ব্যাংকে রাখলে টাকা কমবে!

  16-02-2017 11:50AM


জমানো অথবা পেনশনের টাকা ব্যাংকে আমানত হিসেবে রেখে তার সুদ বাবদ আয় দিয়ে সংসার চালাবেন, সেই দিন আর নেই! বছর পাঁচেক আগেও এক লাখ টাকা ব্যাংকে রাখলে সেখান থেকে মাসে হাজার টাকার বেশি সুদ পাওয়া যেত। কারও কাছে টাকা আছে জানলেই ব্যাংকের কর্মকর্তারা গিয়ে হাজির হতেন, যাতে গ্রাহক সেই টাকা তাঁর ব্যাংকে আমানত হিসেবে রাখেন।

আর এখন ব্যাংকগুলো লাখ টাকার বিপরীতে মাসে ৫০০ টাকার বেশি সুদ দিতে চায় না। সঙ্গে থাকে মেয়াদ দীর্ঘ হওয়ার শর্ত। আর ছোট ও স্বল্পমেয়াদি আমানতকারীদের কোনো কদরই ব্যাংকে নেই।

এ পরিস্থিতিতে সঞ্চয়ী ও জমানো টাকার সুদ আয়ের ওপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো বিপাকে পড়েছে। বছর শেষে দেখা যাচ্ছে, তাদের ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা প্রকৃতপক্ষে কমে গেছে। কেননা ব্যাংকে এখন আমানতের সুদের হার নেমেছে ৫ শতাংশে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার মূল্যস্ফীতি প্রাক্কলন করেছে সাড়ে ৫ শতাংশ। ফলে এখন ব্যাংকে ১ লাখ টাকা আমানত থাকলে বছর শেষে আপনি ১ লাখ ৫ হাজার টাকা ঠিকই পাবেন। কিন্তু বাড়তি ৫ হাজার টাকা লাভ হিসেবে ধরলে ভুল করবেন। কারণ, ১ লাখ টাকার সঙ্গে ৫ হাজার যোগ করেও আপনি তখন আগের চেয়ে কম পরিমাণে পণ্য ও সেবা কিনতে পারবেন। মূল্যস্ফীতি এর কারণ।

কিন্তু সঞ্চয়ীরা টাকা নিয়ে কী করবে? তাদের সামনে বিশেষ কোনো বিকল্প নেই। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানে টাকা রাখতে সাধারণ মানুষ অভ্যস্ত নয়। সঞ্চয়পত্র কেনার ঝক্কি অনেক। আবার মাসে মাসে বেতন থেকে যাঁরা টাকা জমা রাখেন, তাঁদের জন্য ব্যাংকই সুবিধাজনক। এসব কারণে সুদের হার তলানিতে নামার পরেও ২০১৬ সালেও ব্যাংকের আমানত ১৩ শতাংশ বেড়েছে।

আমানতের সুদের হার কমিয়ে তফসিলি ব্যাংকগুলোর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। কারণ, তাদের হাতে ঋণ দেওয়ার জন্য বিপুল অর্থ আছে, যার পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৯৪ হাজার কোটি টাকা। অবশ্য সাধারণ আমানতকারীদের নিয়ে চিন্তিত কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাদের পক্ষ থেকে গত সপ্তাহে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে আমানতের সুদ হার আর না কমানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ঋণের সুদের হার কমাতে খেলাপি ঋণ কমানোসহ ব্যবস্থাপনা দক্ষতা বাড়াতে বলা হয়েছে ওই নির্দেশনায়।

* আমানতের সুদের হার ৫ শতাংশ মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলন সাড়ে ৫ শতাংশ * মানুষের সামনে বিকল্প নেই, ব্যাংকে আমানত বেড়েছে ১৩ শতাংশ * ব্যাংকে ১ লাখ ৯৪ হাজার কোটি টাকার উদ্বৃত্ত তারল্য * মানুষ ঝুঁকছে সঞ্চয়পত্রের দিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মনে করেন, মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের সুদের হার বেশি থাকা উচিত। নইলে সাধারণ আমানতকারীরা বিপাকে পড়েন। তিনি বলেন, ‘এখন ঠিক তাই হয়েছে। ব্যাংকগুলোকে সঞ্চয়ের ওপর সুদের হার বাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য ব্যাংকের খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে হবে।’ খেলাপি ঋণের ধাক্কা সামলিয়ে ব্যাংকের পক্ষে ওপরে ওঠা কঠিন হয়ে পড়েছে বলেও উল্লেখ করেন সাবেক ওই ব্যাংকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে আমানতের ওপর সুদ ছিল সাড়ে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ। ২০১৩ সালে আমানতের গড় সুদহার নেমে আসে ৮ দশমিক ৬১ শতাংশে। গত ডিসেম্বর শেষে দেশের ব্যাংকগুলোর আমানতের গড় সুদহার দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ২২ শতাংশ।

২০১৬ সালের ডিসেম্বর শেষে দেশে কার্যরত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে গচ্ছিত আমানতের পরিমাণ দাঁড়ায় ৯ লাখ ৮ হাজার কোটি টাকায়; যা আগের বছরের চেয়ে ১৩ দশমিক ১ শতাংশ বেশি। ২০১৫ সালেও ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৩ শতাংশ।

ব্যাংকের হাতে ঋণ দেওয়ার মতো পর্যাপ্ত তহবিল রয়েছে। তবে কাঙ্ক্ষিত হারে বিনিয়োগ না হওয়ায় নতুন করে আমানত নিতে উৎসাহ পাচ্ছে না ব্যাংকগুলো। এ কারণে ব্যাংকগুলো আমানতের হার কমিয়ে দিয়েছে। উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারি বিভিন্ন বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে ব্যাংক।

এখন ঋণের গড় সুদহার ৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ফলে ঋণ ও আমানতের সুদহারের ব্যবধান দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৭১ শতাংশে। খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ এ প্রসঙ্গে বলেন, ঋণ ও আমানতের সুদের হারের ব্যবধান ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশে আনতে হবে। এত ব্যবধান ব্যাংকগুলোর অদক্ষতার পরিচয়। বিদেশে এর হার ২-৩ ভাগের মধ্যে। এটা কমিয়ে এনে আমানতের সুদের হার বাড়ানো যেতে পারে।

আমানতের সুদের হার কমাতে সবচেয়ে তৎপর রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো। সেখানে গেলে গ্রাহকেরা এখন মেয়াদি আমানতের বিপরীতে সাড়ে ৪ শতাংশ সুদ পেতে পারেন; যা বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে ৬ থেকে ৭ শতাংশ। অবশ্য তা নির্ভর করছে আমানতের মেয়াদের ওপর।

গত বৃহস্পতিবার সোনালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে কথা হয় অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা নেয়ামত উল্লাহর সঙ্গে। পেনশনের পুরো টাকা জমা রেখে সুদের আয় দিয়ে তাঁর সংসার চলত। গত বছরে মেয়াদ শেষ হওয়ায় ব্যাংক এখন সুদের হার অর্ধেক করে দিয়েছে। নতুন করে আর আমানতও নিতে চাইছে না। এ কারণে টাকা তুলে কিছু সঞ্চয়পত্রে ও কিছু শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার ইচ্ছার কথা জানালেন তিনি।

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) ভাইস চেয়ারম্যান ও ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ অনেক বেশি। এ কারণে ব্যাংকে তহবিল ব্যয় বেশি হয়ে গেছে। এ ছাড়া ঋণের সুদের হার কমাতে গিয়ে আমানতের হার অনেক নিচে নেমে এসেছে। এতে ব্যাংকগুলোর আয়ও কমে যাচ্ছে। আমানতের সুদের ওপর নির্ভরশীল গ্রাহকদের জন্য শেয়ারবাজারের মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগের উপযুক্ত জায়গা হতে পারে। তবে ব্যাংকে আমানত রেখে তো ঋণসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়া যায়।


এদিকে বেশি সুদের কারণে সব শ্রেণির লোকেরাই সঞ্চয়পত্র কেনার দিকে ঝুঁকছে। ফলে অর্থবছরের নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা প্রথম ছয় মাসেই (জুলাই-ডিসেম্বর) ছাড়িয়ে গেছে। ছয় মাসে নিট বিক্রি হয়েছে ২৩ হাজার ৪৭৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র। অর্থবছরের পুরো সময়ের জন্য সঞ্চয়পত্র বিক্রি থেকে সরকারের নিট ঋণ গ্রহণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। সূত্র: প্রথম আলো


পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন