১৯ মামলার আসামির ফেসবুক প্রোফাইলে প্রধানমন্ত্রীর ছবি

  19-07-2017 12:41PM

পিএনএস ডেস্ক: থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার পাশের কক্ষ থেকে ভেসে আসছিল কারো আর্তনাদের শব্দ। পাশের ঘরে গিয়েই মিলল আর্তনাদের উৎস। চোখ আটকে যায়, পুলিশ কর্তৃক এক আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদের দৃশ্যে ‘বল, বাকি মাল কই রাখছস, আর কে আছে গ্যাংয়ে’ বলতে বলতে মোটা একটি লাঠি দিয়ে এক যুবককে পেটাচ্ছিলেন এক এসআই। তথ্য মেলে জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশের বক্তব্যে।

পিটুনি থামিয়ে এসআই বলেন, ‘আর বইলেন না ভাই, এইটা (যুবক) বাবা তো খায়ই, ব্যবসাও করে। অনেক কষ্টে বাবাসহ ধরেছি, কিন্তু ব্যাটা এখন সাধুর ভাব নিচ্ছে, মুখ খুলছে না। তাই একটু…। অতঃপর পুরো ঘটনা শুনে বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে থানা থেকে বেরিয়ে আসেন এই প্রতিবেদক। ২০১৫ সালের শেষ ভাগের কোনো এক রাতে রাজধানীর খিলগাঁও থানার ঘটনা এটি।

গত সোমবার সন্ধ্যায় ফেসবুকে বিট পুলিশিং সমাবেশের একটি মিছিলের ছবিতে ফের আটকে যায় এই প্রতিবেদকের দৃষ্টি। মিছিলের প্রথম সারিতেই দেখা যায় থানায় পিটুনির শিকার সেই যুবককে। ‘বিট পুলিশিং সমাবেশ সফল হোক, খিলগাঁও থানার বিট নং-১’ লেখা ব্যানার হাতে তিনি। পুলিশের ভাষ্যমতে, যিনি একাধারে মাদকসেবী এবং ব্যবসায়ী, তিনি কীভাবে পুলিশের লোগোসংবলিত ব্যানার হাতে মিছিলের অগ্রভাগে থেকে নেতৃত্ব দিতে পারেন? বিষয়টির আরও গভীরে যেতে ওই যুবকের ফেসবুক পেজ ‘গফ জধলরন’ ঘেঁটে প্রতিবেদকের চোখ রিতিমতো চড়কগাছে। তার প্রোফাইল পিকচারে দেওয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছবি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই যুবকের নাম মো. রাজিব আলী। বয়স ৩০। বাবার নাম মো. জয়দর আলী। থাকেন রাজধানীর খিলগাঁওয়ের সি ব্লকে। রাজিব নিজেকে কখনো পরিচয় দেন ওয়ার্ড যুবলীগ নেতা, কখনো বনে যান ছাত্রলীগ-শ্রমিকলীগ নেতা। যদিও ক্ষমতাসীন দলের ওই তিন সংগঠনের স্থানীয় নেতারা জানিয়েছেন, রাজিব আলী চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী। এই নামে তাদের কোনো নেতাকর্মী নেই। শুধু মাদকসেবীই নন, রাজধানীর মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে অন্যতম ডিলার রাজিব। রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে রয়েছে মাদক ব্যবসা, হত্যাচেষ্টা, ছিনতাই-চাঁদাবাজি, দস্যুতা, জবরদখলের অভিযোগে ২০টিরও বেশি মামলা। তা ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দপ্তর, ডিএমপি কমিশনারের দপ্তরেও রয়েছে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ।

সূত্র জানায়, রাজিব আলীর রয়েছে নারী-পুরুষের সমন্বয়ে ৭৪ সদস্যের একটি বিশাল বাহিনী। তাদের কেউ মাদক ব্যবসা দেখভালের দায়িত্বে আছেন, কেউ দেখেন নারীঘটিত অনৈতিক ব্যবসা, কেউ বুঝে নিয়েছেন ভূমি-ফুটপাত দখলের দায়িত্ব। বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যকেই ভাগ করে দেওয়া আছে মহল্লা-গলি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসাধু সদস্যকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব পালন করে তার কাছের লোকজন। এসব অবৈধ কর্মকা-ে কেউ বাগড়া দিলে বা প্রতিবাদ করলে তাদের সায়েস্তা করার জন্যও রাজিবের রয়েছে ক্যাডার বাহিনী। ছোট ঘটনায়ও তারা হামলে পড়ে নিরীহ মানুষের ওপর। মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ১০ জুলাই রাতে বনশ্রীর ঝুমুর গলিতে মোহর আলী নামে এক যুবককেও কুপিয়েছে রাজিব আলী ও তার সেকেন্ড ইন কমান্ড শুক্কর আলীসহ কয়েকজন।

পুলিশ জানিয়েছে, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে মাদক ব্যবসা, হত্যাচেষ্টাসহ রাজীবের বিরুদ্ধে মতিঝিল, রামপুরা, খিলগাঁও থানায় হয়েছে ১৩টি মামলা। চলতি বছরের ২০ মার্চ মতিঝিল ও ২ জুলাই রামপুরা থানায় পৃথক দুইটি মাদক মামলা হয় তার বিরুদ্ধে।

পুলিশ আরও জানায়, বিভিন্ন অভিযোগে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের কয়েকটি থানায়ও তার বিরুদ্ধে রয়েছে ছয়টি মামলা। এ ছাড়া র‌্যাব, ডিবি পুলিশ, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও মাদকসহ গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে করেছে আরও মামলা। বর্তমানে প্রায় সবকটি মামলায় জামিনে এসে দুর্ধর্ষ মাদক এই ব্যবসায়ী দিব্বি চালিয়ে যাচ্ছেন মাদকের বিস্তার।

এদিকে রাজীবের ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে সাহস পাচ্ছেন না।

অভিযোগ রয়েছে, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) এসি ও পরিদর্শক পদমর্যাদার ৩ জন, র‌্যাব ৩-এর দুই সদস্য, খিলগাঁও-রামপুরা থানার ৫ জন এসআই, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ২ জন জোনাল কর্মকর্তা এবং ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় পর্যায়ের ৮ জন নেতার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ মদদে বেপরোয়া রাজিব। প্রকাশ্যেই চালিয়ে যাচ্ছেন মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্ম।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, ৪ বছর আগেও রাজিব আলী ছিলেন নিতান্তই একজন কসাই। খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ছিল তার ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু এই ৪ বছরেই বহু জমি ও একাধিক ফ্ল্যাট ছাড়াও বিশাল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। মরণঘাতী ইয়াবা, ফেনসিডিল বাণিজ্যই তার আয়ের উৎস। কোটিপতি হওয়া ছাড়াও ঢাকা শহরের মাদকের বড় ডিলারের খেতাবও ইতোমধ্যে অর্জন করেছেন এই রাজিব। ফলে রামপুরা-খিলগাঁও তো বটেই, রাজধানীর বড় বড় মাদক ব্যবসায়ীরাও তাকে সমীহ করে চলে।

জানা গেছে, খিলগাঁও থানার ২০০ গজের মধ্যে নোয়াখালী গলিতে এখন মাদকের বড় মোকাম গড়ে তুলেছেন রাজিব আলী। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সপ্তাহে দুই দিন মাদকের চালান আসে তার স্পটে। গভীর রাতে মাইক্রোবাস এবং অ্যাম্বুলেন্সে আসে এসব চালান। এখান থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয় ফেনসিডিল ও ইয়াবা। তার মাদক সাম্রাজ্যের সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য হলো শুক্কর আলী, তুষার, সুন্দর জনি, সোহেল, আদনান, সামস, সাইফুল, রিফাত, সাদ, মাসুদ, জংসিন, রাসেল ওরফে কানা রাসেল, রনি, মিরু, সাগর ওরফে ইয়াবা সাগর, ইয়াবা মামুন, বাবা সুজন, জোবায়ের, তুষার, রেহানা, বৃষ্টি, ফাতেমা, কুলসুম ও পাখি।

থানার পেছনের গলিতে ইয়াবার বড় মোকাম হিসেবে পরিচিত স্পটটি নিয়ন্ত্রণ করে জাহাঙ্গীর, ফাতেমা, নাজমা, খালেক ও কুলসুম। কুমিল্লা বস্তিতে মাদক ব্যবসার নিয়ন্তা ইউসুফ, কনক ও পুলক। এই বস্তির উল্টো পাশেই একতা সড়কে অ্যাম্পলের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সিরাজ ওরফে ফেনসি সিরাজ ও অ্যাম্পল জামাল। সি-ব্লকের ফেনসিডিলের বড় স্পটের নিয়ন্ত্রক জেনারেটর রিপন ও নেসার। সিন্ডিকেটে তুহিন, জাহাঙ্গীর, ভুট্টো, লিজু, কালু, বাদল, রানা ছাড়া ১৪ জনের একটি সহযোগী বাহিনী রয়েছে। এদের কেউ কেউ সম্প্রতি আটক হয়েছেন বলে জানা গেছে।

নির্বিঘে রাজিবের মাদক স্পটগুলো সচল রাখতে খিলগাঁও থানার সোর্স পরিচয় দানকারী রহমান, সেলিম, সাগর, লুঙ্গি ফারুক, আলমগীর, মজিবর, প্রদীপ, মোরতেজা, কাঞ্চন, মুরাদ, রনি, গাজী, মিজান, গাফফার, হিরুইনচি বাবু, আজাহার ওরফে আজাদ, নাসির, রহিম, জাফর, কুট্টি ও লিয়াকত কাজ করছে। দৈনিক-সপ্তাহিক-মাসিক ভিত্তিতে এসব সোর্সের সঙ্গে রাজিবসহ স্থানীয় অন্য মাদক ব্যবসায়ীদের মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেনের চুক্তি আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে রাজিব আলী বলেন, মাদক ব্যবসার সঙ্গে কখনোই তিনি জড়িত ছিলেন না। উদ্দেশ্যমূলকভাবে পুলিশ তার বিরুদ্ধে এতগুলো মামলা দিয়েছে। আর প্রকৃত মাদক ব্যসায়ীরাই তার বিরুদ্ধে এখন অপপ্রচার চালাচ্ছে।

খিলগাঁও থানার ওসি কাজী মইনুল হোসেন বলেন, মাদক ব্যবসায়ী রাজিব আলীর বিরুদ্ধে এক ডজনেরও বেশি মামলা রয়েছে। রাজিব ও তার সহযোগী কয়েকজনকে মাদকসহ পাঁচ-সাতবার গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়েছিল; কিন্তু জামিনে বেরিয়ে তারা ফের অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছে বলে তথ্য রয়েছে।

সূত্র: পূর্বপশ্চিমবিডিনিউজ


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন