এক দশকে পাচার ৪ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা

  10-12-2016 10:48AM


পিএনএস ডেস্ক: কোনোভাবেই থামছে না অর্থ পাচার। বিনিয়োগের পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকা ও অর্থের নিরাপত্তাহীনতায় দেশ থেকে বিপুল অংকের টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া পাচারের দায় সরকারও এড়াতে পারবে না। কেননা সরকারের ভুল পলিসির কারণে দিনকে দিন পাচার বাড়ছে। এমনটি মনে করেন দেশের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের অনেকে।

এদিকে শুক্রবার আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসের এক আলোচনা সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন জানিয়েছেন, ২০০৪ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে ৫৬ দশমিক ৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা প্রায় ৪ লাখ ৫৫ হাজার ২০০ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ৮০ টাকা হিসাবে) পাচার হয়েছে। এর মধ্যে শুধু ২০১৩ সালেই পাচার হয় ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার বা ৭৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। উদ্বেগের সঙ্গে এমন তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, এ অর্থ পাচার রোধই দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা অডিটোরিয়ামে দুদক আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দেশে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের বিষয়টি আবারও নতুন করে আলোচনায় উঠে এসেছে।

জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘দেশের ভেতরে বিনিয়োগ সুযোগের স্বল্পতা ও আর্থিক নিরাপত্তা বোধের অভাবে অর্থ পাচার রোধ করা যাচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাও এ জন্য দায়ী।

অর্থ পাচার বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছে বলেই দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। সুইস ব্যাংক বা মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোমের নামে অর্থ পাচারের দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।’

বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, টাকা পাচার রোধ করতে হলে সবার আগে দেশে অবাধ বিনিয়োগের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। বিশেষ করে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে শর্তহীনভাবে বিনিয়োগ উন্মুক্ত করে দিতে হবে। তা না হলে টাকা পাচার বন্ধ হবে না। আর এভাবে টাকা পাচার অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতি পঙ্গু হতে বেশি দিন লাগবে না। তারা বলেন, এ রকম নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে এক শ্রেণীর লোক বাধ্য হয়ে দেশের টাকা বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ আছেন দেশপ্রেমের কারণে নানা রকম ঝুঁকি নিয়েও দেশে শিল্প খাতে বিনিয়োগ করার চেষ্টা করছেন। তবে এমন সংখ্যা খুবই কম। এ ছাড়া তারা মনে করেন, পাচার করা অর্থ মানেই সব দুর্নীতির টাকা নয়। এটা নিছক ভুল ধারণা। বিনিয়োগের অবাধ সুযোগ না থাকায় অনেকে বৈধ টাকাও বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ি, ফ্ল্যাট কেনা ছাড়াও কেউ কেউ সেখানে ব্যবসাও করছেন। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় সেকেন্ডহোমসহ কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে বিনিয়োগ করে নাগরিকত্বের সুযোগ নেয়ার প্রলোভনেও দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে।

বিশ্লেষকরা জানান, নানা পন্থায় দেশ থেকে প্রতিবছর বিশাল অংকের অর্থ পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিং সবচেয়ে বেশি দায়ী। হুন্ডিতেও যাচ্ছে বিপুল অংকের অর্থ। এ ছাড়া অনেক প্রভাবশালী ডলার করেও লাগেজে নিয়ে যাচ্ছে। এ জন্য নীতিমালা ও সুনির্দিষ্ট আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। এছাড়া আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামো আগের তুলনায় অনেক সক্রিয় হলেও সেই সুযোগও কাজে লাগানো হচ্ছে না। সর্বোপরি বিশাল অংকের এ অর্থ পাচারের দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারে না সরকার। এ জন্য রাজনৈতিক প্রত্যয়ের পাশাপাশি এনবিআর, দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিটের সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান শুক্রবার বলেন, ‘অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশে নীতিমালা ও আইনের ঘাটতি নেই। কিন্তু প্রয়োগে ঘাটতি আছে। জাতিসংঘের দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনে স্বাক্ষর করায় আমরা আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন করছি। এই কনভেনশনে বেশ কিছু ধারা যুক্ত আছে। ফলে এখন পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা যায়। এ ধারাগুলোর কারণেই বর্তমানে সুইস ব্যাংকগুলো শুধু তথ্য প্রকাশ করে থাকে, যা আগে করা হতো না। এ জন্য সরকারের উচিত যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়, সেসব দেশের সঙ্গে পারস্পরিক ‘আইনি সহায়তা চুক্তি’ করে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা।

তিনি বলেন, ‘টাকা পাচার রোধ করা দুদকের একার কাজ নয়। এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআরের পাশাপাশি অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘টাকা পাচার হয় মূলত আন্ডার ইনভয়েস ও ওভার ইনভয়েসের মাধ্যমে। মোট পাচারের ৬০-৬৩ শতাংশই হয় এভাবে। বাকি অর্থ হুন্ডি, ব্যাগে ভর্তি করে ও অন্যান্য মাধ্যমে পাচার করা হয়।’

এ প্রসঙ্গে দুদক কমিশনার ড. নাসিরউদ্দীন আহমেদ শুক্রবার দুর্নীতিবিরোধী দিবসের অনুষ্ঠানে বলেন, ‘আমাদের দেশে ট্রেড বেজড অর্থ পাচার বেশি ঘটে। তাই এ ক্ষেত্রে দুদক, এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংককে যৌথভাবে কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে ইউএনডিপির সহায়তা থাকলে সাফল্য অর্জন সহজ হবে।’

প্রসঙ্গত, ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য অনুযায়ী, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে অর্থ পাচার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে।

২০০৪ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে ২০১২ ও ২০১৩ সালে। এর মধ্যে ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার ও ২০১২ সালে ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এ ছাড়া ২০১১ সালে ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার,২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার, ২০০৯ সালে ৬১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার ও ২০০৪ সালে ৩৩৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার পাচার হয়েছে।

এদিকে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল ও নির্বাচনের প্রাক্কালে অর্থ পাচারের প্রবণতা বাড়তে দেখা যায়। ২০১৪ সালে ৯০০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। তিনি বলেন, এখনও যেখানে ১০০ কোটি ডলার বৈদেশিক সাহায্য আসে, সেখানে ৯০০ কোটি ডলার পাচার হওয়া অদ্ভুত ব্যাপার।

তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত যাদের নাম এসেছে তাদের তদন্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। অফশোর অ্যাকাউন্টগুলোর টাকা বৈধ না অবৈধ উপায়ে বিদেশে গেছে, সে বিষয়েও খোঁজখবর নিতে হবে। অর্থ পাচার বন্ধে রাজনৈতিক প্রত্যয় লাগবে। শুধু আমলারা এটা বন্ধ করতে পারবেন না। কারণ, যারা অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত তারা শক্তিশালী ব্যক্তি। এ ক্ষেত্রে এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিটের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূলত অবৈধ বাণিজ্যের মাধ্যমে এ অর্থ পাচার হয়। ওভার ইনভয়েসিং, রফতানির অর্থ দেশে না এনে বাহিরে রাখা ছাড়াও শুল্কমুক্ত পণ্য আমদানির আড়ালে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়। এর বাইরে হুন্ডির মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অনেকগুলো অর্থ পাচারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তকাজ চলছে। এর মধ্যে অফশোর ব্যাংকিং ও পানামা পেপার্সের মাধ্যমে অর্থ পাচারের যেসব অভিযোগ পাওয়া গেছে, সেগুলোকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হচ্ছে।’ সূত্র: যুগান্তর

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন