কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি প্রতিদিন

  20-01-2017 01:04PM

পিএনএস ডেস্ক: দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রাণ চট্টগ্রাম বন্দর। রাজস্ব বৃদ্ধির চালিকাশক্তি এই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়েই প্রতিদিন মিথ্যা ঘোষণায় আসা-যাওয়া করছে হাজার হাজার কোটি টাকার পণ্য। এতে সরকার হারাচ্ছে কোটি টাকার রাজস্ব, সুবিধা নিচ্ছে বন্দরে কর্মরত কাস্টমসসহ বিভিন্ন বিভাগের একশ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী। এমন তথ্যই উঠে এসেছে শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে।

অভিযোগ রয়েছে, বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকির ‘চুক্তি’র নেপথ্যে থেকে কাজ করে পণ্য খালাসে নিয়োজিত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। মূলত আমদানিকৃত পণ্যর পরিমাণ কম দেখানো কিংবা এক পণ্যর ঘোষণা দিয়ে অন্য পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে কোটি কোটি টাকায় আপসরফার মাধ্যম হিসেবেই কাজ করে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টরা। এসব অপরাধে বিভিন্ন কর্মকর্তা দোষী সাব্যস্ত হলেও চাকরি হারানোর নজির কম। অন্যদিকে জড়িত সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করা হলেও তারা ভিন্ন নামে আগের মতোই রাজস্ব ফাঁকির সহায়ক হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে।

শুল্ক গোয়েন্দারা বলছে, গত এক বছরে চট্টগ্রাম বন্দরে বিশাল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকির শতাধিক ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি নতুন করে রাজস্ব কর্মকর্তা, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ও আমদানিকারকের ঐক্যবদ্ধ রাজস্ব ফাঁকির বড় দুটি ঘটনা ধরা পড়ে। এ দুটি চালানে প্রায় এক কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়। গত ২৭ ডিসেম্বর শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয় থেকে রাজধানীর কাকরাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর এ বিষয়ে দুটি আলাদা চিঠি পাঠানো হয়।

এতে বলা হয়, গোপন সংবাদে শুল্ক গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানতে পারেন পুরান ঢাকার পাটুয়াটুলী রোডের আমদানিকারক রয়েল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল মিথ্যা ঘোষণায় বিপুল পরিমাণ পণ্য আমদানি করেছে। ফকিরহাট চট্টগ্রামের ‘বনলতা শিপিং এজেন্সিজ লিমিটেড’ নামক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মাধ্যমে ‘ইলেকট্রনিক্স কম্পনেন্টস‘ নামে চীন থেকে পণ্য আমদানি করে তারা। পণ্যর বিবরণে আইটেম ছিল মাল্টিমিটার, এসি/ডিসি পাওয়ার সাপ্লাই, ভিজিএ কেবল ও রিচার্জঅ্যাবল ব্যাটারি। কিন্তু পণ্যর গায়ে ‘ইলেকট্রনিক্স কম্পনেন্টস’র সাবহেডে ‘স’ লেখা ছিল। সাবহেডের কারণেই স্পষ্ট যে, পণ্য আমদানিতে অসামঞ্জস্য রয়েছে।

ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, বন্দরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম মোল্লা যাচাই-বাছাই বা সঠিকভাবে ইএলসি, মেনিফেস্ট যাচাই ও শুল্কায়ন সম্পন্ন না করেই গত ১৬ ডিসেম্বর চালান ছেড়ে দেন। এক্ষেত্রে তিনি চরমভাবে দায়িত্ব অবহেলা করেছেন। পণ্য খালাসের বিষয়ে বন্দরে দায়িত্বরত অপর রাজস্ব কর্মকর্তা নাছিরউদ্দিন মাহমুদ খান তদন্তকারী শুল্ক কর্মকর্তাদের কাছে বক্তব্য দেন, তিনি কায়িক পরীক্ষা করেছেন। কিন্তু শুল্ক গোয়েন্দার তদন্তে খালাসকালে কায়িক পরীক্ষার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বরং মেইন হেডিং এবং সাবহেডিংয়ের অসামঞ্জস্য থাকা সত্ত্বেও তিনি বিভিন্ন বাণিজ্যিক দলিলাদি পর্যবেক্ষণ না করে শুল্কায়ন কার্যক্রম সম্পন্ন করেন। এ সময় ২৬ লাখ ৮১ হাজার ২৯ টাকা রাজস্ব জমা হলেও এর বাইরে ফাঁকি ছিল ২৪ লাখ ৩৩ হাজার ৫শ দুই টাকা।

তদন্তে বলা হয়, ওই চালানটি খালাসে আমদানিকারক, এজেন্ট, কাস্টমস কর্মকর্তা রাজস্ব ফাঁকির সঙ্গে জড়িত। এক্ষেত্রে আমদানিকারক, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এবং দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনগত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও সুপারিশ করেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর চট্টগ্রাম আঞ্চলিক কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক হোসাইন আহমেদ।

তার স্বাক্ষরিত একই দিন পাঠানো অপর চিঠিতে বলা হয়, গত ২ নভেম্বর চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি ইয়ার্ডে রেডিমেট গার্মেন্টসের একটি পণ্য চালান মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে খালাস করা হয়। ঢাকার পূর্ব কেরানীগঞ্জের সাস ইন্টারন্যাশনালের নামে কন্টেইনারভর্তি চালানটি খালাসে ছিল চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ মোগলটুলীর ‘মেহেরুন সিন্ডিকেট’। খালাস স্থগিত করা ওই চালানের ঘোষণায় ছিল ২২ হাজার ৯৪০ পিস শীতবস্ত্র। কিন্তু বাস্তবে আনা হয় ৩৮ হাজার এক পিস বেশি দামের শীতবস্ত্র।

শুল্ক গোয়েন্দার তদন্তে বলা হয়, মিথ্যা ঘোষণার মাধ্যমে ১৪ লাখ ৬১ হাজার ১৬১ টাকা শুল্ক পরিশোধ করা হয়। আর ফাঁকি দেওয়া হয় ৬২ লাখ ৪৭ হাজার ১১২ টাকা। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট, আমদানিকারক ছাড়াও জেটি কাস্টমসের পরীক্ষণকারী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মো. রফিকুল ইসলাম এবং সহকারী কমিশনার মো. আহসানউল্লাহ ৬২ লাখ ৪৭ হাজার ১১২ টাকা রাজস্ব ফাঁকির অপচেষ্টায় সরাসরি জড়িত। আমদানিকারকের পক্ষে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টের মালিক নিজেও অপরাধ স্বীকার করেন। তাই সংক্ষিপ্ত বিচারাদেশে তাকে ১৫ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

শুধু চট্টগ্রাম বন্দরই নয়, অন্যান্য নৌবন্দর-বিমান ও স্থল বন্দরগুলোতেও প্রতিনিয়ত এই তিন সিন্ডিকেট এক হয়ে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। এ ব্যাপারে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরে মহাপরিচালক জানান, একটি চক্র মিথ্যা ঘোষণায় পণ্য আমদানির চেষ্টা করলেও গোপন সংবাদ বা সন্দেহজনকভাবে তদন্তের পর জরিমানা করা হচ্ছে। রাজস্ব ফাঁকির কৌশল ঠেকাতেও তারা কাজ করছেন।

সুত্র: আমাদের সময়


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন