এনবিআরের ১৩% ভ্যাট প্রস্তাবও নাকচ

  15-05-2017 09:14AM


পিএনএস ডেস্ক: আগামী অর্থবছরের জন্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রস্তাবিত অভিন্ন ভ্যাট বা মূসক (মূল্য সংযোজন কর) হার ১৩ শতাংশ নির্ধারণের বিপক্ষে মত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাঁর উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ভ্যাটের হার ১২ শতাংশ করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরলেও তিনি কোনো মন্তব্য করেননি। ভ্যাট আইন-২০১২ নিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসে সমঝোতা করতে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে গতকাল রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকে টানা চার ঘণ্টার বেশি বৈঠক হয় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর দুই উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও মসিউর রহমান, এনবিআর চেয়ারম্যান মো. নজিবুর রহমান, অর্থসচিব, মুখ্য সচিব, এনবিআর আয়কর, শুল্ক ও ভ্যাট শাখার তিন সদস্য ও তিন প্রথম সচিব উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠকে ভ্যাট আইনের বিষয়টি চূড়ান্ত না হলেও সেবা খাতের কিছু পণ্যে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট নির্ধারণ এবং প্রায় পাঁচ শ পণ্যে সম্পূরক শুল্ক বহাল রাখতে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন।

বৈঠকের শুরুতেই ভ্যাট আইন-২০১২ নিয়ে সরকারের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের দূরত্ব এত দিনে কেন সমাধান হয়নি, তা জানতে চান প্রধানমন্ত্রী। এ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করেন অর্থমন্ত্রী, মসিউর রহমান ও এনবিআর চেয়ারম্যানকে।

প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন রাখেন, ‘গত প্রায় পাঁচ বছর থেকে ভ্যাট আইনের সমস্যাগুলো মেটানো যাচ্ছে না কেন?’ তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীরা তো ট্যাক্স দিচ্ছে, না হলে রাজস্ব আসছে কোথা থেকে? তাঁদের বাদ দিয়ে আইন করা ঠিক হবে না। তাঁদের মতামতের গুরুত্ব দিতে হবে। জনগণকে ভোগান্তিতে ফেলতে পারে, এমন কোনো সুযোগ আমি কাউকে দিতে চাই না। ’

বৈঠকের শুরু থেকেই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ভ্যাট আইন সংশোধন ছাড়াই বাস্তবায়নের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন। বিভিন্ন যুক্তি বর্ণনা করার ফাঁকে ফাঁকে অর্থমন্ত্রী ভ্যাট আইন-২০১২ বাস্তবায়ন হলে কী পরিমাণ রাজস্ব আদায় হবে, কোন খাত থেকে বেশি আদায় হবে—এসব বিষয়ে এনবিআরের হিসাব প্রধানমন্ত্রীকে একের পর এক দেখাতে থাকেন। অর্থমন্ত্রী আইনটির বিভিন্ন সুবিধা বর্ণনা করা ছাড়াও কিভাবে ভ্যাট ফাঁকি বন্ধ হবে তাও প্রধানমন্ত্রীকে জানান। অর্থমন্ত্রীর কথায় মাঝে মাঝে আইনটির বিভিন্ন ইতিবাচক ইস্যু মনে করিয়ে দেন এনবিআর চেয়ারম্যান। একপর্যায়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, ভ্যাটের হার ১৩ শতাংশের কম করা হলে রাজস্ব আদায়ে ধস নামবে।

অর্থমন্ত্রীর এ মন্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৩ শতাংশ আর ১৫ শতাংশের মধ্যে পার্থক্য কী? এ বিষয়টি এখনই চূড়ান্ত না করে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাণিজ্যমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। বাণিজ্যমন্ত্রীকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের মধ্যে যাঁকে যাঁকে প্রয়োজন মনে করবেন, তাঁকে তাঁকে নিয়ে বসে আলোচনা করে ভ্যাট আইনের বিষয়টি চূড়ান্ত করে আমাকে দেখাবেন। ’

অবশ্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বৈঠকের শুরু থেকেই আগামী অর্থবছরে ভ্যাট আইন সম্পূর্ণ বাস্তবায়নের বিপক্ষে মত দেন। প্রধানমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আইন মানুষের জন্য। ব্যবসায়ীদের দাবি বিবেচনা করেই আইনটি বাস্তবায়ন করতে হবে। যে আইনে ভোগান্তি হবে সে আইন কেন নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন হবে? ভ্যাট আইনে রেয়াত নিলে দ্রব্যমূল্য বাড়বে না—এটা সঠিক। তবে এটা নিয়ন্ত্রণ করা, পর্যবেক্ষণ করা সহজ বিষয় নয়। আগামী অর্থবছরে ভ্যাট আইন-২০১২-এর কিছু ধারা বর্তমান আইনে সমন্বয় করার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, ভারতে গত ১০ বছর থেকে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। এখনো আইনটি বাস্তবায়ন হয়নি। ভ্যাট আইন সব দেশেই বাস্তবায়নে সময় লাগে।

বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে এনবিআর থেকে ভ্যাট অব্যাহতির সীমা ৩৫ লাখ টাকা এবং পরবর্তী সীমা ৮০ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব জানানো হয়। বাণিজ্যমন্ত্রী এনবিআরের এ প্রস্তাব আমলে না নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, ভ্যাট অব্যাহতি সীমা বাড়ান। পরবর্তী সীমা এক কোটি টাকা বা এক কোটি ২৫ লাখ টাকা করা উচিত।

সম্পূরক শুল্ক তুলে দেওয়া হলে দেশের শিল্প বলে কিছু কি থাকবে?—এমন প্রশ্ন করে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহার করা সম্ভব নয়। এতে দেশি শিল্প মার খেয়ে যাবে। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুরও এ বিষয়ে আপত্তি আছে।

দুই মন্ত্রীর এমন যুক্তি-পাল্টা যুক্তির মধ্যে এনবিআর চেয়ারম্যান ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বলেন, আগামী অর্থবছরে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার ভ্যাট আদায়ের কথা এনবিআরকে বলা হয়েছে। আমরা এমন একটি হিসাব ধরে কাজ করছি। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে না গেলে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হবে। এনবিআর ভ্যাট আইনের সুফল নিয়ে বিভিন্ন প্রচার চালাচ্ছে। অনেক ব্যবসায়ী আমাদের পক্ষে আছেন।

এনবিআর চেয়ারম্যান ভ্যাট আইন-২০১২ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সামনে তিন ধরনের বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন। প্রথম বিশ্লেষণে উল্লেখ করেন, ভ্যাট আইন সংশোধন ছাড়া বাস্তবায়ন করলে কী প্রভাব পড়বে। দ্বিতীয় বিশ্লেষণে ভ্যাট আইন অল্প কিছু সংশোধন করে বাস্তবায়ন করলে এবং তৃতীয় বিশ্লেষণে বর্তমান ভ্যাট আইনে, ভ্যাট আইন-২০১২-এর উল্লেখযোগ্য (প্রায় অধিকাংশ) ধারাগুলো সমন্বয় করলে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে, তা তুলে ধরেন।

এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, প্রতি ১ শতাংশ ভ্যাট কমালে ভ্যাট আদায় আট হাজার কোটি টাকা কমবে। অর্থাৎ ভ্যাটের হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে রাজস্ব আদায় ৪০ হাজার কোটি টাকা কম হবে। এভাবে ভ্যাটের ১৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হলে ভ্যাটের ১৬ হাজার কোটি টাকা এবং ১২ শতাংশ নির্ধারণ করলে ২৪ হাজার কোটি টাকা কমবে।

এনবিআরের বিশ্লেষণে বলা হয়, ‘দেশে ৩৬ হাজার ব্যবসায়ী নিয়মিত ভ্যাট দেন না। প্যাকেজ ভ্যাটে সামান্য কিছু ভ্যাট আসে। বর্তমান ভ্যাট আইনের অধিকাংশ পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ আছে। শুধু ১৫টি সেবার ক্ষেত্রে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট ১.৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ এর মধ্যে আরোপ আছে। বর্তমানে যেসব সেবার ক্ষেত্রে হ্রাসকৃত ভ্যাটের হার প্রযোজ্য রয়েছে এবং যেসব পণ্যের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ট্যারিফ মূল্যের ভিত্তিতে ভ্যাট পরিশোধ করতে হয় সেসব ক্ষেত্রে উপকরণ কর রেয়াত পাওয়া যায় না। বর্তমানে যেসব প্রতিষ্ঠান ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রদান করে এবং উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণ করে তাদের নিজ স্তরে ভ্যাট প্রদানের পরিমাণ ২ বা ৩ শতাংশের বেশি নয়। তাই বর্তমানে যেসব ক্ষেত্রে হ্রাসকৃত মূল্য বা ট্যারিফ মূল্য রয়েছে, নতুন ভ্যাট ব্যবস্থায় সেসব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধ করে উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণ করা হলে ওই স্তরে ভ্যাটের প্রকৃত ভার ২ বা ৩ শতাংশের বেশি হবে না বিধায় মূল্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা নেই। ’

এনবিআরের এ বিশ্লেষণ উল্লেখ করে বৈঠকে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, রেয়াত নিলে দ্রব্যমূল্য বাড়বে না। মিথ্যা অজুহাতে যেসব অসাধু ব্যক্তি দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়াবে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে অন্যরা আর এ পথে পা বাড়াবে না।

প্রধানমন্ত্রী বৈঠকে অনলাইনে ভ্যাট আদায় এবং ইশিআর মেশিন ব্যবহারে কত দূর অগ্রগতি তা জানতে চান। এ সম্পর্কে এনবিআর চেয়ারম্যান প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, আগামী অর্থবছর থেকে অনলাইনে ভ্যাট আদায় সম্ভব হবে। কিস্তিতে ইশিআর মেশিন কেনার বিষয়ে অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রকৃত মূল্য ধরে দেওয়া হবে।

গতকালের বৈঠকে আয়কর ও শুল্কবিষয়ক প্রস্তাবের অনেকগুলো প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়। প্রধানমন্ত্রী অর্থপাচার রোধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে এনবিআর চেয়ারম্যানকে নির্দেশ দেন। এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, আগামী বাজেটে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেল এবং এনবিআরের তিন গোয়েন্দা শাখা শক্তিশালীকরণের বিষয়ে নির্দেশ থাকবে।

এনবিআরের আয়করবিষয়ক প্রস্তাবে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব ছিল না। এ বিষয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, এনবিআর করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রয়োজন মনে করে না। তবে এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে সরকার থেকে যে সিদ্ধান্ত দেওয়া হবে, তা এনবিআর কার্যকর করবে।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী মুহিত অর্থ বিভাগের সিনিয়র কয়েকজন কর্মকর্তাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গিয়ে আগামী বাজেটের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন। সেই বৈঠকে নতুন ভ্যাট আইনের কারণে জনগণের ওপর যাতে বাড়তি চাপ না পড়ে, দ্রুত তার উপায় খুঁজে বের করতে অর্থমন্ত্রীকে নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসে তাড়াতাড়ি ভ্যাট আইনের সমস্যা দূর করুন। ’ তিনি আরো বলেন, ‘ভ্যাটের কারণে জনগণের যাতে ভোগান্তি না হয়, সে জন্য দ্রুত পথ খুঁজে বের করুন। সামনে নির্বাচন রয়েছে। ’

গত ১০ মে এনবিআর চেয়ারম্যানসহ রাজস্ব বাজেট প্রস্তুত কমিটির ছয় কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে অর্থমন্ত্রী ভ্যাটের একক হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৩ শতাংশ এবং ভ্যাট অব্যাহতি সীমা ৩০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ লাখ টাকা নির্ধারণের নির্দেশ দেন। সূত্র: কালের কণ্ঠ

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন