সউদী ব্যবসায়ীদের সেকেন্ড হোম বাংলাদেশ

  30-01-2017 08:46AM


পিএনএস ডেস্ক: সরকারের ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতার কারণে চীন, জাপান, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রের পর বাংলাদেশের বিনিয়োগ বাজারে নতুন প্রতিযোগী হিসেবে যোগ দিয়েছে সউদী আরব। দেশটির শীর্ষ ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সরকারি কর্তাব্যক্তিরা ঘন ঘন আসা-যাওয়া করছেন বিনিয়োগের প্রক্রিয়া করতে। এক প্রকার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে অন্য দেশগুলোর সঙ্গে- কত আগে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে পারে তা নিয়ে। বন্ধুপ্রতিম দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমানে যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন ডলারের সউদী বিনিয়োগ আসার সম্ভাবনার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

স্বাধীনতার পর থেকেই সউদী আরবের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সাহায্যকারী-সাহায্যগ্রহীতার। তবে সেই সম্পর্ক পাল্টে যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতবছরের জুনে রাজকীয় আমন্ত্রণে সউদী সফরের পর। তার সফরের পর বাংলাদেশকে এখন আর সউদী কর্তা ও ব্যবসায়ীরা সাহায্যপ্রার্থী দেশ হিসেবে দেখে না- বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগ হাব। দেশটির কাছে বাংলাদেশ এখন বিনিয়োগের লোভনীয় ও নিরাপদ গন্তব্য।

সউদী আরবের দ্বিতীয় বৃহত্তম কোম্পানি আল রাজি থেকে শুরু করে শীর্ষ ব্যবসায়ী গ্রুপ আল জামিল, আল বাওয়ানি, আল ফানারসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের এখন বিনিয়োগ গন্তব্য বাংলাদেশ। কোম্পানিগুলোর কর্তাব্যক্তিরা নিয়মিত ঢাকা সফর করছেন, স্বাক্ষর করছেন একের পর এক সমঝোতা স্মারক।

সউদী বিনিয়োগ আগ্রহে উৎফুল্ল বাংলাদেশ সরকারও। ইতোমধ্যে দেশটির বিনিয়োগকারীদের জন্য রিয়াদস্থ দূতাবাসের মাধ্যমে দুটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাদ্দের প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। এর একটি চট্টগ্রামের মিরেরসরাইয়ে; অন্যটি গাজীপুরে। কোথায় অর্থনৈতিক অঞ্চল নেবে তা দেশটির কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করলেই স্বাক্ষর হবে সমঝোতা স্মারক।

ইনকিলাবের সঙ্গে ফোনালাপে সউদী আরবে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ বলেন, সউদী উদ্যোক্তারা চট্টগ্রামে একটি সার কারখানা চালু করতে আলোচনা চালাচ্ছেন। এতে প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকায় বিশেষ শিল্প জোন চালু হলে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার সউদী বিনিয়োগ হবে। সরকার এ জন্য প্রায় ২ হাজার একর জমি বরাদ্দের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।

রাষ্ট্রদূত গোলাম মসীহ বলেন, বিগত চল্লিশ বছরেও বাংলাদেশে সউদী আরবের কোনো বিনিয়োগ আসেনি। অথচ বর্তমানে চিত্র পুরো পাল্টে গেছে।

গত জুনে প্রধানমন্ত্রীর সউদী আরব সফরকে শতভাগ সফল ও ঐতিহাসিক উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, সউদী আরবের বেসরকারি খাতের পাশাপাশি দেশটির সরকারও বাংলাদেশের বড় বড় প্রকল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী। কারণ, সউদী সরকারের বিপুল পরিমাণ পেট্রো-ডলার অলস অবস্থায় পশ্চিমা দেশগুলিতে পড়ে আছে এবং তারা লাভজনক খাতে এটি বিনিয়োগ করতে চায়। কোন ধরনের প্রকল্পে সউদী আরব বিনিয়োগে আগ্রহীÑ জানতে চাইলে রাষ্ট্রদূত বলেন, বিদ্যুৎ, সার ও অবকাঠামো খাতে তাদের বেশি আগ্রহ।

সউদী আরবের সবচেয়ে বড় বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আল-রাজি গ্রুপ বাংলাদেশে বেসামরিক বিমান কার্গো খাতে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অত্যন্ত সফল কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে সউদী বিনিয়োগের দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে বলে গোলাম মসীহ উল্লেখ করেন।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পরবর্তিত পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সউদী আরবের যে টানাপড়েন চলছে, সেই প্রেক্ষাপটে দেশটি বিনিয়োগ স্থানান্তরের বিষয়ে ভাবছে। এক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্র বাংলাদেশকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে দেশটি। এছাড়া সউদী আরবের নেতৃত্বে নিরাপত্তা সংক্রান্ত জোটে বাংলাদেশের সমর্থনের কারণেও দেশটির বিনিয়োগে আস্থা যোগাচ্ছে।

দেশটির বেসরকারি খাতের সর্ববৃহৎ প্রতিষ্ঠান আল রাজি গ্রুপের ভাইস প্রেসিডেন্ট গত অক্টোবরে ঢাকা সফর করে গেছেন। ওই সময় গাজীপুরের কালিয়াকৈরে বঙ্গবন্ধু হাইটেক সিটিতে সউদী জিসিসি আইটি ব্লক স্থাপনের জন্য ১০ একর জমি চেয়েছে। এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকও (এমওইউ) সই হয়েছে। বাংলাদেশ ক্যামিকেল ইন্ডাস্ট্রিজ ও ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরিতে যৌথ বিনিয়োগে এমওইউ করেছে।

সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, আল রাজি ও বিসিআইসি যৌথ উদ্যোগে বিদ্যমান ছাতক সিমেন্ট কোম্পানি সংলগ্ন নিজস্ব জায়গায় ৩৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুতকেন্দ্র সহ বার্ষিক ১৫ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন একটি আধুনিক প্রযুক্তির সিমেন্ট কারখানা স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া কর্ণফুলী পেপার মিলস সংলগ্ন কারখানার নিজস্ব জমিতে ৩৬০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বছরে ৩ লাখ টন উৎপাদনক্ষমতার একটি কাগজ উৎপাদন কারখানা স্থাপন করবে।

দেশটির আরেক বৃহৎ শিল্প গ্রুপ আল জামিলের প্রতিনিধিদল গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। তারা নির্মাণ শিল্পে আগ্রহী। আধুনিক প্রযুক্তিতে স্টিল কাঠামোর বাড়ি বানাতে চায় প্রতিষ্ঠানটি। এ নিয়ে স্টিল এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। শিগগিরই সই হবে এমওইউ।

এ ছাড়া গত আগস্টে আল বাওয়ানি গ্রুপের একটি প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করে গেছে। এ সফরকালে তারা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর এবং সেনাকল্যাণ সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। একটি এমওইউ’ও স্বাক্ষর হয়েছে।

এছাড়া গত ১৮ তারিখে অত্যাধুনিক বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও ক্যাবল তৈরির লক্ষ্যে বিএসইসি’র সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষর করেছে সউদী আরবের শীর্ষ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান আল ফানার।

বিনিয়োগ প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে আগামী ফেব্রুয়ারি ও মার্চে সউদী তথ্যমন্ত্রীসহ একাধিক চেম্বার নেতৃবৃন্দ আসছেন বলে জানিয়েছেন শীর্ষ বণিক সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমাদ।

তিনি বলেন, বিনিয়োগের জন্য আগামী ফেব্রুয়ারি-মার্চে বড় কয়েকটি সউদী কোম্পানির শীর্ষ ব্যক্তিরা আসার জন্য যোগাযোগ করছেন। ইতোমধ্যে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সফরের সিডিউল প্রায় ঠিক। আগামী মাসে দেশটির সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী সংগঠন জেদ্দা চেম্বারের প্রতিনিধিদলও আসছে। সউদী উদ্যোক্তারা অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ খাতে বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী বলে জানান তিনি।

এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমে যাওয়াতে সউদী অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করতে চায়। বাংলাদেশের দ্রুতগতির উন্নয়ন তাদের নজর কেড়েছে। তাই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ তাদের প্রথম পছন্দ। বাংলাদেশের ১০টি অগ্রাধিকার খাতে সউদী আরব কমপক্ষে ৫ থেকে ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ করতে আগ্রহী।

সউদী বিনিয়োগ নিয়ে দুই পক্ষের সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রাথমিক আলোচনা চলছে জানিয়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, সউদী উদ্যোক্তাদের জন্য দুটি অর্থনৈতিক অঞ্চল বরাদ্দ করার প্রস্তাবনা তৈরি করে তাদের বিবেচনার জন্য পাঠানো হয়েছে। তারা নিশ্চিত করলেই আমরা উদ্যোগ নেবো অঞ্চল বরাদ্দের।

প্রধানমন্ত্রীর সউদী সফরের সময় বাদশাহ সালমানের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ইয়াসির আল-রমায়ান দেশটির বিশেষায়িত সরকারী বিনিয়োগ তহবিল থেকে বাংলাদেশে বিনিয়োগের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি সম্ভাব্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রের একটি তালিকাও ইতোমধ্যে চেয়েছেন বলে জানা গেছে।

সউদী বিনিয়োগ প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন বলেন, দেশটি পেট্রো-ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চাচ্ছে। তাই উৎপাদনমুখী ও অবকাঠামো খাতে তাদের বিনিয়োগের আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। আর তাদের বিনিয়োগের প্রথম পছন্দের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ।

সউদী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দেয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, সউদী বিনিয়োগকারীরা বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কর অবকাশ সুবিধা, যন্ত্রপাতি আমদানিতে কর রেয়াত, লভ্যাংশ ও পুঁজি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া সহ সব ধরনের সুবিধা পাবে।

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের হিসাবে, সউদী আরব সম্প্রতি দেশের চলমান পাঁচটি প্রকল্পে ২৩ কোটি ৭০ লাখ ডলার ঋণ দিয়েছে। এগুলো হলো: মগবাজার মৌচাক ফ্লাইওভার, শিকলবাহা বিদ্যুৎকেন্দ্র, শীতলক্ষ্যা সেতু, তিস্তা সেতু ও চক্ষু হাসাপাতাল।

সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বিশ্লেষকরা জানিয়েছেন, সউদী ব্যবসায়ীদের জন্য বাংলাদেশ অচিরেই ‘সেকেন্ড হোম’ হচ্ছে যেটা একাধিকবার আনুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন জেদ্দা চেম্বারের ভাইস প্রেসিডেন্ট মাজেন এম. বাটারজি।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন