ঝিমিয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক

  17-11-2016 02:04AM

পিএনএস : বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রমে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তৈরি হচ্ছে না অনেক মাসিক ও প্রান্তিক প্রতিবেদন। অলস অবস্থায় আছে অধিকাংশ পুনঃঅর্থায়ন তহবিল। কর্মকর্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে পারস্পরিক আস্থাহীনতা। এককথায় রিজার্ভ চুরির পর ঝিমিয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

গত ফেব্রুয়ারিতে রিজার্ভ থেকে অর্থ চুরির ঘটনায় গভর্নরকে পদত্যাগে বাধ্য করা, দুই ডেপুটি গভর্নরকে বরখাস্ত করা এবং দীর্ঘদিন পদ দুটি শূন্য থাকা, কর্মকর্তাদের ইনসেনটিভ বোনাস (উৎসাহ ভাতা) কমিয়ে দেওয়াসহ নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেরি করে আসায় এ অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে।

চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে পরিচালিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ লেনদেনকারী হিসাব থেকে ৭০টি ভুয়া পেমেন্ট ইনস্ট্রাকশন (পিআই)-এর মাধ্যমে ১ হাজার ৯২৬ মিলিয়ন ডলার হ্যাকিং এর মাধ্যমে অবৈধভাবে স্থানান্তরের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়। এরমধ্যে ১টি পিআই এর বিপরীতে শ্রীলঙ্কায় ২০ মিলিয়ন ডলার এবং ৪টি পিআই’র বিপরীতে ৮১ মিলিয়ন ডলার ফিলিপাইনের একটি ব্যাংকের চারজন গ্রাহকের হিসাবে পাঠানো হয়।

রিজার্ভ চুরির এ ঘটনার জেরে গত ১৫ মার্চ গভর্নরের পদ থেকে ড. আতিউর রহমানকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে সরকার। বহিষ্কার করা হয় ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম ও নাজনীন সুলতানাকে। এরপর নতুন গভর্নর হিসেবে সাবেক আমলা ফজলে কবিরকে নিয়োগ দেওয়া হলেও খালি পড়ে রয়েছে দুই ডেপুটি গভর্নরের পদ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, ড. আতিউর রহমান গভর্নর থাকা অবস্থায় কর্মকর্তাদের সব সময় কাজের ওপর রাখতেন। নিয়মিত বিভিন্ন বিভাগের কাজের খোঁজখবর নিতেন। কর্মকর্তাদের নিত্য নতুন পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত করতেন। কিন্তু ফজলে কবির গভর্নর হয়ে আসার পর থেকেই নতুন নতুন পরিকল্পনায় ভাটা পড়েছে। গদবাধা কর্যক্রমের মধ্য দিয়েই চলছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কাজের জন্য কর্মকর্তাদের ওপর কোন প্রকার চাপ না থাকায়, অনেকটা ইচ্ছামাফিক কাজ করছেন তারা।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক মহাব্যবস্থাপক বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক আর আগের অবস্থানে নেই। ড. আতিউর রহমান কর্মকর্তাদের সব সময় কাজের ওপর রাখতেন। এখন আর তা নেই। কার্যক্রমে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

গত ১৫ মার্চ খালি হওয়া ডেপুটি গভর্নর’র দুটি পদ এখনো পূরণ হয়নি। তবে মঙ্গলবার (১৫ নভেম্বর) অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এস এম মনিরুজ্জামানকে ডেপুটি গভর্নর হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে দুই ডেপুটি গভর্নরের পদ খালি পড়ে থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজে এক ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে নতুন কাজের নির্দেশনা আসছে দেরি করে। পাশাপাশি রিজার্ভ চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে কর্মকর্তাদের মধ্যে পারস্পরিক আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে।

সূত্র জানায়, রিজার্ভ চুরির সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা জড়িত বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এমন খবর শোনা যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এমন ইঙ্গিত দিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এতে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাদের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও আস্থাহীনতা প্রকট আকার ধারণ করেছে।

পরস্পরের প্রতি আস্থাহীনতা এতোটাই প্রকট হয়েছে অভ্যন্তরীণ সমন্বয়ের মাধ্যমে একজনের অনুপস্থিতিতে তার কাজ আর একজন করতে সহসা রাজি হচ্ছে না। আর রিজার্ভ চুরির ঘটনাস্থল অ্যাকাউন্স অ্যান্ড বাজেটিং বিভাগের ডিলিং রুমে এখন কেউ কাজ করতে চাচ্ছেন না। ফরেক্স রিজার্ভ ও ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট বিভাগেও চলছে একই অবস্থা।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের চালু করা অধিকাংশ পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। পুনঃঅর্থায়ন সুবিধা চেয়ে করা একাধিক আবেদন ৬ মাসের অধিক সময় ধরে সংশ্লিষ্ট দফতরে ফাইলের স্তুপ আকারে পড়ে রয়েছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, ড. আতিউর রহমানকে যেভাবে গভর্নরের পদ থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে, তা কোনভাবেই কাম্য নয়। একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানকে তার দায়িত্ব থেকে এভাবে সরিয়ে দিলে, সেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়ানো খুবই কঠিন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির যে ঘটনা ঘটেছে তার জন্য পদত্যাগ করতে হলে আগে অর্থমন্ত্রীর করা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা দেখলাম অর্থমন্ত্রী তার দায়িত্বে থাকলেন আর গভর্নরকে পদত্যাগে বাধ্য করা হলো। একটি নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রধানকে জোরজবরদস্তি করে পদত্যাগে বাধ্য করা হলে, সেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক।

পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন