গাছে বেঁধে আ.লীগের নির্যাতনের শিকার শেফালীর সন্তান মারা গেছে

  11-08-2017 12:14PM

পিএনএস ডেস্ক:পিতা হত্যা মামলার সাক্ষ্য দেওয়া থেকে বিরত রাখতেই গরু চুরির সাজানো অভিযোগে ধরে এনে গাছের সঙ্গে বেঁধে বর্বর নির্যাতন করা হয়েছে সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার গৃহবধূ শেফালী বেগমকে। গতকাল বৃহস্পতিবার রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে শেফালী এ অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, তার ওপর বর্বর নির্যাতনকারীরা সবাই স্থানীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা এবং তার পিতার হত্যা মামলাটি ধামাচাপা দিতে তার ওপর এমন বর্বরতা চালানো হয়েছে।

এদিকে নির্যাতনের কারণে সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া শেফালীর কন্যাসন্তানটি বুধবার রাত ৯টার দিকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যায়। গত ৪ আগস্ট নির্যাতনের শিকার হলে শনিবার শেফালীকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় দুই মাস আগেই সোমবার বিকালে হাসপাতালে তিনি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন। সে কারণেই শিশুটিকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক।

জানা গেছে, গত ৩ আগস্ট ডিমলা উপজেলার খালিসা চাপানি ইউনিয়নের বাইশপুকুর কোলনঝাড় গ্রামের রিকশাচালক লালন মিয়ার স্ত্রী শেফালীর বোন আকলিমার সঙ্গে তার স্বামী রফিকুলের ঝগড়া হয়। পরদিন শুক্রবার সকালে স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া মিটমাট করতে শেফালীসহ ৩ জন আকলিমাকে রফিকুলের বাড়িতে নিয়ে যায়। বাড়ি থেকে ফেরার পথে রফিকুলের মামা দবির উদ্দিনের উঠানে মীমাংসার কথা বলে সেখানে শেফালীর ওপর নির্যাতন শুরু হয়। মধ্যযুগীয় কায়দায় অমানবিকভাবে গাছে বেঁধে নির্যাতন চালানো হয় সকাল ১০টা থেকে বিকাল পর্যন্ত ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা এই নারীকে। পরে গুরুতর অবস্থায় প্রথমে তাকে জলঢাকা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে অপরিপক্ক অবস্থায় তিনি সন্তান জন্ম দেন।

ওই ঘটনায় গত রবিবাব রাতে ডিমলা থানায় শেফালীর মামা সহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার ১৯ জন নামীয় ও অজ্ঞাতনামা ৫ জনকে আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে পুলিশ তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। তারা হলেন শেফালীর বড় বোন আকলিমার স্বামী রফিকুল ইসলাম, শাশুড়ি অপিয়া বেগম ও গ্রাম পুলিশ রফিকুল ইসলাম। গ্রেপ্তারকৃতদের সোমবার দুপুরে আদালতের মাধ্যমে জেলা কারাগারে পাঠানো হয়।
নির্যাতিত শেফালী বেগম রমেক হাসপাতালে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই প্রতিবেদককে বলেন, যারা আমাকে নির্যাতন করেছে, তারা ৫ বছর আগে আমার বাবা মশিয়ার রহমানকে প্রকাশ্যে খুন করেছিল। এ ঘটনায় আমার বড় ভাই রমজান আলী বাদী হয়ে থানায় মামলা করেন। মামলাটি তুলে নেওয়ার জন্য আসামিপক্ষ বিভিন্ন সময়ে আমাদের ভয়ভীতি ও টাকার লোভ দেখাত। তাদের ভয়ভীতির কারণে দুবার মামলার সাক্ষ্য দিতে যেতে পারিনি।

আগামী ২২ আগস্ট মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। ওই তারিখে আমি এবং আমার পরিবারের সদস্যরা যাতে সাক্ষ্য দিতে না পারি সে জন্য তারা আমাকে হুমকি দিয়ে আসছিল। আমি তাদের কথায় কর্ণপাত না করায় পরিকল্পিতভাবে আমাকে গরু চোর সাজিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে মারপিট করেছে। তাদের মারপিটের কারণে আমার সন্তান মারা যায়। তিনি আরও জানান, আমাকে যারা মারপিট করে, তারা অনেকেই আওয়ামী লীগ করে। এর মধ্যে ৪নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কাদের, নুর আলম শাহ, সোহরাব আলী, তালিমদার মাস্টার রয়েছেন। এ ছাড়া আমার বাবার হত্যাকারী হাফিজুর ও নিরোদসহ বেশ কয়েকজন ছিল সেদিন। শেফালী আরও অভিযোগ করেন, তার স্বামী ঢাকা শহরে রিকশা চালায়। যারা নির্যাতন করেছে, তারা এলাকায় খুব প্রভাবশালী।

রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনোকোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসি সুলতানা জানান, শেফালী বেগমের প্রসব সময়ের ৯ সপ্তাহ আগে ৯শ গ্রাম ওজন নিয়ে শিশুটির জন্ম হয়। অপরিপক্ক অবস্থায় জন্ম নেওয়ায় শিশুটি মারা যায়।

রমেক হাসপাতালে শেফালী বেগমের ছোট বোন শিউলি আক্তার মুন জানান, তার বোনকে গাছে বেঁধে লাথি, কিল-ঘুষি মারা হলো। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল কাদের ওরফে নারিয়া কাদের অমানবিকভাবে নির্যাতন চালান তার বোনের ওপর।

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী সেলিমুর রহমান জানান, ঘটনাস্থলে কেউ এগিয়ে আসেনি শেফালীকে বাঁচানোর জন্য। সকাল ১০টা থেকে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত নির্যাতন করা হয়েছিল শেফালীকে।

খালিশা চাপানি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান সরকার এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে বলেন, ঘটনার সময় আমি ছিলাম না। বিষয়টি অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। আসামিদের অধিকাংশ সরকারদলীয় লোক কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অপরাধীদের কোনো দল নেই। এ ঘটনায় সরকারদলীয় লোক জড়িত থাকলে অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আসতে হবে।

ডিমলা থানার ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, এ পর্যন্ত ৩ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের গ্রেপ্তারের জোর চেষ্টা চলছে। তিনি আরও জানান, শিশুটির ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার পর পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।

রমেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. অজয় রায় জানান, নবজাতক কন্যাশিশুর লাশ আমরা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছি। পুলিশ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন