প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে সনদ বাণিজ্য : ১৭ মাসে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি!

  13-09-2017 05:00PM

পিএনএস ডেস্ক : আব্দুল মোতালেব হাওলাদার। বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী। ২০১৪ সালের ৮ই জানুয়ারিতে তিনি সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে ভর্তি হন রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটিতে (আরএসটিইউ)। ভর্তির ১৭ মাস পরই ২০১৫ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর তাকে বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ডিগ্রি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। দেখা যায় চার বছর মেয়াদী স্নাতক এই কোর্সটি তিনিশেষ করেছেন মাত্র ১ বছর ৫ মাসে। একই সময় তিনি বরিশাল সিটি করপোরেশনে নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্ব পালন করে বরিশাল থেকে নাটোরে নিয়মিত ক্লাস-পরীক্ষা দিয়েছেন। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে তার এই ভুয়া সনদ ধরা পড়েছে।

শুধু মোতালেব নয় ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করা এই বিশ্ববিদ্যালয় এ পর্যন্ত ৮৫ জনকে ভুয়া সনদ দিয়েছে। যার প্রমাণ ইউজিসির কাছে রয়েছে। আরো শতাধিক জনকে সনদ দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। সরাসরি অবৈধ সনদ বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ায় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সাময়িক সনদ বাতিল করা ছাড়াও অবৈধ সনদগুলো বাতিল করার সুপারিশ করেছে ইউজিসি। প্রতিবেদনে মোতালেব হাওলাদারের স্নাতক সনদটি অবৈধ বলে কমিটির কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হওয়ায় বরিশাল সিটি করপোরেশনকে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করছে তদন্ত কমিটি।

ইউজিসি সদস্য অধ্যাপক ড. আখতার হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিতে আরো ছিলেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপ-পরিচালক জেসমিন পারভীন ও সিনিয়র সহকারী পরিচালক গোলাম মোস্তফা। তদন্তে সনদ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের বিষয়ে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কারণ দর্শানোর চিঠি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

ইউজিসির প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই নানা অনিয়মে জড়িয়ে গেছে। সার্টিফিকেট বাণিজ্যের অভিযোগে বন্ধ হওয়া বিতর্কিত আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির একাধিক ছাত্র তারা ভর্তি করিয়েছে। আমেরিকা বাংলাদেশে অননুমোদিত বিষয়ের ভর্তি হওয়ার অনেকেই ক্রেডিট ট্রান্সফার করে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি হয়েছেন। এ ছাড়াও ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানের একাধিক আর্থিক কেলেঙ্কারি প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ও ইউজিসির সদস্য প্রফেসর আখতার হোসেন বলেন, নানা বিতর্কের কারণে আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি বন্ধ করা হয়েছে। শুধু তাই নয় এই বিশ্ববিদ্যালয়কে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর অনুমোদন দেয়া হয়নি, অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রেডিট ট্রান্সফার গ্রহণ করে ১৭ মাসেই আব্দুল মোতালেবকে বিএসসি সনদ দিয়েছে। ক্রেডিট ট্রান্সফারের পক্ষেও প্রমাণ দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও আর্থিক অনিয়মও আমরা পেয়েছি। যা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে প্রতিবেদন আকারে দিয়েছি। তিনি বলেন, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাচ্ছি সেখানেই ছুটে যাচ্ছি। সরজমিনে যেসব অভিযোগ, অনিয়ম পাচ্ছি তা প্রতিবেদন আকারে মন্ত্রণালয়কে জানাচ্ছি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, আরএসটিইউ কর্তৃপক্ষ ১ বছর ৫ মাসের মধ্যে কীভাবে চার বছর মেয়াদি স্নাতক কোর্সের সনদ দেয়া হলো এবং ডিগ্রিপ্রাপ্ত ব্যক্তি বরিশাল সিটি করপোরেশনে কর্মরত অবস্থায় কীভাবে নিয়মিত ক্লাসে অংশগ্রহণ করলেন, সেসব প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারেননি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ড. সোলায়মান। তিনি কমিটির কাছে স্বীকার করেন যে, এ জাতীয় আরো অনেক সনদ ইস্যু করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ পর্যন্ত ৮৫ জনকে সনদ দেয়া হয়েছে বলেও কমিটিকে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত) সুমন চন্দ্র দাস।

বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবদুল আজিজ। তার বিরুদ্ধেও অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। কমিটির দেয়া প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল আজিজ তার ঢাকাস্থ আবাসিক ফ্ল্যাটের একাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের লিয়াজোঁ অফিস হিসেবে ব্যবহার করেন। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতি মাসে ৬৫ হাজার টাকা করে নিয়েছেন তিনি, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক ও অর্থ আত্মসাতের শামিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন তুলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, সরজমিনে পরিদর্শনে সেখানে কোনো ধরনের শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। ৫ তলাবিশিষ্ট ভাড়াকৃত ভবনের নিচতলায় গাড়ি মেরামতের গ্যারেজসহ দোকানপাট থাকায় শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হচ্ছে। শ্রেণিকক্ষগুলোয় ধুলাবালি জমে থাকায় দীর্ঘদিন ধরে ক্লাস পরিচালিত হয় না। লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা অপর্যাপ্ত এবং পড়ালেখার কোনো অনুকূল পরিবেশ নেই।

পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র তিনটি ল্যাবরেটরি থাকলেও এগুলোয় উল্লেখযোগ্য কোনো যন্ত্রপাতি নেই। টেক্সটাইল, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ও ফার্মেসি বিষয়ে প্রোগ্রাম থাকলেও এ বিষয়ক কোনো ল্যাব নেই। সিএসই বিভাগে ১৪টি কম্পিউটার থাকলেও নেই কোনো ইন্টারনেট সংযোগ। ইইই বিভাগে দৈন্যদশায় একটি ল্যাব থাকলেও তা নিয়মিত ব্যবহার হয় না। পরিদর্শনকালে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী উপস্থিত থাকলেও কোনো শিক্ষার্থীর উপস্থিতি ছিল না।

নানা অনিয়মের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পাঁচটি সুপারিশ করেছে ইউজিসি। ন্যূনতম ল্যাব সুবিধা না থাকায় ল্যাবভিত্তিক বিএসসি ইন ইলেক্ট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেক্ট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং, বিএসসি ইন টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিএসসি ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, বিএসসি ইন সিএসই ও বি.ফারম প্রোগ্রামে ২০১৭ সালে শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধ রাখা ও সুপারিশটির আলোকে একটি বিজ্ঞপ্তি কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিকে প্রকাশের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ২০১০-এর অত্যাবশ্যকীয় ধারা ৬, ৯, ১২, ১৪, ২৯, ৩৫, ৪৪ এবং ৪৬-এর অনুসরণ ও প্রতিপালন করতে ব্যর্থ হওয়ায় রাজশাহী সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির সাময়িক সনদ কেন বাতিল করা হবে না সে বিষয়ে ব্যাখ্যা চাওয়া যেতে পারে।

পিএনএস/জে এ /

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন