এক দশকে ৬ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার

  08-08-2017 08:21AM


পিএনএস ডেস্ক: দেশ থেকে অস্বাভাবিক হারে টাকা পাচার বেড়েছে। গত ১০ বছরে দেশ থেকে প্রায় ৬ লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। কিন্তু তা ফেরত আনার তেমন কোনো উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের। বরং একের পর এক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হচ্ছে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে। বলা হচ্ছে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের বিচার না হওয়া, নিরাপত্তার অভাব, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশৃঙ্খলা, মাত্রারিক্ত দুর্নীতি এবং বিদেশের উন্নত জীবনের লোভের কারণেই বিদেশে অর্থ পাচার হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ব্যাংক ও অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস-এই ৪টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয় করা গেলে অর্থ পাচাররোধ সম্ভব বলে জানিয়েছেন তারা। জানা গেছে, ব্যবসায়ীরা অর্থ পাচার করছেন আমদানি-রপ্তানির আড়ালে; আমদানি পণ্যের দাম বেশি দেখিয়ে আর রপ্তানি পণ্যের দাম কম দেখিয়ে। এ ছাড়া উচ্চপর্যায়ের আমলা, বেসরকারি চাকরিজীবীরাও নগদ অর্থ পাচার করছেন হুন্ডির মাধ্যমে। শুধু ২০১৪ সালেই বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। ২০১৩ সালে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার বা প্রায় ৭৭ হাজার কোটি টাকা। এভাবে গত ১০ বছরে দেশ থেকে পাচার করেছে ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। ২০০৫ থেকে ১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বিভিন্ন মাধ্যমে এই অর্থপাচার হয়েছে বলে জানিয়েছে ওয়াশিংটন ভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই)। সংস্থাটির হিসাবে, ২০০৫ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানির পরিমাণ ৪৪ হাজার ৬১৫ কোটি ডলার বা ৩৫ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১২ থেকে ১৭ শতাংশ অর্থই বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। সর্বোচ্চ ১৭ শতাংশ অর্থ পাচার হয়েছে ধরে নিলে এই ১০ বছরে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ লাখ ৬ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। তবে সর্বনিম্ন ১২ শতাংশ ধরলে পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ দাঁড়াবে ৪ লাখ ২৮ হাজার ৩০৪ কোটি টাকা।

জিএফআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ সালে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৭২২ কোটি ৫০ লাখ ডলার, ২০১৩ সালে ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ ডলার ও ২০১৪ সালে ৭০০ কোটি ৬৯ লাখ ডলার। এ ছাড়া ২০০৫ সালে ৪২৬ কোটি ২০ লাখ ডলার, ২০০৬ সালে ৩৩৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৭ সালে ৪০৯ কোটি ৮০ লাখ ডলার, ২০০৮ সালে ৬৪৪ কোটি ৩০ লাখ ডলার, ২০০৯ সালে ৬১২ কোটি ৭০ লাখ ডলার, ২০১০ সালে ৫৪০ কোটি ৯০ লাখ ডলার এবং ২০১১ সালে পাচার হয় ৫৯২ কোটি ১০ লাখ ডলার। সব মিলিয়ে ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে অর্থ পাচারের পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকা। এই অর্থ দিয়ে অন্তত এক বছরের বাজেট তৈরি করতে পারত বাংলাদেশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে দেখা গেছে, শিল্পের যন্ত্রপাতি ভর্তি কনটেইনারে পাওয়া গেছে ছাই, ইট, বালি, পাথর ও সিমেন্টের বক। এতে শিল্পের কোনো যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়নি। এছাড়া বন্দরে শুল্ক গোয়েন্দাদের তদন্তে খালি কনটেইনার আমদানির ঘটনাও ধরা পড়েছে।

এদিকে সুইস ব্যাংকগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১২ সাল থেকে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে অর্থ জমার পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। ২০১২ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের জমা অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় ২২ কোটি ৮০ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ হাজার ৯৬১ কোটি টাকা। ২০১২ থেকে ২০১৬ সাল এই সময়ের মধ্যে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশের জমা রাখা অর্থের পরিমাণও ৩ গুণ বেড়ে গেছে। আবার ২০০৯ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমার পরিমাণ ছিল ১৪ কোটি ৯০ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ১ হাজার ২৮১ কোটি টাকা, আর এখন তা ৩৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৫ হাজার ৬৮৫ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৬৬ কোটি ১৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা প্রায় ৫ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা (১ ফ্রাঁ = ৮৪ টাকা)। ২০১৫ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশ থেকে জমার পরিমাণ ছিল প্রায় ৫৫ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা প্রায় ৪ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। সেই হিসাবে আগের বছরের চেয়ে এ জমার পরিমাণ প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বা ২০ শতাংশ বেড়েছে।

এদিকে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় বলা হয়, প্রতিবছর গড়ে ৫৫৮ কোটি হিসাবে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ কোটি টাকা।

ওই প্রতিবেদনে সিপিডির ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিনিয়োগ নিঃস্ব একটি দেশ এখন ক্রমান্বয়ে পুঁজি রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হচ্ছে। তিনি বলেন, যে দেশে বিনিয়োগের জন্য পুঁজি আসছে না, সেই দেশ থেকে পুঁজি পাচার হয়ে যাচ্ছে। এটা দুঃখজনক ঘটনা। তার মতে, অর্থ পাচার রোধ সম্ভব। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তি উন্নত ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, পাচার হওয়া অর্থের চেয়ে পাচার রোধে বেশি সময় দেয়া, আন্তর্জাতিক আইনের সঙ্গে সমন্বয়, পাচারকারীদের দৃশ্যমান শাস্তি ও দুদক, রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক ইত্যাদির মধ্যে সমন্বয়, সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বাড়াতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, টাকা পাচার প্রতিরোধে প্রায় অর্ধশত দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। টাকা পাচারের তথ্য আদান প্রদান করার জন্যই মূলত এ চুক্তি করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। কিন্তু টাকা পাচার থেমে নেই, বরং বেড়েই চলছে। এ পর্যন্ত পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যায়নি সংশ্লিষ্টরা মন্তব্য করেছেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, জাতীয় জীবনের নিরাপত্তা যখন অনিশ্চিত হয় তখন দেশে বিনিয়োগ করতে ভয় পান বিনিয়োগকারীরা। আস্থার সঙ্কটে ভোগেন। আর এ কারণেই তাদের মূলধন বিদেশে নিয়ে যান অনৈতিক পন্থায়। দেশ থেকে টাকা পাচার বেড়ে যাওয়াও এটি একটি কারণ বলে তিনি মনে করেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আর্থিক খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা কমে যাওয়ার অন্যতম লক্ষণ হচ্ছে অর্থ পাচার। এ ছাড়া দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকা, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তাহীনতার কারণেও অর্থ পাচার বাড়ছে। তার মতে, অর্থ পাচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। পাশাপাশি বিনিয়োগের পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। নাগরিক জীবনেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি।

বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা খুবই জটিল প্রক্রিয়া। মূলত দুই প্রক্রিয়ায় পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। প্রথমত, অর্থ পাচারের ব্যাপারে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেতে হবে। ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দেশের আদালতে রাষ্ট্রপক্ষ মামলা করতে হবে। স্থানীয় আদালতকে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পক্ষে রায় দিতে হবে। আদালতের এ রায়ের কপি অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস থেকে যে দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে ওই দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে অবহিত করতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস অর্থ ফেরত দেয়া যায় কি না তা ওই দেশের আদালতে মামলা করবে। সংশ্লিষ্ট দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা রয়েছে কিনা তা যাচাই বাছাই করবে। পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার ব্যাপারে আইনি জটিলতা না থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশের আদালত থেকে পাচারকৃত অর্থ ফেরত দেয়ার বিষয়ে রায় প্রদান করবে। এর পরই কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া শুরু হবে। তবে সবকিছু অনুকূলে থাকলে এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে অর্থ ফেরত আনতে ৫ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে।

দ্বিতীয়ত, মামলা করা ছাড়াও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা যায়, যদি সংশ্লিষ্ট দেশের আইনি কোনো জটিলতা না থাকে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশকে আন্তর্জাতিক অপরাধ দমন সংস্থা এগমন্ড গ্রুপের সদস্য হতে হবে। এ ক্ষেত্রে এক দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকে অন্য দেশের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পাসপোর্ট নম্বরসহ সুনির্দিষ্ট তথ্য সরবরাহ করতে হবে। ওই দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির তথ্য যাচাই-বাছাই করবে। যাচাই-বাছাইয়ে তথ্য গরমিল না পেলে কেবল পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সম্ভব। তবে এ প্রক্রিয়াও সম্পন্ন করতে কয়েক বছর লেগে যাবে।

এনবিআর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান বলেন, বাণিজ্যের আড়ালে এ দেশে ৮০ শতাংশের বেশি অর্থ পাচার হয়। এভাবে অর্থ পাচার রোধ করা নিয়ে দেশি-বিদেশি সংস্থার সঙ্গে কাজ করছে এনবিআর। সূত্র- মানবজমিন

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন