রুপের মালিক। অভিযোগ পাওয়া গেছে, এনসিসি ব্যাংকের দুই পরিচালক প্রভাব খাটিয়ে চট্টগ্রামের ওই ব্যবসায়ীকে ৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছেন, যা কোনো কাগজপত্র ছাড়াই দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ তদন্ত করে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে।

এ ছাড়া ব্যাংকের টার্ম লোন রয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। এই ঋণের মধ্যেও জালিয়াতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। দুই বছর আগে প্রতিষ্ঠিত একটি কম্পানির বিপরীতে টার্ম লোন হিসেবে ব্যাংকটি প্রায় ১৫০ কোটি টাকা দিয়েছে। কম্পানিটি মর্টগেজ (বন্ধক) হিসেবে যে কাগজপত্র জমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শনের বিষয়টি ভুয়া বলে প্রমাণিত হয়েছে। জালজালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ দেওয়ায় প্রতিষ্ঠানটির খেলাপির পরিমাণও বাড়ছে। ফলে প্রভিশনের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে গত ছয় মাসে। বর্তমানে এনসিসি ব্যাংকের প্রভিশনের পরিমাণই ৮০ কোটি টাকার বেশি।

এনসিসি ব্যাংকের সাবেক এক পরিচালক বলেন, পুরো ব্যাংকে চলছে তুঘলকি কাণ্ড। যার যেমন ইচ্ছা তেমনি করে ব্যাংকের কার্যক্রম চালাচ্ছেন। পরিচালকরাই ভাগবাটোয়ারা করে ঋণ নিচ্ছেন ও দিচ্ছেন। এখানে না আছে কোনো জবাবদিহি, না আছে কোনো সুশাসন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একাধিকবার তদন্ত করা হলেও বাস্তবে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি।

জানতে চাইলে এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম হাফিজ আহমেদ বলেন, ‘এলটিআর ঋণ নিয়ে আমাদের ব্যাংকে কোনো অনিয়ম হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেও কোনো ধরনের অভিযোগ করা হয়নি। আমরা ব্যাংকিং কার্যক্রমে সব ধরনের নিয়ম মেনে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকি।’

চাকরি হারানোর ভয়ে সাড়ে তিন শ কর্মচারী ব্যাংকের পরিচ্ছন্নতাকর্মী, পিয়ন কিংবা চা পরিবেশনের চাকরি খুবই সামান্য। তাও আবার অস্থায়ী। সেই অস্থায়ী ছোট চাকরিও হারানোর ভয়ে আছেন এনসিসির প্রায় সাড়ে তিন শ কর্মচারী। ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের ঊর্ধ্বতন এক কর্তাব্যক্তির নিকটাত্মীয়ের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এসব কাজ ‘আউটসোর্সিং’ পদ্ধতিতে করানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ‘নাজমুল এন্টারপ্রাইজ’ নামের ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ইতিমধ্যে কিছু কিছু কাজ ‘আউটসোর্সিং’-এ দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন অস্থায়ী কর্মচারীদের কয়েকজন। সূত্র: কালের কণ্ঠ

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন