ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা

  11-02-2017 11:00AM

পিএনএস ডেস্ক: নানা উদ্যোগের পরও অনিয়ম ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ বিতরণে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ব্যাংকটি কোনো গ্রাহককে আর ঋণ দিতে পারবে না। বিধিবহির্ভূতভাবে আগ্রাসীভাবে ঋণ বিতরণ করায় আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৫ ধারার ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে ব্যাংকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু এলসির দেনা পরিশোধের অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি ব্যাংকটিকে চিঠি দিয়ে এ নির্দেশনা দিয়েছে বলে দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে।


সূত্র জানায়, বিধিবহির্ভূতভাবে ঋণ বিতরণের ফলে গত ডিসেম্বরে ব্যাংকটির ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) ৯৭ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। এর আগে গত সেপ্টেম্বরেও ঋণ-আমানত অনুপাত ছিল ৮৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের বিধান অনুযায়ী প্রচলিত ধারার কোনো ব্যাংক তার আমানতের ৮৫ শতাংশের বেশি ঋণ দিতে পারে না। তবে সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে ফারমার্স ব্যাংক ৯৭ শতাংশ ঋণ বিতরণ করেছে। ব্যাপক হারে ঋণ বিতরণের ফলে ব্যাংকটি নগদ টাকার সংকটে পড়েছে। এতে করে একাধিক দিন নগদ জমা সংরক্ষণে (সিআরআর) ব্যর্থ হয়ে বড় অঙ্কের জরিমানা গুনেছে। নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যাংক যথানিয়মে সিআরআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে অসংরক্ষিত অংশের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার ও ২০১০ সালের নির্দেশনার আলোকে ব্যাংক রেট +৫ শতাংশ তথা ১০ শতাংশ হারে জরিমানা আদায় করা হয়। আর এসএলআর সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে উল্লেখিত অংশের ওপর স্পেশাল রেপোর সুদহার অনুযায়ী জরিমানা দিতে হয়।

ফারমার্স ব্যাংকের এ অনিয়মের বিষয়ে কয়েক দফা সতর্ক করা হলেও ব্যাংক কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করতে বাধ্য হয়। তবে গ্রাহকরা ব্যাপক সমস্যার সম্মুখীন হওয়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বরাবর ব্যাংকটির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু এলসির দেনা পরিশোধের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও ফারমার্স ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে 'স্পর্শকাতর তথ্যের' অজুহাত তুলে কেউ আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দিতে রাজি হননি। অবশ্য নাম না প্রকাশের শর্তে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা এ খবরের সত্যতা নিশ্চিত করেন। যোগাযোগ করা হলে ফারমার্স ব্যাংকের এমডি এ কে এম শামীম কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি টেলিফোনে বলেন, 'অবাস্তব কোনো বিষয় নিয়ে

তিনি কথা বলতে চান না। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি একজন ডেপুটি গভর্নরের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। তবে ডেপুটি গভর্নর আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেননি। এদিকে সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক ছুটিতে থাকায় তিনি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ঋণ কার্যক্রম বন্ধের পাশাপাশি ব্যাংকটিকে কঠোর তদারকির আওতায় রাখা হয়েছে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে ঋণ বিতরণের ওপর দেওয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।

আর্থিক অনিয়ম ঠেকাতে গত বছরের ১৩ জানুয়ারি ফারমার্স ব্যাংকে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নানা অনিয়মে সংশ্লিষ্টতার দায়ে এর আগে ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যানের পদ থেকে মাহবুবুল আলম চিশতীকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। গত অর্থবছর ব্যাংকটির ওপর ১৯টি বিশেষ পরিদর্শন পরিচালিত হয়। এসব পরিদর্শনে উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে প্রচুর ঋণ খেলাপি করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তথ্যের ভিত্তিতে ব্যাংকটির মোট ঋণের ২৭৭ কোটি টাকা খেলাপি হয়ে গেছে। একই সময়ে কাজ শুরু করা অন্য আট ব্যাংকে মোট খেলাপি ঋণ রয়েছে ২৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক ফারমার্স ব্যাংকে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ রয়েছে, তা অন্য আট ব্যাংকের প্রায় সমান।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৫-এর (১) উপধারার ক্ষমতাবলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফারমার্স ব্যাংকের ঋণ কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এই ধারায় বলা আছে, 'বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে (ক) জনস্বার্থে, বা (খ) মুদ্রানীতি এবং ব্যাংক নীতির উন্নতি বিধানের জন্য, বা (গ) কোনো ব্যাংক কোম্পানির আমানতকারীদের স্বার্থের পরিপন্থী বা ব্যাংক কোম্পানির স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার জন্য, বা (ঘ) কোনো ব্যাংক কোম্পানি যথাযথ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য, সাধারণভাবে সব ব্যাংক কোম্পানিকে অথবা বিশেষ কোনো ব্যাংক কোম্পানিকে নির্দেশ প্রদান করা প্রয়োজন, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক যথাযথ নির্দেশ জারি করতে পারবে; এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোম্পানি উক্ত নির্দেশ পালন করতে বাধ্য থাকবে।'

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রচলিত ধারার একটি ব্যাংক মোট আমানতের সর্বোচ্চ ৮৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। আর ইসলামী ব্যাংকগুলো ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পারে। সব ধরনের তলবি ও মেয়াদি দায়ের বিপরীতে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো সাপ্তাহিক ভিত্তিতে গড়ে ৬ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোকে সাড়ে ৫ শতাংশ হারে নগদ জমা সংরক্ষণ (সিআরআর) করতে হয়। এ ছাড়া দ্বি-সাপ্তাহিক ভিত্তিতে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোকে বিধিবদ্ধ জমা সংরক্ষণ (এসএলআর) করতে হয় গড়ে ১৩ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলোকে সাড়ে ৫ শতাংশ। সিআরআর ও এসএলআর মিলে প্রচলিত ধারার ব্যংকের ১৯ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংকগুলো সাড়ে ১১ শতাংশ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রাখতে হয়।

২০১২ সালের মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্মতিপত্র পায় ফারমার্স ব্যাংক। ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু হয়েছে পরের বছরের জুনে। ব্যাংকটির মূল উদ্যোক্তা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও বর্তমানে সরকারি হিসাব-সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীর। প্রথম বছর থেকেই এই ব্যাংকের চেয়ারম্যান তিনি। বর্তমানে এর শাখা ৫২টি। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ২০১৪ ও ২০১৫ সালে ফারমার্স ব্যাংকের ওপর একাধিক বিশেষ পরিদর্শন পরিচালিত হয়। এরপর ২০১৫-১৬ অর্থবছরে আরও ১৯টি বিশেষ পরিদর্শন পরিচালিত হয়েছে। এসব পরিদর্শনে বেশি অনিয়ম ধরা পড়ে ব্যাংকটির মতিঝিল ও গুলশান শাখার ঋণে।

পরিদর্শনে পাওয়া তথ্যের আলোকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ফারমার্স ব্যাংককে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে জরিমানা পরিশোধ না করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার বিরুদ্ধে আদালতে যায় ফারমার্স ব্যাংক। এর আগে ব্যাংকটির নির্বাহী কমিটির চেয়ারম্যান থেকে মাহবুবুল আলম চিশতীকে সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশনার বিরুদ্ধেও আদালতে যায় ব্যাংকটি। এরপর গত বছরের ১৩ জানুয়ারি ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।সূত্র: সমকাল

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন