যৌন নিপীড়নের ভয়ংকর বর্ণনা দিলেন আফসান চৌধুরী

  19-04-2019 12:19PM

পিএনএস ডেস্ক: বাংলাদেশে শিশুরা নিজেদের বাড়িতে বা পারিবারিক পরিমন্ডলে যে ধরণের যৌন নিপীড়নের শিকার হয়, তার খুব কম ঘটনাই প্রকাশ পায়। বিশেষ করে ছেলেরাও যে শৈশবে পরিচিতজনদের যৌন নিপীড়নের শিকার হন, সেটা স্বীকারই করা হয় না। সুপরিচিত লেখক, গবেষক এবং সাংবাদিক আফসান চৌধুরী বাংলাদেশে শিশুদের ওপর এই যৌন নিপীড়নের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে একসময় কাজ করেছেন ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ নামের একটি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। কিন্তু এই কাজ করতে গিয়ে শৈশবে তিনি নিজেও যে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন, সেই বেদনাদায়ক স্মৃতি ফিরে এসেছিল।

বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এই প্রথম তিনি সেই ঘটনার কথা সবিস্তারে প্রকাশ করেছেনঃ

১৯৯৮ সালের দিকে আমরা কাজ করছিলাম শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়নের বিষয়ে। ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ নামের সংগঠনের একটি রিপোর্টের জন্য আমরা একটা কোয়ালিটেটিভ রিসার্চ করছিলাম। এই কাজ করতে গিয়ে অনেক ধরণের অভিজ্ঞতার কথা আমাদের শুনতে হচ্ছিল।

কাজটা করতে করতে হঠাৎ একদিন আমার স্মৃতিতে ফিরে এলো শৈশবে নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এক ঘটনার কথা।

আমার তখন তিন কি চার বছর বয়স, আমরা তখন টিকাটুলিতে থাকতাম। আমাদের বাসায় গ্রাম থেকে আসা একটা লোক ছিল।

এই লোকটি একদিন আমাকে তার যৌনাঙ্গ নিয়ে খেলাচ্ছিল। আমার তখন যে বয়স, তখন কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। লোকটা আমার সঙ্গে পায়ুমৈথুন করছিল না। সে আমাকে তার যৌনাঙ্গ নিয়ে খেলাচ্ছিল। আমার কোন আবেগ, অভিজ্ঞতা বা কষ্ট কিছুই হচ্ছিল না, আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।

আমার কপালটা ভালো। এরকম অবস্থায় আমার মা ব্যাপারটা দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কী ঘটনা ঘটছে।

ওই লোকটা বয়স্ক ছিল। আমার মা তখন এসে আমাকে নিয়ে যায়। ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে আমার দুটি জিনিস মনে আছে।

আমার মা আমাকে নিয়ে গিয়ে গোসল করাচ্ছিলেন। আমার মাকে আমি জিজ্ঞেস করছিলাম, আমি কি খারাপ কিছু করেছি। সন্ধ্যেবেলায় তো মানুষকে আর গোসল করায় না কেউ। আমার মা কোন উত্তর দিচ্ছিলেন না। বলছিলেন, ঠিক আছে, ঠিক আছে।

আর আমার মনে আছে আমার বাবা ওই লোকটাকে কান ধরে উঠবস করিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন।

এই ঘটনার স্মৃতি আমার একদম মুছে গিয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৮ সালে এটা আমার মনে পড়ে গেল ব্রেকিং দ্য সাইলেন্সের জরিপ করতে গিয়ে। ১৯৯৮ সালে তো আমার অনেক বয়স। কিন্তু তারপরও আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল। আমার প্রচন্ড অপরাধবোধ হচ্ছিল। আমি খুব আশ্চর্য হচ্ছিলাম। আমার কেন অপরাধবোধ হচ্ছে। আমার কেন মনে হচ্ছে ওই ঘটনার জন্য আমিই দায়ী। আমার তো তখন তিন-চার বছর বয়স।

পরবর্তীকালে আমি যখন মনস্তত্ত্ববিদদের সাথে কথা বলেছি, তারা আমাকে বলেছিলেন, এরকমই হয়। নিজেকে অপরাধী মনে হয়, নিজেকে দোষী মনে হয়।

তবে আমি যেটা করেছি, এই ঘটনার কথা মনে পড়ে যাওয়ার পর এটা কখনো চেপে রাখিনি। আমি যেহেতু শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়নের ইস্যুতে কাজ করতাম, নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার কথা সেখানে আমি সবাইকে বলতাম এটা বোঝাতে যে, এটা যে কোন মানুষের জীবনেই ঘটতে পারে।

বাংলাদেশে শিশুরা যে কতটা অনিরাপদ, তাদের ওপর এরকম যৌন নিপীড়নের ঘটনা যে কত ব্যাপক, তা আমি জানতে পেরেছিলাম ১৯৯৮ সালে ওই গবেষণা চালানোর সময়।

একবার একটি এলাকায় গিয়ে আমরা একদল ছেলে-মেয়ের সাথে কথা বলছিলাম এ বিষয়ে। সেখানে একদল ছেলে-মেয়েকে আমি একটি করে কাগজ দিলাম। তাদেরকে বললাম, যারা যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তারা যেন কাগজে ক্রস চিহ্ন দিয়ে সেটি জমা দেয়। কাগজে কোন নাম লিখতে হবে না। তারা সবাই কাগজ জমা দেয়ার পর দেখলাম আট জনের মধ্যে ছয় জনের কাগজেই ক্রস চিহ্ন দেয়া। ওই গ্রুপে ছেলে মেয়ের সংখ্যা ছিল সমান সমান। কাজেই ধরে নিতে পারি ছেলে শিশুরাও বাংলাদেশে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। তবে এরকম নিপীড়নের কথা স্বীকার করা বাংলাদেশে সহজ নয়।

একবার একটি ছেলে আমাকে জানিয়েছিল, তাকে বয়স্ক লোকেরা পায়ুমৈথুন করেছিল। নিজের বাবা-মার কাছে সে একথা জানিয়েছিল। কিন্তু তার বাবা-মা বিষয়টা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল। তারা নাকি বলেছিল, বড় হতে হতে এরকম ঘটতে পারে। এ বিষয়টি অস্বীকার করার একটা প্রবণতা আমাদের সমাজে আছে।

বাংলাদেশে আসলে পরিবারের ভেতরেই শিশুরা সবচেয়ে অনিরাপদ। পরিবারের বাইরে এরকম ছেলে শিশু নির্যাতনের ঘটনা সবচেয়ে বেশি হয় মাদ্রাসায়। কারণ সেখানে শিশুদের হোস্টেলে রাখা হয়। আর অনেক শিক্ষকও থাকেন যারা পরিবার থেকে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন থাকেন।

যৌন নির্যাতন শুধু মাদ্রাসার শিক্ষকরা করেন না, সাধারণ স্কুলের শিক্ষকরাও করেন। আর শহরে সবচেয়ে বেশি যেটা হয়, সেটা হাউজ টিউটরদের হাতে।

আমরা চরাঞ্চলে গিয়ে দেখেছি, সেখানে রাখাল বালকরা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। আমরা একটা কেস স্টাডি পেয়েছিলাম, যেখানে প্রতিটি রাখাল বালকই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও শিশুদের ওপর প্রচুর যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। শিশুদের ওপর এরকম ঘটনা ঘটতে পারে যে কোন দেশেই, কিন্তু এটা যে একটা সমস্যা সেটা আগে স্বীকার করতে হবে। আর তারপর ভাবতে হবে কিভাবে আমরা শিশুদের নিরাপদ রাখতে পারি। সূত্র - বিবিসি

পিএনএস/আনোয়ার


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন