সম্ভ্রম বাঁচাতে আমি কেঁদেছি, ওরা হেসেছে

  13-12-2017 01:45PM

পিএনএস ডেস্ক:প্রতি কক্ষে একজন করে নারী। সবাই স্বল্পবসনা। সবসময় সুন্দর, পরিপাটি থাকতে হয় তাদের। চার তলা বাড়ির ফ্ল্যাটের ভেতরেই রয়েছে পার্লার। যাবতীয় সাজগোজ করতে হয় সেখানেই। ফ্ল্যাটের সামনে সার্বক্ষণিক থাকে একজন প্রহরী।

প্রতি সপ্তাহে এই বাসার নারীদের স্থানান্তর করা হয়। নতুন নারীদের এনে রাখা হয় এখানে। দিনে-রাতে পুরুষদের আনা-গোনাতো আছেই। ফ্ল্যাটের একটি কক্ষ টর্চার সেল হিসেবে পরিচিত। কেউ কথার অবাধ্য হলেই তার ওপর নেমে আসে নির্যাতন। খাওয়া বন্ধ। কথায় কথায় মারধর। এমনকি ইলেকট্রিকের শকও দেয়া হয়। এভাবেই বাধ্য করা হয় অনৈতিক কাজে। ভারতের হায়দারাবাদের এই ফ্ল্যাটে রয়েছে অনেক বাঙালি ও রোহিঙ্গা তরুণী। চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য দিয়েছেন এই ফ্ল্যাটেই দীর্ঘদিন নির্যাতিত ত্রিশোর্ধ্ব বছর বয়সী এক নারী। মিথ্যা প্রলোভন দিয়ে সীমান্ত পার করে ওপারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো তাকে। অনৈতিক কাজ করতে না চাইলে তাকে বেদম প্রহার করা হতো। এক পর্যায়ে গণধর্ষণ করা হয় তাকে। অমানবিক-নির্মম এসব বিষয়ে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি।

পিরোজপুর জেলার এই নারী থাকতেন ঢাকার পশ্চিম মাতুয়াইলে। স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের পর দু্‌ই সন্তান নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের এই নারী। চাকরি খুঁজছিলেন। চাকরি খুঁজতে গিয়েই কবির নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয়। কবিরের পুরো নাম মিরাজ হোসেন কবির। কবির তাকে চাকরি দেবে বলে আশ্বস্ত করে। বেতন মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার। থাকা-খাওয়া কর্তৃপক্ষের। কবিরের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত লুচি ওরফে আঁখি এবং শামীমও তাকে একইভাবে আশ্বাস দেয়। সহজেই আকৃষ্ট হয় ওই নারী। চাকরি হবে ভারতের একটি ক্লিনিকে। সেখানে প্রায়ই যাওয়া-আসা করে কবির। সন্তানদের গ্রামের বাড়িতে মায়ের কাছে রেখে গত ১৪ই আগস্ট রাতে কবিরের সঙ্গে যাত্রা করেন তিনি। ঢাকা থেকে বাসযোগে বেনাপোল। পরে সাতক্ষীরা। সেখানে সীমান্ত এলাকায় সুমন নামে এক ব্যক্তির বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। ওই বাড়িতে মিলিত হয় আরেক নারী। তাকেও চাকরি দেবে বলে ভারতে নিয়ে যাচ্ছিলো কবির। দুই নারীর মধ্যেই স্বপ্ন খেলা করছিলো, চাকরি হবে। পরিবারে সুখ-স্বস্তি আসবে। সন্তানরা সুখে থাকবে। গভীর রাতে দালালের মাধ্যমে সীমান্ত পাড়ি দিতে প্রস্তুত হয় কবিরসহ দুই নারী।

সাতক্ষীরার ভোমরা সীমান্ত দিয়ে হেঁটে বন-জঙ্গল পার হয়ে ভারত। ভারতের চাঁদপাড়ার একটি ঝুপড়ি ঘরে রাত কাটে তাদের। সেদিন ছিলো ১৫ই আগস্ট। ভারতের স্বাধীনতা দিবস। সর্বত্র কড়াকড়ি। বাধ্য হয়েই সেখানে আরো দু’রাত কাটাতে হয় তাদের। তারপর চাঁদপাড়া থেকে ট্রেনে শিয়ালদহ হয়ে কলকাতার হাওড়া। হাওড়াতে ট্রেন মিস করে তারা। ওই সময়ে সন্দেহমূলক অবস্থানের কারণে ওই দুই নারীকে আটক করে পুলিশ। কিন্তু কবিবের তদবিরে কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দেয়া হয় তাদের। ট্রেনযোগে হাওড়া থেকে হায়দারাবাদ। নেরেডমিটের শ্রী কলোনির ১৩৫ নম্বর বাড়ি। সঞ্জুর ঘর হিসেবেই পরিচিত। দালালদের হোতাদের একজন সঞ্জু। ওই বাড়ির ফ্ল্যাটে আনার পর দীর্ঘ বিশ্রাম। তারপর গোসল শেষে শুরু হয় রূপসজ্জা। চুল থেকে পা। প্রসাধনীর সঙ্গে পরিচর্চা। ততক্ষণে কবির ফিরে তার আসল চরিত্রে। অবাক-বিস্ময়ে তা দেখে ঢাকা থেকে পাচার হওয়া এই নারী। নতুন নাম দেয়া হয় নারীর। পূজা। পূজাকে ওয়েস্টার্ন পোশাক পরতে দেয়া হয়। মনোরঞ্জনের জন্য তৈরি হতে বলা হয় তাকে। পূজা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। কিছুতেই ওই পথে পা দেবে না। এ নিয়ে বাকবিতণ্ডা হয়।

পূজা জানায়, কবির তাকে বলেছিলো- ‘এই কাজে টাকা বেশি পাবি। টাকা রুজি করতে আসছিস। কি করে টাকা রুজি করলি তা কেউ দেখবে না। কাজ কর।’ এভাবেই পূজাকে রাজি করানোর চেষ্টা করা হয়। এক পর্যায়ে টর্চার সেলে নিয়ে মারধর করা হয় তাকে। রাজি না হলে মেরে বস্তায় ফেলে দেয়া হবে বলে হুমকি দেয় সঞ্জু। ওই রাতেই পরপর সাত যুবক তাকে ধর্ষণ করে।

পূজা বলেন, ‘প্রতি রাতেই মাতালরা আমাকে নিয়ে খেলা করতো। শরীরে মদ ঢেলে দিতো। নাচতে বলতো। রক্ষা পেতে চিৎকার করেছি। কান্না করেছি। ওরা শুধু হেসেছে। পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিলো না। বাইরে সবসময় প্রহরী থাকতো।’

খদ্দেরদের মনোরঞ্জনের জন্য পূজাকে সেখানে নাচ শেখানো হয়। দিনে-রাতে চলতো নির্যাতন। সেই সঙ্গে মাতাল খদ্দেরদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায়ের জন্য নাচতে হতো। নাচতে না চাইলে বা খদ্দেররা কোনো অভিযোগ দিলে মারধর করতো সঞ্জু। প্রায় সময়ই সিঁদুর, শাঁখা পরে থাকতে হতো তাকে।

এ বিষয়ে পূজা জানান, সেখানে বাঙালি হিন্দু মেয়েদের চাহিদা বেশি। শ্রী কলোনির ওই বাড়িতে পূজাসহ আরো অনেক মেয়ে ছিলো। প্রতি সপ্তাহে ওই বাড়িতে নতুন মুখ আনা হতো। এক সপ্তাহ পর তাদের অন্যত্র পাঠানো হতো। এই চক্রের হোতাদের মধ্যে রয়েছে রঞ্জিত, বাপ্পি, সুনীল, গণেশ, সুমন, রবিনসহ আরো অনেকে। ভারতের হায়দারাবাদ, কলকাতা, দিল্লি, চেন্নাই, মুম্বইতে রয়েছে তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক। বাংলাদেশের ঢাকা ও চট্টগ্রামে রয়েছে কবিরের মতো তাদের দালাল চক্র। মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের ভারতে নিয়ে যায় তারা। বিনিময়ে চক্রের হোতাদের কাছ থেকে আদায় করে লাখ লাখ টাকা।

পূজা জানান, অন্যদের বাইরে পাঠানো হলেও তাকে বাসার বাইরে কোথাও পাঠানো হতো না। কারণ তাদের ধারণা ছিলো পূজা যে কোনো সময় পালাতে পারে। একই কারণে তার শরীর বিক্রি করে আয় করা টাকার ভাগও তাকে দেয়া হতো না। পূজা জানান, একপর্যায়ে অভিনয় করে তাদের আস্থা অর্জন করেন। তখন তাকে কিছু টাকাও দেয়া হয়। পাহারা কমানো হয়। ওই সময়ে একজন খদ্দের পান যার বাড়ি বেনাপোলে। লিটন নামের ওই ব্যক্তি ভারত থেকে প্রায়ই পণ্য আমদানি করেন। তাকে অনুরোধ করেন দেশে নিয়ে যেতে। অতঃপর লিটনের সহযোগিতায় গত ২৭শে নভেম্বর ওই বাসা থেকে বের হন।

পূজা বলেন, ‘লিটন বলেছিলো তরে আমি বেনাপোল পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারবো। তারপর হের লগে আমি পলাইয়া আসছি।’

লিটনের পাসপোর্ট দেখিয়েই ট্রেনের টিকিট নেয়া হয়। আবার ভারতের ২৪ পরগনার চাঁদপাড়া সীমান্ত। সন্ধ্যা থেকে প্রায় তিন ঘণ্টা ফসলি জমিতে লুকিয়ে থাকতে হয়েছে। দালালের মাধ্যমে রাত ১০টায় নৌকায় চড়েন। তারপর জঙ্গল দিয়ে হাঁটতে হয়েছে কিছু সময়। আবার রাতের অন্ধকারে বরফের মতো ঠাণ্ডা পানিতে নামতে হয়েছে।

ছদ্মনামধারী পূজা জানান, গলাসম পরিমাণ পানি দিয়ে সীমান্ত পার হতে হয়েছে। সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন সাতক্ষীরার একটি বাড়িতে। খবর পেয়ে সেখান থেকে পূজাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন মানবাধিকারকর্মী আলমগীর সেলিম। হিউম্যান রিসোর্স অ্যান্ড হেল্‌থ ফাউন্ডেশনের এই কর্মী বলেন, এই মেয়েকে যারা পাচার করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। এই মেয়ের মতো অনেকে ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়ে, বাসায় বন্দি জীবনযাপন করছে। তাদের উদ্ধার করা উচিত। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

সূত্র: মানবজমিন।

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন