হুমকির মুখে সম্ভাবনাময় কাঁকড়া শিল্প

  28-04-2017 06:53PM

পিএনএস, পাইকগাছা (খুলনা) প্রতিনিধি : দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চিংড়ির পর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম খাত কাঁকড়া শিল্প। রপ্তানি নীতিমালা উপেক্ষি হচ্ছে কাঁকড়া শিল্পে। বিভিন্ন এক্সপোর্টার্সরা সাপ্লাইয়ারদের মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে হানা দিয়ে মাত্র ৪০ গ্রাম থেকে শুরু করে কাঁকড়া ক্রয় করে বিদেশে পাচার করছে।

এতে করে মারাত্মক বিরুপ প্রভাব পড়েছে কাঁকড়া শিল্পের উপর। বিশেষ করে কাঁকড়া চাষীরা তাদের হ্যাচারীতে অবমুক্তর জন্যও ছোট কাঁকড়া পাচ্ছেন না। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছোট কাঁকড়া শিপমেন্ট করায় আকস্মিক হ্যাচারী থেকে আশঙ্কাজনক ভাবে হ্রাস পেয়েছে বড় কাঁকড়া। গত মৌসুমের এমন সময় মোকাম প্রতি যেখানে ১৫-২০ মেঃটন করে কাঁকড়া আহরণ হত, সেখানে চলতি ভরা মৌসুমে প্রতিদিন ৩ থেকে ৫ মেঃটনও আহরিত হচ্ছে না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ১/২ মাসের মধ্যে হ্যাচারী গুলো কাঁকড়া শূণ্য হয়ে যাবে।

তাদের আশঙ্কা, আন্তর্জাতিক ভাবে কোনো চক্র অবৈধ উপায়ে বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় কাঁকড়া শিল্প ধ্বংস করতে এদেশের মুনাফালোভীদের সাথে হাত মিলিয়ে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে দেশকে কাঁকড়া শূণ্য করতে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। নানাবিধ প্রতিবন্ধকতায় রীতিমত হুমকির মুখে পড়েছে সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি। বাংলাদেশ লাইভ এন্ড চিল্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশন ও তৃণমূলের সংশ্লি¬ষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, ১৯৮৭ সাল থেকে বাংলাদেশ থেকে জীবিত কাঁকড়া ও কুঁচে রপ্তানি শুরু হয়। বর্তমানে ১৪৩টি প্রতিষ্ঠান কার্গো বিমানের মাধ্যমে প্রতিদিন ২৫-৩০ টন জীবিত কাঁকড়া ও কুঁচে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে থাকে। এর আগে বন অধিদপ্তরের বন্য প্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ আইনের আওতায় ১৯৯৮ সালে এ নিয়ে তৈরী হয় একটি প্রাণী রপ্তানি নীতিমালা। যাতে বলা হয়েছে, পূরুষ কাঁকড়া প্রতিটি ২শ’গ্রাম ও স্ত্রী কাঁকড়া কোনো ভাবেই ১শ’৩০গ্রামের নীচে রপ্তানি করা যাবে না।

নীতিমালানুযায়ী শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা সম্প্রতি প্রায় ৩ হাজার কেজির দু’টি কাঁকড়ার চালান আটক করে লাইভ এন্ড চিল্ড এক্সপোর্টার্স এসোসিয়েশনের কাছে হস্তান্তর করে। পরে এসোসিয়েশনের সংশ্লি¬ষ্ট কর্মকর্তারা আটককৃত কাঁকড়া পরীক্ষা করে দেখেন দু’টি চালানের মোট ৫-৬ ভাগ কাঁকড়া প্রতিটি ৫/১০ গ্রাম করে কম আছে। এছাড়া টানা হেঁচড়া ও সময়ক্ষেপণের ফলে মোট কাঁকড়ার প্রায় ৩০ শতাংশ বিমান বন্দরের কার্গোতেই মারা যায়। পরে তা চীনে রপ্তানি করলে দেখা যায়, সেখানে আরো ৩০ শতাংশ কাঁকড়া মারা যায়। ফলে চীন থেকে ফেরৎ পাঠানো হয় পুরো শিপমেন্ট। এব্যাপারে দক্ষিনাঞ্চলের বিশিষ্ঠ কাঁকড়া ব্যবসায়ী ও এক্সপোর্টার্স নয়ন এন্টাপ্রাইজের স্বত্ত্বাধিকারী শেখ আনারুল ইসলাম বলেন, কাঁকড়া সাধারণত উপকূলীয় এলাকা সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও খুলনা অঞ্চলে চাষাবাদ হয়ে থাকে।

প্রতিদিন এসব এলাকা থেকে এক শ্রেণীর অসাধু মুনাফালোভী এক্সপোর্টার্সরা তাদের সাপ্ল¬াইয়ারদের মাধ্যমে সরকারের কাঁকড়া রপ্তানি নীতিমালা উপেক্ষা করে বিপুল পরিমাণ ছোট কাঁকড়া ক্রয় করে সিন্ডিকেটের মাধ্যমে শিপমেন্ট করছে। এসময় তারা আরো বলেন, বর্তমানে কাঁকড়ার গ্রেড গুলোর মধ্যে রয়েছে যথাক্রমে ডাবল এফ-১ ২শ’গ্রাম, সিঙ্গেল এফ-১ ১শ’৮০গ্রাম, কেএসএল-১ ১শ’৮০গ্রাম, এফ-২ ১শ৬০’গ্রাম, এফ-৩ ১শ’৪০গ্রাম, ডাবল এক্সএল-৫শ’গ্রাম, সিঙ্গেল এক্সএল-৪শ’গ্রাম, এল-৩শ’গ্রাম, এম-২শ’৫০গ্রাম, এসএম-২শ’গ্রাম, ডাবল এক্সএল পিডি-৫শ’গ্রাম, এক্সএল পিড-৪শ’গ্রাম, এলপিডি-৩শ’গ্রাম, এমপিডি-২শ’৫০গ্রাম ওজনের কাঁকড়া তারা ক্রয় করে রপ্তানি করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাপ্লাইয়ারদের অনেকে বলেন, বিদেশের বাজারে ২শ’ ও ১শ’৩০ গ্রাম কাঁকড়ার চাহিদার তুলনায় অপেক্ষাকৃত ছোট কাঁকড়ার চাহিদা বেশী। বিশেষ করে বাংলাদেশের কাঁকড়ার বাজার চীন, জাপান, তাইওয়ান কিংবা থাইল্যান্ডে এর চেয়ে কম ওজনের কাঁকড়ার চাহিদাই বেশী।

তবে ওজন সংশ্লিষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় এই সুযোগে আমাদের প্রতিযোগী দেশ ভারত, মিয়ানমার সহ অন্যান্য দেশগুলো বিদেশে অপেক্ষাকৃত ছোট কাঁকড়া রপ্তানি করে সেখানে বাংলাদেশের কাঁকড়ার বাজারগুলো দখল করছে বলেও জানান তারা। শুধু বাজার দখলই নয়, সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশ থেকে আশঙ্কাজনক হারে ভারত সহ পাশ্চাত্য দেশগুলোতে পাচার হয়ে যাচ্ছে নীতিমালার বাইরে ছোট কাঁকড়া।

বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের কাঁকড়া সংশ্লিষ্টদের আশঙ্কা, রপ্তানি নীতিমালার বাইরে অবাধে ছোট কাঁকড়া পাচার অব্যাহত থাকলে অচীরেই বাংলাদেশ কাঁকড়া শূণ্য হয়ে পড়বে। এতে করে সংশ্লিষ্ট খামারী বা হ্যাচারী মালিকরা তদের প্রজেক্টে অবমুক্ত’র কাঁকড়াও খুঁজে পাবেনা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে হ্যাচারী টিকিয়ে রাখতে মালিকদের সাপ্লাইয়ারদের চাইতে বেশী দামে কাঁড়া ক্রয় করতে হচ্ছে। এতে করে পূর্বের চেয়ে কয়েকগুণ বেশী দামে কাঁকড়া কিনতে হচ্ছে তাদের। জানাগেছে, আন্তর্জাতিক বাজারে বর্তমানে ৫০ থেকে ১২০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়ার চাহিদা ভাল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে এক শ্রেণীর অসাধু মুনাফালোভী চক্র সিন্ডিকেটের মাধ্যমে ছোট কাঁকড়া চোরা পথে পাচার ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ম্যানেজ করে শিপমেন্ট করছে।

এ জন্য তারা দেশের কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, খুলনা,পাইকগাছা-কয়রা সহ বিভিন্ন এলাকাকে বেছে নিয়েছে। তারা সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ৫০-১২০ গ্রাম ওজনের কাঁকড়া চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরের মাধ্যমে রপ্তানি ও বিভিন্ন চোরা পথে ভারত সহ বিভিন্ন দেশে পাচার করছে। চিংড়ির থেকে কম সময় ও খরচে ভাল ফলাফল পাওয়ায় গত কয়েক বছরে বহু লোক কাঁকড়া চাষে সম্পৃক্ত হয়েছেন। নতুন করে বহু লোকও আগ্রহী হচ্ছেন কাঁকড়া চাষে। তবে মাঝ পথে নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা ও আশঙ্কায় বাজার হারানোর পাশাপাশি কাঁকড়া চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন অনেকেই। কাঁকড়া আহরণ, চাষী ও ব্যবসা সংশ্লিষ্টরা বলেন, বাংলাদেশে কাঁকড়ার চুড়ান্ত প্রজননকাল মে-জুন মাস। অথচ রপ্তানি নীতিমালায় কাঁকড়ার প্রজননকাল জানুযারি-ফেব্রুয়ারি মাস উল্লেখ করে ঐ সময়ে বনবিভাগ থেকে কাঁকড়া আহরণের উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে।

যার বিরুপ প্রভাবও খাতটির উপর জেঁকে বসেছে। কাঁকড়া রপ্তনিকারকরা জানান, সাধারনত কাঁকড়া উৎপাদন ও রপ্তানির বিষয়টি পরিবেশ অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তবে সুন্দরবন এলাকায় কাঁকড়ার চাষ করলে তা নিয়ন্ত্রণ করে বন বিভাগ। ফলে দ্বৈত শাসনের যাতাকলে পিষ্ঠ হচ্ছে দেশের বর্তমান সময়ের সম্ভাবনাময কাঁকড়া শিল্পটি সর্বশেষ উপকূলীয় লবণ পানির উপকূলীয় জনপদে গত ৩ দশকে কাঁকড়া শিল্পের সাথে নিজেদের ভাগ্য জড়িয়ে অনেকেই যখন সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখছেন ঠিক তখনই নানাবিধ সংকট সম্ভাবনাময় শিল্পটিকে ক্রমাগত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন