‘তোমরা আমাকে মাপ করে দাও, আমি আর বাঁচব না’

  27-02-2017 12:44PM

পিএনএস ডেস্ক: গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সরকারদলীয় এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটন হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী, কিলাদের অর্থ জোগানদাতা ও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদানকারী আসামি জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি ডা. কর্নেল (অব) আব্দুল কাদের খান স্বজনদের কাছে আকুতি জানিয়ে বলেছেন, তোমরা আমাকে মাপ করে দাও, আমি আর বাঁচব না, তোমরা আমাকে বিদায় দাও।

গতকাল রোববার কাদের খানের গ্রামের বাড়ি উপজেলার ছাপড়াহাটীর খানপাড়ায় গিয়ে তার ছোট ভাই ইউসুফ খানের স্ত্রী ফিরোজা বেগমের সঙ্গে আলাপকালে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে ভাশুরের আকুতির কথা এ প্রতিবেদককে বলেন। ফিরোজা আরও জানান, গত ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে কাদের খানকে গ্রামের বাড়িতে নেওয়া হলে তিনি (কাদের খান) প্রশাসনকে উদ্দেশ করে বলেন, স্বজনদের কাউকে আমার এ অপকর্মের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করবেন না, তারা কেউ কিছু জানে না। এক প্রশ্নের জবাবে ফিরোজা বেগম বলেন, আমরা বিশ্বাস করতে পারিনি তিনি (কাদের খান) এ কাজ করতে পারেন। তিনি খুব সহজ-সরল মানুষ।

গতকাল রোববার দুপুরে কাদের খানের ছাপড়হাটী গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় শতশত উৎসুক নারী-পুরুষের ভিড়। পরে পুলিশ গিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

লিটন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে কাদের খানের জবানবন্দি দেওয়ায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন গাইবান্ধা ও সুন্দরগঞ্জের রাজনৈতিক অঙ্গনে। স্থানীয় নেতারা বলেছেন, সাম্প্রতিক রাজনীতিতে যে অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, লিটন হত্যাকা- তারই প্রতিফলন।

সুন্দরগঞ্জ আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী গোলাম মোস্তফা আহম্মেদ বলেন, সাবেক এমপি কাদের খান এমপি লিটন খুনের আসামি। এতে অবাক হবার কিছু নেই। তার রাজনৈতিক জীবন পর্যালোচনা করলে বুঝা যায় রাজনৈতিক মঞ্চে হাইব্রিড রাজনীতির কোন স্থান ছিল না, নেই, থাকবেও না। লিটন খুনের দায় স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছেন আসামি কাদের খান। এতে এটাই প্রমাণ হয় হাইব্রিড রাজনীতিবিদরা এমন অপকর্ম করতেই পারে। তাই প্রকৃত রাজনীতি যারা করেন, রাজনীতির মাঠে থাকা তাদেরই শোভা পায়। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কাদের খান গ্রেপ্তার হলেও উপনির্বাচনে কোন প্রভাব পড়বে না। বরং গ্রেপ্তার হওয়ায় ভোটাররা নির্বিঘেœ ভোট দিতে যাবে।

জাতীয় পার্টির (এরশাদ) ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, প্রয়াত এমপি মনজুরুল ইসলাম লিটন ও সাবেক এমপি কাদের খানের মধ্যে উচ্চাভিলাষী রাজনীতি নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। এমপি লিটন হত্যা ও কাদের খানের গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে এরই প্রতিফলন ঘটিয়েছে। আসন্ন উপনির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে না বলে জানান তিনি।

সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আব্দুল্যাহ আল মামুন বলেন, কাদের খানের এই কর্মকা-ে জনগণ ক্ষুব্ধ। আগামী নির্বাচনে তার প্রতিফলন ঘটবে।

লিটন হত্যার সমন্বয়ক সুবল নজরদারিতে : এমপি লিটন হত্যার অন্যতম সমন্বয়ক চন্দন গা-ঢাকা দিলেও অপর সমন্বয়ক কাসাই সুবল চন্দ্র পুলিশি নজরদারিতে রয়েছে। লিটন হত্যায় জড়িত মেহেদী হাসান, শামীম ম-ল, শাহীন, রানা ও খুনের সহযোগী কাদের খানের গাড়িচালক আব্দুল হান্নানের স্বীকারোক্তিতে অন্যতম সমন্বয়ক চন্দন কুমারের নাম উঠে আসে। উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক বামনডাঙ্গার মনমথ গ্রামের কাঠমিস্ত্রি সুশীল চন্দ্রের ছেলে চন্দনকে পুলিশ খুঁজছে। বামনডাঙ্গা ইউনিয়ন যুবলীগের আহ্বায়ক নাদিম হোসেন জানান, উপজেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক চন্দন কতিপয় রাজনৈতিক কর্মী পরিচয়ধারী সন্ত্রাসীর সঙ্গে দীর্ঘদিন থেকে মিলেমিশে বামনডাঙ্গা হলমোড়ের রেলগেটসংলগ্ন গণির চায়ের দোকানের কাছে একটি রাজনৈতিক দলের অফিসে এমপি লিটনবিরোধী কর্মকা- পরিচালনা করে আসছিল। খুনিদের স্বীকারোক্তিমতে, এমপি লিটন হত্যার অপর সমন্বয়ক চন্দনের ভগ্নিপতি রংপুর সেবা ক্লিনিকে চিকিৎসারত মনমথ রায়পাড়া এলাকার মৃত জুগি চন্দ্র রায়ের ছেলে কাসাই সুবল চন্দ্র।

আরও অস্ত্রের সন্ধানে তল্লাশি : সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আতিয়ার রহমান জানান, কাদের খানের স্বীকারোক্তি অনুসরণ করে আরও একটি পিস্তলের সন্ধানে তার বাড়িতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তল্লাশি অভিযান চলছে।

কাদের খানের রাজনীতিতে পদার্পণ : চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর কাদের খান ২০০৪ সালে জাতীয় পার্টির (এরশাদ) রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় এলাকায় তিনি নিজ অর্থে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ করেন। পরে ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মহাজোটের শরিক দল হিসেবে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে সুন্দরগঞ্জ আসনে এমপি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি একই দলের মনোনয়নে ওই আসনে নির্বাচনে অংশ নিলেও এমপি নির্বাচিত হন মনজুরুল ইসলাম লিটন।

হত্যার দায় থেকে বাঁচতে ভারতে অবস্থান : ঘাতকদের স্বীকারোক্তির বরাতে পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, এমপি লিটন হত্যাকা-ে জড়িত নন, এমন অকাট্য প্রমাণ রাখতে ভিসা-পাসপোর্টে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে গত বছর ১৯ অক্টোবর ভারতে যান এবং চলতি বছর ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ভারতে অবস্থান করেন কাদের খান। ভিসা-পাসপোর্টে ভারতে অবস্থান করলেও এমপি লিটন হত্যা মিশন সফল করতে তিনি চোরাইপথে দুই থেকে তিনবার ভারত থেকে বাংলাদেশে আসা-যাওয়া করেন। ভারতের আসাম রাজ্যের একটি স্থলবন্দর দিয়ে চোরাইপথে বাংলাদেশে আসেন তিনি। এর আগেও তিনি কয়েক দফা চোরাইপথে ভারতে আসা-যাওয়া করেন। এই হত্যা মিশনে কাদের খান যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতা আব্দুল আজিজ ওরফে ঘোড়ামারা আজিজের সঙ্গেও বৈঠক করেন। সর্বশেষ চোরাইপথে বাংলাদেশে এসে ৩১ ডিসেম্বর নিজ বাড়িতে এমপি লিটন হত্যা মিশন সফল হওয়ার খবর নিশ্চিত হয়ে কাদের খান সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে চলে যায়। এমপি লিটন হত্যার পর আবার পাসপোর্ট-ভিসায় চলতি বছর ৬ জানুয়ারি ভারত থেকে কাদের খান দেশে ফেরেন।

এমপি লিটন হত্যারহস্য উদ্ঘাটন হওয়ায় মিষ্টি বিতরণ : এমপি লিটন হত্যারহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশের সাফল্যের প্রশংসা করেছেন এলাকাবাসী। এ উপলক্ষে গতকাল রোববার বিকালে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার কার্যালয় চত্বরে সর্বস্তরের মানুষ এবং পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আনন্দ প্রকাশ করেন। পরে মতবিনিময়সভায় বক্তব্য রাখেন ভারপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্যাহ আল ফারুক, পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট শাহ মাসুদ জাহাঙ্গীর কবির মিলন, সুন্দরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ আতিয়ার রহমান, জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবু বকর সিদ্দিক, সহসভাপতি ফরহাদ আব্দুল্যাহ হারুন বাবলু, গাইবান্ধা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর সাবু, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি রেজাউল করিম রেজা, জেলা জাসদ সাধারণ সম্পাদক গোলাম মারুফে মনা প্রমুখ। পরে পুলিশ সদস্য ও উপস্থিত সবার মাঝে মিষ্টি বিতরণ করা হয়।

সুত্র: আমাদের সময়


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন