পিএনএস ডেস্ক: ২০১২ সালে বরিশালের এক যুবকের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ঝালকাঠির এক যুবতী। কিন্তু তাদের সেই সম্পর্ক মেনে নেয়নি মেয়েটির সম্ভ্রান্ত পরিবার। যশোরের এক অজপাড়াগাঁয়ে গোপনে সংসার পাতে দুজন। এদিকে ওই যুবকের বিরুদ্ধে যুবতীর বাবা মামলা ঠুকে দেন এই অভিযোগে যে, তার অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে অপহরণ করা হয়েছে। মামলায় যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যুবতীকে পাঠানো হয় যশোরের ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। এখানেই শেষ হতে পারত এই যুগলের প্রেমের গল্পটি। কিন্তু হয়নি। যুবতীর বাবা ও শুভাকাক্সক্ষী স্বজনরা চেয়েছিলেন তার সুন্দর ভবিষ্যৎ। অথচ তাদের জেদের কারণেই কুৎসিত অন্ধকার ঘনিয়ে আসে যুবতীর জীবনে।
যুবক যখন হাজতখানায় তখন যুবতীর বাবা তার মেয়েকে শর্ত দেন তিনি যদি ওই যুবককে ছেড়ে দেন, তা হলে যুবককেও ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা হবে। এর অন্যথা হলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে যুবকের বিরুদ্ধে। ফলে জেলেই কাটাতে হবে তার দীর্ঘকাল। ভালবাসার মানুষটিকে রক্ষায় তাকে ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন যুবতী। ফলে মুক্তি মেলে যুবকের। কিন্তু এরপর পরিবারের যে বন্ধন আর ভালবাসা নতুন জীবন দিতে পারত যুবতীকে, তা তিনি পাননি। পরিবার-পরিজনের অবহেলা, পুলিশের অসহযোগিতা আর চাকরিদাতা প্রতিষ্ঠানের নামে নারী পাচারকারী চক্রের খপ্পরে পড়ে ভাসতে ভাসতে শেষ পর্যন্ত অন্ধকার জগতে গিয়ে আশ্রয় হয় তার। সময়ের ব্যবধানে ওই যুবতী হয়ে যান দেহপসারিণী।
এখানেও গল্প শেষ হয়নি। অন্ধকার ফুঁড়ে ঠিকই দেখা দিয়েছে আলো। অবশেষে পুলিশ ও হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড হেলথ ফাউন্ডেশন (এইচআরএইচএফ) নামে একটি মানবাধিকার সংস্থার হস্তক্ষেপে গত ১৫ সেপ্টেম্বর মধ্যরাতে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন কাজলার আমিরের বাড়ির দোতলার একটি ফ্যাটের বন্দিদশা থেকে মুক্ত হন যুবতী। নির্যাতিত যুবতী এরপর গিয়েছিলেন ভোগান্তির জন্য যারা অপরাধী, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। কিন্তু থানাপুলিশ মামলা নেয়নি। পরে আদালতের দারস্থ হন তিনি। গত ২৮ নভেম্বর যাত্রাবাড়ী থানাপুলিশকে যুবতীর এজাহারটি মামলা হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দেন নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল নং-২ আদালত (পিটিশন নম্বর ৩০২)। কিন্তু যারা যুবতীর এই করুণ পরিণতির জন্য দায়ী তারা এলাকায় প্রকাশ্যে ঘুরলেও রয়ে গেছেন আইনি ব্যবস্থার বাইরে। উল্টো মামলা তুলে নিতে নারী পাচারকারী চক্রের ওই সদস্যরা যুবতীকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। এমনই অভিযোগ করেছেন ঘাটে ঘাটে ঘাত-প্রতিঘাতের শিকার ওই যুবতী।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে যুবতী যখন এই প্রতিবেদকের কাছে অভিযোগের বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তখন তার দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল জল। বলছিলেন, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়িতে, আবাসিক হোটেলে তার মতো অর্ধশতাধিক তরুণী-নারী এখনো ওই পাচারকারী চক্রের হাতে জিম্মিদশায় বন্দি। নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন তারা। জরুরি ভিত্তিতে তাদের উদ্ধারের জোর দাবি জানান তিনি। তাকে আইনগত সহায়তা দিচ্ছে এইচআরএইচএফ।
ভুক্তভোগী ওই যুবতী আমাদের সময়কে বলেন, অমতে বিয়ে করায় স্বজনদের অনাদর-অবহেলায় যখন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল জীবন, তখন নিজ পায়ে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সম্ভ্রান্ত পরিবারের সদস্য হয়েও চাকরির সন্ধানে গত ১ আগস্ট একাই চলে আসেন রাজধানীতে। এ শহর তার অচেনা। যাত্রাবাড়ীতে পৌঁছতেই দেয়ালে সাঁটানো একটি পোস্টারে চোখ আটকে যায় তার। পোস্টারটিতে একটি কিনিকের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দৃষ্টিগোচর হলে তাতে উল্লেখ করা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন। ওপাশ থেকে রাকিব নামে একজন চাকরির বিষয়ে কথা বলতে ঢাকার কোর্টকাছারিসংলগ্ন এলাকায় আসতে বলেন তাকে। ওই এলাকায় গেলে হিন্দু দিদি নামে এক নারীর বাসায় যুবতীকে নিয়ে যান রাকিব। সেই শুরু তার অন্ধকারের দিনলিপি। ওই বাসায় দিনের পর দিন আটকে রেখে প্রথম পর্যায়ে নারী পাচারকারী চক্রের সদস্যরা পাশবিক নির্যাতন চালায়। যেন পালাতে না পারে সেজন্য পুরো এক মাস একটি ঘরে বিবস্ত্র করে রাখা হয় তাকে। যৌনকর্মে অস্বীকৃতি জানালে অনেক দিন তাকে থাকতে হয়েছে না খেয়ে। অসুস্থ হলেও রেহাই মেলেনি। একপর্যায়ে অপ্রীতিকর দৃশ্যের ভিডিও ধারণ করে তা ইন্টারনেটে ছাড়ার হুমকি দিয়ে পুরোপুরি জিম্মি করা হয় তাকে। অগত্যা নিয়তিকে মেনে নিয়ে পাচারকারীদের সব দাবি মানতে বাধ্য হন যুবতী।
তিনি বলেন, প্রায় ৩ মাস আগে শারীরিকভাবে গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় তাকে কোর্ট এলাকা থেকে স্থানান্তর করা হয় হীরা নামে এই চক্রের এক সদস্যের দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর ৩২২ নম্বর বাসায়। এই অবস্থাতেও তার ওপর চলে নির্যাতন। পরে এক খদ্দেরের সহানুভূতিতে যাত্রাবাড়ী থানাপুলিশ যুবতীকে উদ্ধার করে। কিন্তু রহস্যজনক কারণে থানাপুলিশ অপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তাকেই গালমন্দ করে ফের তুলে দেয় ওই নারী পাচারকারী চক্রের হাতে। সেখান থেকে হীরা কাজলার আমিরের বাড়িতে এনে আটকে রাখে তাকে। ওই বাসায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর অসুস্থ অবস্থায় ৬ জন মিলে যুবতীকে পাশবিক নির্যাতন চালাতে চাইলে ভয়ে চিৎকার করে ওঠেন তিনি। বিষয়টি এক সময় স্থানীয়দের মাধ্যমে এইচআরএইচএফ-এর কাছে গিয়ে পৌঁছে। সংগঠনটির হস্তক্ষেপে সেদিন মধ্যরাতে ফের যুবতীকে উদ্ধার করে যাত্রাবাড়ী থানাপুলিশ। কিন্তু এবারও পুলিশের সহযোগিতা পাননি তিনি। উল্টো পুলিশি শাসানির মুখে পড়েন। কর্তব্যরত পুলিশকর্তা বলেন, এসব নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে উল্টো মামলা দিয়ে তাকেই জেলে পাঠানো হবে। উপায়ান্তর না পেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হন যুবতী।
অশ্রুসিক্ত এই ভুক্তভোগী বলেন, এই অপরাধ চক্রে রয়েছে নারী-পুরুষের শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট। রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে রয়েছে তাদের নেটওয়ার্ক। নারী পাচার, মাদক ও জুয়াসহ নানা অপরাধে জড়িত এই চক্র। প্রশাসনের অসাধু অনেক কর্মকর্তার সঙ্গে তাদের সুসম্পর্ক থাকায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেও আমলে নেওয়া হয় না। গ্রাম থেকে আসা সহজ-সরল কিশোরী-তরুণীরাই এদের প্রধান টার্গেট। রাকিব, সুমন, পাভেল হোসেন পাপন, কামরুল হাসান রনি, নিলু, আমির, রাহিম মিয়া ছাড়াও প্রায় অর্ধশত সদস্য রয়েছে এই চক্রে। তাদের জিম্মিদশায় এখন বন্দি রয়েছে অর্ধশতাধিক কিশোরী, তরুণী এমনকি শিশুও। রাজধানী ছাড়াও গাজীপুর, জয়দেবপুরের বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে নিয়ে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে বাধ্য করা হচ্ছে এসব হতভাগ্য মেয়েকে। দ্রুত এই চক্রের হাত থেকে ওই মেয়েদের উদ্ধারে সংশ্লিষ্টদের কাছে জোর দাবিও জানান তিনি।
ভুক্তভোগী যুবতীর অভিযোগের বিষয়ে জানতে গতকাল সন্ধ্যায় এক ঘণ্টার ব্যবধানে যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মো. আনিসুর রহমানের ব্যবহৃত সরকারি মোবাইল ফোনে দুই দফায় একাধিকবার যোগাযোগ করা হয়। ওপাশ থেকে ভেসে আসা কণ্ঠ জানান তিনি ওসির বডিগার্ড। বলেন, ‘স্যার নিচে গেছেন হাঁটতে। এরপর বেশ কয়েকবার চেষ্টার পরও তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।
ডেমরা জোনের এসি এস এম তারেক রহমানকে ওই যুবতীর ভোগান্তির বিষয়ে অবগত করা হলে তিনি আমাদের সময়কে বলেন, এ ধরনের অভিযোগের বিষয়ে আমি অবগত নই। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পিএনএস/আলআমীন
প্রেমিকা থেকে দেহপসারিণী
08-12-2016 01:02PM