পোশাক শিল্পে কেন এই অস্থিরতা?

  26-12-2016 05:59PM

পিএনএস, এবিসিদ্দিক : বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অস্থিরতা কাটছেই না। কিছু দিন পর পর আন্দোলন, জ¦ালাও-পুড়াও, কারখানা বন্ধ ঘোষনা এটা একটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। অনেকেই এই শিল্পের ভবিষৎ নিয়ে শংকা প্রকাশ করছেন। তাহলে কি এই শিল্পের ভবিষৎ অন্ধকার? ১৯৬০ সালে পুরান ঢাকার উর্দু রোডে রিয়াজ স্টোর নামে একটি টেইলারিং আউটফিট যাত্রা শুরু করে কেবলমাত্র অভ্যন্তরিন চাহিদা মেটানোর জন্য। ১৯৭৩ সালে এই রিয়াজ স্টোর রিয়াজ গার্মেন্টস নাম ধারন করে-১০০০০পিস পুরুষদের টি-শার্ট ইউরোপে রপ্তানি করে।সুতরাং রিয়াজ গার্মেন্টস কে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের পথিকৃৎ বলা যায়। সে সময়ের ব্যাংক ব্যাবস্থা আজকের দিনের মত শক্তিশালি ছিলনা।

সরাসরি অর্থের লেনদেন করতে হতো বিদেশি ক্রেতাদের সাথে। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ ও দক্ষিন কোরিয়ার দাঈয়ু কোম্পানি যৌথ ভাবে স্থাপন করে দেশ গার্মেন্টস এই দাঈয়ু কোম্পানি উন্নত প্রশিক্ষনের জন্য ১২০ জন সেলাই মেশিন অপারেটর যার মধ্যে ৩ জন ছিলো মহিলা দক্ষিন কোরিয়া পাঠায়,কথিত আছে এই ১২০ জন প্রশিক্ষন শেষে দেশে ফিরে চুক্তির শর্ত ভংগ করে নিজেরাই আলাদা গার্মেন্টস খুলে বসেন,১৯৮০ সালে দেশ গার্মেন্টস পুরো মাত্র্য়া পোশাক তৈরি শুরু করে।অপর একটি দক্ষিন কোরিয়ান কোম্পানি ইয়াং ওয়ান ও এ সময় যৌথ ভাবে তৌরি পোশাক উৎপাদন আরম্ভ করে।

এর পরের ঘটনা গুলো রূপকথার মত,বাংলাদেশ খুব দ্রুত আর্ন্তজাতিক বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে,ভালো মান আর সল্পমূল্য বিদেশি ক্রেতাদের চুম্বকের মত আকর্ষন করলো বিস্তৃত হতে থাকলো বাংলাদেশে তৌরি পোশাকের বাজার,এ সময়ে সরকার তৌরি পোশাক খাত কে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়,ব্যাংকগুলো এলসি ব্যাক টু ব্যাক করতে শুরু করলে বিদেশে পন্য রপ্তানি তে যে গতি আসে তেমনি এই শিল্পের জন্য কাঁচামাল এবং মেশিন পত্র বিদেশ থেকে আনার পথ সুগম হয়। ১৯৮২ সাল বাংলাদেশে গারমেন্টস ফ্যাক্টরির সংখ্যা ছিল মাত্র ৪৭টি, ১৯৮৪-৮৫ সালে বেড়ে দাড়্য়া ৫৮৭ টিতে, ১৯৯৯তে ২৯০০ বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় ৮ হাজার টি গারমেন্টস ফ্যাক্টরি আছে,যেখানে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষের যার ৮০ ভাগ নারী।

বাংলাদেশে এই শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের বেতন-ভাতা খুবই কম। বলতে গেলে নাম মাত্র মজুরী। আর শ্রমিকদের প্রধান দাবি হচ্ছে বেতন-ভাতা বৃদ্ধি। কিন্তু মালিক পক্ষ এবিষয়ে রহস্যজনক নিরবতা পালন করছেন। যখনই আন্দোলন শুরু হয়, মালিকরা বলেন ‘ষড়যন্ত্র’। কিন্তু কারা ষড়যন্ত্র করেন সেটা আজ পর্যন্ত পরিষ্কার করতে পারেনি মালিক বা সরকার পক্ষ। এটি মাত্র একটি অজুহাত।

শ্রমিকরা ফুসকে উঠলে এরমধ্যে একটু উস্কানি যোগায় বামপন্থী কিছু নেতা-নেত্রী, আর কথিত শ্রমিক নেতা-নেত্রীরা। তারাই আবার সরকার ও মালিক পক্ষের সাথে বসে দালালির ভুমিকা পালন করেন। দালালি করে তাদের অবস্থার পরিবর্তন করলেও সাধারণ শ্রমিকদের ভাগ্যের পরিবর্তন নেই।

বিশ্বে প্রায় ৯০টি দেশে ন্যূনতম মজুরি আইন করে নির্ধারণ করা হয়। ন্যূনতম মজুরি আইন প্রথম করা হয় নিউজিল্যান্ডে ১৮৯৬ সালে। এর পর অষ্ট্রেলিয়ায় ১৮৯৯ সালে, ব্রিটেনে ১৯০৯ সালে, শ্রীলংকায় ১৯২৭ সালে এবং ১৯৩৬ সালে ভারতে, ১৯৬৯ সালে পাকিস্তানে প্রবর্তন করা হয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিকে বিবেচনায় নিয়ে ফ্রান্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, বেলজিয়াম, পর্তুগাল, স্পেন, মরিশাস, মেক্সিকো প্রভৃতি দেশে প্রতি বছর মজুরি পুনঃনির্ধারণ করা হয়। কানাডায় করা হয় প্রতি দুই বছর পর পর। বাংলাদেশে পাঁচ বছর পর পর মজুরি পুনঃনির্ধারণের আইন করা হয়েছে। আমাদের সংগঠন সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক ফ্রন্টের দাবি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সাথে সঙ্গতি রেখে প্রতিবছর মজুরি নির্ধারণ করতে হবে।

বাংলাদেশে একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের ন্যূনতম মাসিক মজুরি ৫৩০০ টাকা। এ হিসেবে ন্যূনতম মজুরি দাঁড়ায় ঘণ্টাপ্রতি ৩১ সেন্ট। পাকিস্তান, ভারতের শ্রমিকেরা যে মজুরি পায় বাংলাদেশে তার থেকে কম মজুরি পেয়ে থাকে। বাংলাদেশের শ্রমিকের মজুরি সার্কভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। পার্শ্ববর্তী নেপাল, ভুটানের চাইতেও আমাদের দেশের মজুরি কম।

অর্থনীতিবিদ আনু মুহাম্মদ বাংলাদেশের মজুরি কাঠামোকে অস্বাভাবিক উল্লেখ করে ২০০৬ সালে দেখিয়েছিলেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত একটি গার্মেন্টস পণ্য ইউরোপ বা যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ১০০ ডলারে বিক্রি হলে কারখানার মালিক পান ১৫-২০ ডলার, উক্ত রাষ্ট্র ২৫-৩০ ডলার এবং বিদেশি কোম্পানি ৫০-৬০ ডলার পেয়ে থাকে। উৎপাদনকারী শ্রমিকের ভাগে পড়ে মাত্র আধা ডলার। ফলে গার্মেন্টসের রপ্তানি বাড়লে লাভবান হয় মালিক ও রাষ্ট্র, শুধু বঞ্চিত হয় শ্রমিক। আজও সে অবস্থার বিশেষ কোন পরিবর্তন ঘটেনি।

ব্রিটেনের ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস ২০১৩ সালের ১০ মে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, বাংলাদেশের শ্রমিকদের মজুরি দ্বিগুণ করলে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে একটি টি জামার মূল্য বাড়বে মাত্র তিন সেন্ট। (১ ডলার =১০০ সেন্ট)। অর্থাৎ বাংলাদেশের টাকায় মাত্র ২৪ পয়সা। আমেরিকাতে একজন শ্রমিক প্রতি ঘণ্টায় মজুরি পায় ১০ ডলার। দিনে ৮ ঘণ্টা কাজ করলে পায় ৮০ ডলার বা বাংলাদেশের টাকায় ৬৪০০ টাকা। আমেরিকায় একটি টি শার্টের দাম ৩ থেকে ১৫ ডলারের মধ্যে।

বিভিন্ন কারণে সেখানে টি জামার দাম ১০-৩০ সেন্ট বাড়ে কমে। তা হলে ৩ সেন্ট দাম বাড়লে সেখানকার ক্রেতারা টি শার্ট কিনবে না এটা বিশ্ব সযোগ্য নয়। আসলে দেশি মালিক আর বিদেশি মালিক বায়ার’রা মিলে শ্রমিককে কম মজুরি দেয়ার জন্য মিথ্যা ভূতের ভয় দেখায়। বাস্তবে গার্মেন্ট চলে যাওয়া তো দূরের কথা উল্টো চীনসহ বিভিন্ন দেশে মজুরি বৃদ্ধি পাওয়ায় ওই দেশ থেকে আমাদের দেশে কাজ আসছে, ইতোমধ্যে চীনের ব্যবসায়ীদের একটা বড় দল বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। তারা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সাথে বৈঠক করে গেছে। ২০১৩ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করেছে থাইল্যান্ড মালয়েশিয়া ছেড়ে বাংলাদেশে আসছে ব্যবসায়ীরা।

বেপজা’র চেয়াম্যান মেজর জেনারেল কে এম মমিনর রহমান বলেন, চীনে শ্রমিকের গড় মজুরি ৫০০ ডলার, ভিয়েতনামে ৩০০ ডলার। শ্রমিকের উচ্চ মজুরির কারনে চীন থেকে ইতোমধ্যেই ব্যবসায়ীরা থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম মালয়েশিয়ায় যাওয়া শুরু করে। এসব দেশে শ্রমিকের গড় মজুরি বৃদ্ধি পেয়ে এখন তিনশ ডলার। বাংলাদেশ এখন তাই তাদের পছন্দের প্রথম তালিকায়। এখানে গড় মজুরি ৭০ ডলারেরও কম। শ্রমিকদের কাজ দিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে, শিল্প কারখানা বন্ধ হলে লাখ লাখ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে-এসব কথা বলে মালিকরা সরকারের কাছ থেকে সব সময় সুবিধা নিয়ে থাকে।

সরকারও ঘোষণা করে তারা ব্যবসা বান্ধব সরকার, ফলে পরস্পর পরস্পরের সহযোগী। একারণেই সংসদে মালিক ও ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য। এদের কোন দাবিই সরকারের কাছে অপূর্ণ থাকে না। এরা প্রণোদনার নামে টাকা নেয়, ১ শতাংশ সুদে সরকারের কাছে ঋণ চায়, কাঁচামাল আমদাদিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা চায় এদের চাওয়ার কোন শেষ নাই। শ্রমিক মজুরি দাবি করলে বলে, তাদের সব উৎপাদনের জিনিসের দাম বাড়ছে, ফলে মজুরি বাড়ানো সম্ভব নয়।

কিন্তু তারা যদি বাজার দরের সাথে তাল মিলিয়ে সুতা, কাপড়, যন্ত্রপাতি, রং, বিদ্যুৎ, পরিবহনের খরচ বাড়াতে পারে, তাহলে শ্রমিকের মজুরির বেলায় তার ব্যতিক্রম কেন হবে? শ্রমিকদের খাবার, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা খরচ, সন্তানের শিক্ষা খরচ কি বাড়ছে না? মুনাফার সীমার দিক দিয়েও বাংলাদেশ শীর্ষে। বাংলাদেশে ৪৩% মুনাফা হয় যা কম্বোডিয়াতে ৩১%, ভারতে ১১.০৮%, ইন্দোনেশিয়ায় ১০%, ভিয়েতনামে ৬.৫%, নেপালে ৪.৪০% ও চীনে ৩.২০%। (Institute of Development Economics; Japan_2007) চীন এত কম মুনাফা করেও কেন তারা গার্মেন্টস শিল্পে এখনও শীর্ষে; প্রতিবছর মজুরি বাড়ানোর পরও কেন তাদের শিল্প টিকে আছে? কারণ তাদের শ্রমিক দক্ষ। তাহলে মজুরির সঙ্গে দক্ষতার সম্পর্ক আছে।

বাংলাদেশের মালিকরা এটা ভুলিয়ে দিতে চায়। মুনাফা অর্জনের দক্ষতায় মালিকরা শীর্ষে আর শ্রমিক দক্ষ হয়ে ওঠেনি! এখানে উৎপাদন হয় সামাজিকভাবে, কিন্তু এর মালিকানা ব্যক্তিগত। উৎপাদন হয় মুনাফার সর্বোচ্চ উদ্দেশ্যে এবং মুনাফা মানেই উদ্বৃত্ত মূল্য অর্থাৎ শ্রমিকের শ্রম শোষণ, ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করা। এ মুনাফার প্রায় সবটাই যায় মালিকদের পকেটে। এর সাথে শ্রমিকদের এটাও বুঝতে হবে যে এ সমাজে বেতন-ভাতা যাই বাড়–ক না কেন, দ্রব্যমূল্য বাড়বে কয়েকগুণ।

বেতন বাড়ার সাথে সাথে খাদ্যদ্রব্য, বাড়িভাড়া, ওষুধপত্র, গাড়িভাড়া সব বেড়ে যায়। এক মালিকের কাছে মজুরি নেয়ার সাথে সাথে অন্য মালিকরা ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্রমিককের টাকাটা হাতিয়ে নেয়ার জন্য। মালিকশ্রেণি সুচতুর জাল বিস্তার করে যাতে শ্রমিকের শ্রম ও মজুরি শেষ পর্যন্ত নিংড়ে নেয়া যায়। অর্থাৎ মজুরি বাড়লেও জিনিসপত্রের দাম বাড়ার কারণে শ্রমিক যে তিমিরে ছিল সে তিমিরেই থাকবে। পুঁজিবাদী সমাজের এটাই নিয়ম। ফলে নিছক বেতন ও অন্যান্য সুবিধা বৃদ্ধির আন্দোলন শ্রমিকের ভাগ্য পাল্টাবে না।

পিএনএস/মো: শ্যামল ইসলাম রাসেল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন