ইয়াবার বিষাক্ত ছোবলে নীল হয়ে আসছে যুব সমাজ

  24-03-2018 05:44PM

পিএনএস, নওগাঁ প্রতিনিধি : ইয়াবা থাই শব্দ হলেও মাদকাসক্তদের কাছে এটি ইয়াবা নামেই বেশি পরিচিত। তরুণ-তরুণীরা একে বলেন, ‘ক্রেজি মেডিসিন', ‘হিটলার চকলেট'আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এর লেনদেন হয় ‘বাবা' নামে। ইয়াবার বিষাক্ত ছোবলের বিষে নীল হয়ে আসছে যুব সমাজ। শহরের অলি-গলি থেকে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার গ্রাম-গঞ্জেও পৌছে গেছে সর্বনাশা ইয়াবা। এর ভয়াল থাবায় ল-ভ- হচ্ছে নিম্ন ও উচ্চবিত্ত পরিবার। এক শ্রেণির মাদক ব্যবসায়ী অধিক মুনাফার লোভে সমাজকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইয়াবা নামের মাদকের দখলে ও ছোঁবলে ধ্বংস হচ্ছে মহাদেবপুরের যুব সমাজ। যুব সমাজ থেকে শুরু করে প্রায় সব শ্রেণির মানুষ এখন ইয়াবার ছোবলে বিষাক্ত। সর্বনাশা এই মাদকের মরণ বিষবাষ্পে যুব সমাজ শুধু মেধাশূন্য হচ্ছে তা নয়, মাদকাসক্তদের মনুষ্যত্ব, বিবেক ও বুদ্ধি লোপ পাচ্ছে। তারই প্রতিফলন তাদের আচরণে উচ্ছৃঙ্খলতা, অনিয়ন্ত্রিত জীবন-যাপন, অভিভাবকদের অবাধ্যতা সর্বোপরি অনৈতিক কাজে জড়িত হয়ে পড়ছে তারা। যুব-তরুন ও ছাত্র সমাজের এক বিশাল অংশ ইয়াবায় আসক্ত । স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, চিকিৎসকও রয়েছে তালিকায়।

ইয়াবা নামের মাদক ট্যাবলেট কিনে অবাধে সেবন করছে মাদক সেবীরা। দাম বাড়তে পারে মনে করে সেবীরা বেশি করে কিনে স্টক রাখছে, যার কারনে এর চাহিদা বেড়ে অনেক ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে বলে একটি বিশেষ সূত্রে জানা গেছে। মাদকাসক্ত পরিবারে অশান্তি বাড়ছে বলে একাধিক ভুক্তভোগি পরিবার জানিয়েছে। অন্যান্য মাদকের চাইতে ইয়াবা বহন সহজ হওয়ায় ধর পাকড়ের ঝুঁকি কম, ফলে এ পেশায় ঝুকে পড়ছে অনেকেই। অল্প দিনেই অবৈধ পথে আসা মাদক ‘ইয়াবা’ যুব সমাজের মন কেড়েছে। তাই নেশায় আসক্ত যুবকরা জন্মদাতা পিতাকে বাবা বলতে ইতঃস্তত বোধ করলেও ইয়াবা ট্যাবলেটকে আদর করে ‘বাবা’ বলেই ডাকে বলে অনেকেই জানিয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন এলাকার যুব সমাজ মনের অজান্তেই নিজেকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। সেই সাথে নেশার টাকা যোগাতে সর্বশান্ত করছে পরিবারকে। চুরি হচ্ছে পিতার পকেটের টাকা, বাড়ছে পারিবারিক দ্বন্দ ও অশান্তি। ওই মাদকাসক্তরা দিনে একটি করে ‘বাবা' (ইয়াবা) নেশা ব্যবহার শুরু করে অল্পদিনের ব্যবধানে দিনে ৫-৬টি করে কিনে খেতে হচ্ছে বলে গোপন সূত্রে জানা গেছে। প্রতিটির ট্যাবলেটের দাম কমপক্ষে ১'শ ৩০ টাকা বলেও জানা গেছে। ওই টাকা যোগাতে অনেক সময় মাদকাসক্তের হাতে পরিবারের অনেকেই লাঞ্চিত হচ্ছে। অনেকেই নিজ ঘরের ও পরিবারের শখের জিনিস বিক্রি করে নেশার টাকা যোগাচ্ছে বলে ভুক্তভোগি পরিবারের লোকজন জানিয়েছে। মাদকাসক্ত পুত্রের অত্যাচারে অশান্তিতে থাকা পরিবারের লোকজন নিরুপায় হয়ে আদরের সন্তানকে পুলিশ দিয়ে আটক করে মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে রেখে দিচ্ছে। এমন ঘটনা উপজেলার বিভিন্ন স্থানে অহরহ ঘটে চলছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাময়িক আনন্দ আর উত্তেজনার জন্য ইয়াবা সেবন করছে তরুণ-তরুণীরা। এটি সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনা তৈরি করে সাময়িক হলেও ভুলিয়ে দেয় জীবনের সব যন্ত্রণা, আসক্তরা বাস করতে থাকে স্বপ্নের জগতে। দীর্ঘদিন আসক্তির ফলে শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, মেজাজ হয় খিটখিটে, বাড়ে নাড়ির গতি, রক্তচাপ, হেপাটাইটিস বি, সি ও এইডসের মতো জীবাণু দ্বারা সংক্রামিত হয়ে শরীরের স্বাভাবিক কার্যক্রমের ব্যত্যয় ঘটিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ইয়াবা সেবনকারীদের এক ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্ভরশীলতা তৈরি করে। আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে ইয়াবা সেবনের পরিমাণ। এই ট্যাবলেট সাময়িক আনন্দ ও উত্তেজনা তৈরি করলেও পরবর্তীতে আসক্ত ব্যক্তি নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। পরিকল্পিতভাবে দেশের মেধাবী প্রজন্ম ধ্বংস করতেই ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে ইয়াবা। পরিবার উদ্যোগী হলে এবং সঠিক কাউন্সিলিং ও চিকিৎসা করা গেলে আসক্ত ব্যক্তিকে নেশা থেকে ফেরানো সম্ভব। ইয়াবা তৈরির মূল উপাদান মেথঅ্যামফিটামিন। এক সময় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এটি সর্দি ও নাক বন্ধ হয়ে যাওয়ার এবং ওজন কমানোর চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো ইয়াবা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ক্লান্তি দূর করতে হিটলার চকলেট নামে সেনাদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় ছিল এই মেথঅ্যামফিটামিন। পরবর্তীতে দীর্ঘযাত্রার গাড়িচালক ও দৌড়বিদরা এটির ব্যবহার শুরু করেন। ধীরে ধীরে এর কুফল ও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া উদঘাটিত হওয়ায় বিশ্বব্যাপী এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। তারপর বিশ্বের কয়েকটি দেশে এর উৎপাদন চলতে থাকে। মেথঅ্যামফিটামিনের সঙ্গে ক্যাফেইন মিশিয়ে ব্যবহৃত হতে থাকে মাদকদ্রব্য হিসেবে। থাইল্যান্ড ও মিয়ানমারে এর উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। শুধু বাংলাদেশকে টার্গেট করেই ইয়াবা তৈরি করছে মিয়ানমার। ১৯৯৮ সালের দিকে দেশে আসতে শুরু করে ইয়াবা। প্রথমে উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে-মেয়েদের টার্গেট করে ছড়িয়ে দেয়া হয় এই মরণ নেশা। পরবর্তীতে নকল ইয়াবা তৈরি করে দাম কমিয়ে উচ্চবিত্তের গন্ডি ছাড়িয়ে মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও ইয়াবার বিস্তার ঘটে। গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, প্যাথেডিনের পথ ধরে এখন এটি সহজলভ্য। তরুণ-তরুণীদের মাঝে ইয়াবাকে আকর্ষণীয় করতে মূল উপাদানের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে আঙ্গুর, কমলা ও ভ্যানিলার ফ্লেভার। লাল, কমলা রংয়ের এ ট্যাবলেটটি দেখতে ও খেতে অনেকটা ক্যান্ডির মতো। এটি পরিবহন ও লুকিয়ে রাখাও সহজ। ইয়াবা সেবনে ক্ষুধা কমে যায় বলে বেশিরভাগ তরুণী এটি সেবন করেন স্লিম হওয়ার ওষুধ হিসেবে। তরুণ-তরুণীরা এর ক্ষতিকর প্রভাব বুঝে ওঠার আগেই আসক্ত হয়ে পড়ে।

বিশেষজ্ঞদের মতে ইয়াবা সেবনের ক্ষতি, প্রথমে কম ডোজে এ ট্যাবলেট কাজ করলেও ধীরে ধীরে ডোজ বাড়াতে হয়। শুরুতে যে পরিমাণ আনন্দ এনে দেয়, পরে তা আর দেয় না। বাড়তে থাকে ট্যাবলেটের পরিমাণ, ক্ষণস্থায়ী আনন্দের পর বাড়তে থাকে ক্ষতিকর নানা উপসর্গ। ইয়াবার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এতটাই ভয়ঙ্কর যে টানা ৭-১০ দিনও জেগে থাকতে বাধ্য হয় সেবনকারীরা। এক সময় শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়তে থাকে, মেজাজ হয় খিটখিটে, গলা-মুখ শুকিয়ে আসতে থাকে অনবরত। প্রচন্ড ঘাম আর গরমের অসহ্য অনুভূতি বাড়তে থাকে। বাড়ে নাড়ির গতি, রক্তচাপ, দেহের তাপমাত্রা আর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি। দীর্ঘদিনের আসক্ত ব্যক্তিরা উচ্চ রক্তচাপে ভোগেন। ইয়াবা সেবনের কারণে মস্তিষ্কের ভেতরকার ছোট রক্তনালিগুলো ক্ষয় হতে থাকে, এগুলো ছিঁড়ে অনেকের রক্তক্ষরণ হয়। স্মৃতিশক্তি কমে যায়, মানসিক নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। সব ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বা পিছিয়ে পড়তে থাকায় আসক্ত ব্যক্তিরা বিষ্ণণতায় আক্রান্ত হয়। কারও মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়। একসময় সিজোফ্রেনিয়ার মতো জটিল মানসিক ব্যাধিও দেখা দেয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইয়াবা আসক্তরা জানান, শুরুতে আনন্দের সাথে বন্ধু বান্ধবের পাল্লায় পড়ে নেশা শুরু হয়। ওই মরন নেশা ব্যবহারে প্রথমে মন ও শরীর দুটোই ভালো থাকে। রাতে ঘুম বলে কি জিনিস তা তারা বুঝতে পারেনা। সারা রাত জেগে থাকতে কোন ক্লান্তি হয়না। ২-৩ সপ্তাহ একাধারে সেবনের পর একটি ট্যাবলেট খেয়ে আর ভালো লাগেনা, তখন দিনে দুটি খেতে হয়। ৩-৬ মাস নেশার বয়স হলে, দিনে ৫-৮টি ট্যাবলেট লাগে। আসক্তরা আরো জানায়, ওই ট্যাবলেট প্রতিদিন কিনে খেতে না পারলে কিছুই ভাল লাগেনা, শরীরে ব্যাথা অনুভব হয়। মনে হয় দুনিয়াটা অন্ধকার। খেলেই মনে অনেক শান্তি, কমে যায় সব ক্লান্তি। তাই ইয়াবাকে ভালোবেসে আসক্তরা বাবা বলেই ডাকে।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন