আদুরীকে তাড়া করে ফেরে যে নদী

  18-07-2017 09:15PM

পিএনএস ডেস্ক : আদুরী এখন গ্রামে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মায়ের আঁচলতলে তার ঠাঁই। মায়ের বুকে পরম নির্ভরতায় ঘুমায় শিশু। সুন্দর সুন্দর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু চতুর্দশী আদুরীর চোখে কোমল স্বপ্নগুলো নেই। ঘুমের ঘোরে যে মূর্তিমতী ভয় তাকে তাড়া করে, তার নাম নওরীন জাহান নদী। এই নদীর হাতে কখনো থাকে উত্তপ্ত খুন্তি, কখনোবা ধারাল বঁটি, কখনোবা থাকে গরম ইস্তিরি বা জ্বলন্ত কয়লা।

আদুরীর এই নারকীয় স্বপ্নের কথা জানান তার মা শাফিয়া বেগম। আজ মঙ্গলবার মায়ের সঙ্গে আদালতে এসেছিল আদুরী। আদুরী বারবার বলছিল, নদী তার জিব পুড়িয়ে দিয়েছে। আগে যেভাবে সুন্দর করে কথা বলতে পারত, এখন সেভাবে পারে না। কথা বলতে গেলে কথা জড়িয়ে আসে। দেখা গেল, আদুরীর মাথার কয়েক জায়গায় কোনো চুল নেই। আদুরী জানাল, বঁটির কোপে তার মাথার এ অবস্থা। হাত-পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতনের সেই ক্ষতে প্রতিদিন যন্ত্রণা করে। যখন যন্ত্রণা শুরু হয়, তখন নদীর চেহারা মনের পর্দায় ভেসে ওঠে। অজানা আতঙ্ক ভর করে তার ওপর।

আদুরীকে নির্যাতনের মামলায় ঢাকার একটি আদালত মামলার আসামি নওরীন জাহান নদীকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাঁকে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তাঁর মা ইশরাত জাহানকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে ১১ বছরের গৃহকর্মী আদুরীকে পল্লবীর ডিওএইচএস এলাকার একটি ডাস্টবিনে আধমরা অবস্থায় পাওয়া যায়। এ ঘটনায় তার মামা নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে পল্লবী থানায় মামলা করেন। ওই বছরের অক্টোবরে নওরীন ও তাঁর মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। আদালত পরের বছর ৬ জুন তাঁদের বিচার শুরু করেন। ঘটনার পরপরই নওরীন গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। তাঁর দুটি সন্তান রয়েছে।

আদুরীকে নির্যাতনের কথা স্বীকার করে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন নওরীন। আদালতে তিনি বলেন, ১৭ বছর বয়সে ভালোবেসে তিনি বিয়ে করেন সাইফুল ইসলামকে। বিয়ের পর স্বামীর সঙ্গে তিনি বরিশালে থাকতেন। ২০১১ সালে আসেন ঢাকায়। স্বামীর সঙ্গে থাকতেন কাঁঠালবাগান এলাকায়। তাঁর স্বামী তাঁকে মারধর করতেন। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ঢাকায় আসার ছয় মাসের মধ্যে পল্লবীতে মায়ের বাসায় ওঠেন। এরপর থেকে তাঁর স্বামী আর কোনো খোঁজখবর নিতেন না। টাকাপয়সা নিয়ে মানসিক চাপের মধ্যে ছিলেন।

এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। আদুরী কাজে কোনো ভুল করলে তার ওপর তাঁর প্রচণ্ড রাগ হতো। তখন হাতের কাছে যখন যা পেতেন, তাই দিয়ে মারতেন। হাতে যখন খুন্তি থাকত, তখন খুন্তি দিয়ে ছ্যাঁকা দিতেন। আয়রন থাকলে আয়রন দিয়ে ছ্যাঁকা দিতেন। ব্লেড দিয়ে করেছেন ক্ষতবিক্ষত।

আদালত রায়ে বলেছেন, নদী ঠান্ডা মাথার নির্যাতনকারী। ঠান্ডা মাথায় তিনি আদুরীকে নির্যাতন করেন। আদুরীর ওপর নির্যাতন কেবল মানবতাবিরোধী নয়, তা আদিম ও শয়তানসুলভ।

এ ধরনের নির্যাতন সম্ভবত সারা পৃথিবীতে বিরল। ভয়াবহ নির্যাতনকারী নওরীন জাহান নদীর মতো কোনো আসামির জায়গা আর বাংলার মাটিতে হবে না।

নদীর নির্যাতন প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির আইনজীবী ফাহমিদা আক্তার বলেন, নদী যে কাজ করেছেন, তা কোনো সুস্থ মানুষের কাজ হতে পারে না। মামলার নথিপত্র থেকে যেটুকু জানতে পেরেছি, তাঁদের দাম্পত্য জীবনে সমস্যা ছিল। নদীর সঙ্গে তাঁর স্বামীর সমস্যা ছিল। পৈশাচিক কায়দায় নদী আদুরীকে নির্যাতন করেন।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ‘বেশির ভাগ গৃহকর্মী নির্যাতনের ঘটনার ক্ষেত্রে দেখেছি, শক্তিশালী ব্যক্তিদের অসহায়দের নির্যাতন করার প্রবণতা রয়েছে। আমাদের বেশির ভাগ মামলায় আসামিরা পার পেয়ে যায়। যে কারণে এরা মনে করে, গৃহকর্মীদের নির্যাতন করে পার পাওয়া যাবে। এসব নির্যাতনের ক্ষেত্রে বেশির ভাগ আসামি নারীরা থাকেন। তাঁদের এই ভয়াবহ রূপটা দেখতে আমাদের খারাপ লাগে। এ ধরনের অপরাধীদের শাস্তি হলে অপরাধটা কমে আসে।’

হাত-পাগুলো শুকিয়ে কাঠি। পাঁজরের সব কটি হাড় গোনা যায়। শরীরে অনেকগুলো পোড়া ও জখমের দাগ, মাথা, ঠোঁট, মুখমণ্ডলেও আঘাতের চিহ্ন। জীবন্মৃত এক শিশু। ডাস্টবিনে এ অবস্থায় ১১ বছরের এক মেয়েশিশুকে খুঁজে পান দুজন নারী। পরে এলাকাবাসী ও পুলিশের সহায়তায় শিশুটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকেরা বলছেন, শিশুটি খুবই দুর্বল। অনেক দিন তাকে কিছু খেতে দেওয়া হয়নি।

সেসব দিনের ঘটনা মনে করে আদুরী বলছিল, ‘আমাকে ঠিকমতো খাওন দিত না। ওর মনে ধরলে পচা ভাত দিত। মরিচের গুঁড়ো দিত। লবণ দিত। এগুলো খাইতে চাইতাম না। জোর করে এসব মারধর করে খাওয়াইতো। আমাকে ব্যালকনিতে ঘুমাতে দিত। জিবের ভেতর গরম কয়লা দিয়ে মুখ চেপে ধরত। এতে আমার জিহ্বা পুড়ে গেছে।’ দেখা গেল, আদুরীর জিবের সামনের অংশ নেই।

নদীর নির্যাতনের কথা বলতে গিয়ে তার মা শাফিয়া বেগম বলছিলেন, নদীর দেওয়া ক্ষত সারা জীবন আদুরীকে বয়ে বেড়াতে হবে। চোখের সামনে মেয়ের এমন অবস্থা দেখে নিজের মনকে সান্ত্বনা দিতে পারি না। মানুষে কীভাবে পারে এমন নির্যাতন করতে? নদী কি মানুষ না অন্য কিছু?

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন