বনানী হত্যাকাণ্ডে সিসি ফুটেজে খুনিরা শনাক্ত

  16-11-2017 10:27AM


পিএনএস ডেস্ক: আড়াই মিনিটের মিশন। ক্লোজড সার্কিট ক্যামেরার (সিসি) ফুটেজের কাঁটায় কাঁটায় এতটুকু সময়ে বনানীর নিজ অফিসে জনশক্তি রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী মুন্সী ছিদ্দিক হোসেনকে গুলি চালিয়ে খুনের পর বেরিয়ে যায় ঘাতকরা। দলে ছিল চারজন। ঢোকে দুজন দুজন করে। প্রত্যেকের মুখে মুখোশ। বয়স ২৫-৩০। বনানীর কবরস্থান সড়কে আসার পর কিলিং মিশন শেষে একজন মোবাইল ফোনে অপরপ্রান্তে গ্রিন সিগন্যাল দেয়। এর পর হেঁটে যায় কবরস্থানের সেই সড়ক ধরে। হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মুখোশ খুলে পড়ে এক ঘাতকের। মুখোশ খোলা ওই যুবকসহ বাকি তিনজনকে পুলিশ শনাক্ত করতে পেরেছে।

পুলিশ সূত্র বলছে- সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার থেকে শ্রম ভিসা এনে জনশক্তি রপ্তানি করতেন নিহত মুন্সী ছিদ্দিক হোসেন। এ ছাড়া তার মালিকানাধীন মুন্সী ওভারসিজ সাব-কন্ট্রাক্টও দিত। সম্প্রতি তিনি সৌদি আরব থেকে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে আরও ২০০ শ্রম ভিসার কাজ পান। একসঙ্গে এই পরিমাণ জনশক্তি রপ্তানির অনুমতির বিষয়টি নিয়ে কারও সঙ্গে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব আছে কিনা তা গুরুত্ব পাচ্ছে তদন্তে। তবে সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত ফুটেজে খুনিদের আচরণ-গতিবিধি দেখে পুলিশ নিশ্চিত, খুনিরা পেশাদার ও ভাড়াটে।

বনানী থানাপুলিশ সূত্র জানায়, ছিদ্দিক হোসেনের সঙ্গে কারো প্রকাশ্যে বড় ধরনের বিবাদ ছিল না। তার বাড়ি টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এজেন্টের মাধ্যমে লোক এনে বিদেশে পাঠাতেন। এ নিয়ে বিদেশ গমনেচ্ছুদের সঙ্গে তার মাঝেমধ্যে ঝামেলা হলেও তা বেশি দূর যায়নি। তবে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের আব্দুস সালাম নামে এক এজেন্টের সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধে। আব্দুস সালাম বনানী থানায় মামলাও করেন ছিদ্দিক হোসেনের বিরুদ্ধে।

মামলায় সালাম উল্লেখ করেন, তিনি বিদেশে পাঠানোর জন্য এলাকা থেকে লোকজন এনে দেন। ওইসব লোকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ছিদ্দিক হোসেন তাদের বিদেশে পাঠাতে গড়িমসি করেন। এমনকি টাকাও ফেরত দেননি। সালামের মামলার পর দুই মাস আগে ছিদ্দিক হোসেন রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। তাতে তার অভিযোগ ছিল, চুক্তি মতো সালামের লোকজন পাঠানোর পরও সালাম তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দিচ্ছে। এ নিয়ে তিনি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।

পুলিশের গুলশান বিভাগের ডিসি মোশতাক আহমেদ বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে হত্যাকা-টি পরিকল্পিত। দুর্বৃত্তরা অফিস থেকে বেশি কিছু নেয়নি। হত্যার স্পষ্ট কারণ খুঁজে না পেলেও কয়েকটি বিষয়ে ধারণা রেখে তদন্ত শুরু করেছি।

বনানী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আব্দুল মতিন জানান, ফুটেজে চার মুখোশধারীকে ওই প্রতিষ্ঠানে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি করতে দেখা গেছে। যারা ঘটনাটি ঘটিয়েছে, ফুটেজে তাদের ছবি স্পষ্ট দেখা গেছে। তা ছাড়া তাদের সম্পর্কে তথ্যও পাওয়া গেছে। আশা করছি খুব শিগগির একটা ফল পাওয়া যাবে।

এদিকে বিকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মিজানুর রহমান, যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায়সহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মুন্সী ওভারসিজের কর্মী আলী হোসেন বলেন, আমরা তখন অফিস বন্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। স্যারও বেরিয়ে যাবেন। ওই সময় চারজন যুবক অফিসে ঢুকে বলতে থাকে, ‘মালিক কে? মালিক কে?’ এ সময় কিছু একটা খারাপ লক্ষণ বুঝে কয়েকজন এগিয়ে আসেন। মুখোশধারীরা তাদের গুলি করে। এতে তিনজন আহত হন।

আলী হোসেন মঙ্গলবার জানান, খুনিদের একজন অফিসের ড্রয়ার কোথায় তা তড়িঘড়ি জানতে চায়। এর মধ্যেই মালিক তার কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। তখনই অস্ত্রধারী একজন মালিককে লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়ে। এতে ঘটনাস্থলে লুটিয়ে পড়েন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শী মোকাররম হোসেন টিপু বলেন, চারজন ঘাতকের তিনজনের হাতে পিস্তল ছিল। তারা একের পর এক গুলি ছুড়তে থাকে। ওই দৃশ্য দেখে তিনি ভেতরের একটি কক্ষে লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু বেশি শব্দ হয়নি।

জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশের হাতে আটক হওয়ার আগে বাজী নামক ভবনের দারোয়ান জানান, হঠাৎ করে ওই চারজন ভেতরে ঢুকে যায়। তাদের মুখে মুখোশ ছিল কিনা সেটি দেখেননি। তবে ভেতরে শব্দ শুনতে পান। লোহার দরজার পর কাঠের দরজা থাকায় শব্দ কম হয়েছে বলে জানান। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মঙ্গলবার রাতে ম্যানেজার মোস্তাক পুলিশকে বলেন, ঘাতকরা অফিসের ড্রয়ার থেকে লক্ষাধিক টাকা নিয়ে গেছে।

মঙ্গলবার রাত ৭টা ৫৫ মিনিটে রাজধানীর বনানীর বি-ব্লকের ৪ নম্বর সড়কের ১১৩ নম্বর বাড়িতে ঢুকে ছিদ্দিক হোসেনকে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে হত্যা করে চারজন যুবক। এরপর অস্ত্র উঁচিয়ে বেরিয়ে যায় তারা। ছিদ্দিক হোসেনকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা জানান, তিনি আগেই মারা গেছেন।

একই ঘটনায় ওই অফিসে থাকা আরও তিনজনকে গুলি করা হয়। তারা হলেন মোস্তাক হোসেন মিরাজ, মোকলেসুর রহমান মোসলেহ উদ্দিন ও পারভেজ। মোসলেহ উদ্দিন ও পারভেজের অবস্থা গুরুতর। মোস্তাক হোসেন নিহতের ভাতিজা এবং প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার, মোসলেহ উদ্দিন ওই প্রতিষ্ঠানে জনশক্তি কর্মকর্তা এবং শফিকুর স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

এদিকে গতকাল বিকালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছিদ্দিক হোসেনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক ডা. সোহেল মাহমুদ জানান, গুলিতেই নিহত হয়েছেন ছিদ্দিক হোসেন।

তিনি জানান, ছিদ্দিক হোসেনকে দুটি গুলি করা হয়েছিল। একটি গুলি তার বাম হাতে লেগে বুকের ডান পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আরেকটি গুলি বুকের বাম পাশ দিয়ে ঢুকে ডান পাশে গিয়ে আটকে ছিল, যা বের করা হয়। ময়নাতদন্ত শেষে বিকালে নিহতের লাশ স্বজনরা বাড়িতে নিয়ে গেছেন।

সরেজমিন দেখা গেছে, বনানীর জনশক্তিপাড়াখ্যাত ওই ভবনে ঢুকতে হয় একটি বড় স্টিলের গেট দিয়ে। ঘটনার সময় গেটের সামনেই দাঁড়ানো ছিলেন দারোয়ান বাজী। এর পর ৮-১০ ফুট খোলা জায়গা/গাড়ি পার্কিংয়ের পর মাঝপথ হয়ে উপরে উঠে গেছে সিঁড়ি। নিচতলার বাম পাশে ছিল ছিদ্দিক হোসেনের অফিস। একটি লোহার গেট দিয়ে অফিসের শুরু। ওই ভবন ও পার্শ্ববর্তী ভবনের মালিক মুসা গ্রুপ। এ গ্রুপও জনশক্তি রপ্তানি করে।

মুসা গ্রুপের জনশক্তি প্রতিষ্ঠান মুসা ওভারসিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসাদ আল গালিব বলেন, সাড়ে তিন বছর আগে পাশের ভবনে ভাড়া নিয়ে অফিস স্থাপন করেন ছিদ্দিক হোসেন। এর আগে ৮ বছরের মতো ছিলেন কাছের আরেকটি অফিসে। তার সঙ্গে কারো বড় ধরনের ঝামেলা আছে বলে জানা ছিল না গালিবের।

জানা গেছে, দুই দশক ধরে ছিদ্দিক হোসেন জনশক্তি রপ্তানি করছেন। তার প্রতিষ্ঠান মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি করে। বনানীর অফিসটি রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকে। ওই সময় ধরে নিয়মিত অফিস করতেন। স্ত্রী জ্যোৎস্না বেগম ছাড়াও দুই মেয়ে সাবরিনা সুলতানা, সাবিহা ছিদ্দিক ও এক ছেলে মেহেদী হাসানকে নিয়ে তিনি উত্তরার চার নম্বর সেক্টরে বসবাস করতেন। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি সাবরিনা সুলতানার স্বামী আবু হানিফও দেখাশোনা করতেন। মঙ্গলবার বিকালে অফিস থেকে বেরিয়ে টাঙ্গাইলের বাড়িতে যান আবু হানিফ। আবু হানিফ বলেন, হত্যা করতে পারে এমন কোনো শত্রু তার শ্বশুরের ছিল না। সূত্র: আমাদের সময়

পিএনএস/কামাল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন