খেলাপী ঋণ ও পুনতফসিলে ডুবছে সরকারি ব্যাংক

  16-08-2017 08:46AM


পিএনএস, নিজস্ব প্রতিবেদক: খেলাপী ঋণ বেড়েছে ২১ শতাংশ, লোকসানী শাখা ৫৩৩টি, আদায়ের সিংহভাগই কাগুজে।
ঋণ বিতরণ ও আদায়ের ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে বেকায়দায় রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বড় ৪ বাণিজ্যিক ব্যাংক। এই খাতের ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচকের অবস্থার ক্রমশ খারাপ হচ্ছে। আগের বিতরণ করা ঋণগুলোর খেলাপী হওয়ার পরিমান আরও বাড়ছে। খেলাপী ঋণ কমিয়ে আনতে আদায় কার্যক্রম জোরদার করেও শেষ পর্যন্ত নগদ আদায় বাড়ানো যাচ্ছে না। ধারাবাহিকভাবে পুনতফসিলের মাধ্যমে খেলাপী ঋণ নিয়মিত করে তার বিপরীতে কাগুজে আদায় বেশি দেখাচ্ছে। সর্বশেষ হিসেবে পরিচালনা মুনাফা বাড়লেও লোকসানী শাখার সংখ্যা অনেক বেশি রয়েছে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন চার ব্যাংকের।

ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে কেন্দ্রীয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জুন পর্যন্ত আর্থিক প্রতিবেদন বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাচ্ছে ব্যাংকগুলো। এখন পর্যন্ত খেলাপী ঋণ, লোকসানী শাখা, পুনতফসিল ও নগদ আদায়ের হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে পারেনি বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে সোনালী, অগ্রণী, জনতা ও রূপালী ব্যাংক থেকে সংগৃহীত তথ্যে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এই ব্যাংকগুলোর খেলাপী ঋণের পরিমান দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ২৮৩ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে যা ছিল ২২ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপী ঋণ বেড়েছে ২১ শতাংশ। পরিচালনায় লোকসান করেছে ৫৩৩টি শাখা। খেলাপী ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলোর আদায় হয়েছে ৩ হাজার ৪০৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে নগদ আদায় মাত্র ১ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা টাকা। অর্থাৎ ব্যাংকগুলো যে আদায় দেখিয়েছে তার ৬০ শতাংশ প্রকৃতপক্ষে আদায় নয়। নিয়মানুসারে খেলাপী ঋণের সুদকে আয় হিসেবে দেখানো যায় না। কিন্তু সামন্য কিছু নগদ অর্থ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে খেলাপী ঋণকে নিয়মিত করা ওই ঋণগুলোর পুরো সুদকে আদায় হিসেবে দেখানো হয়েছে। এছাড়া মাফ করে দেওয়া সুদকে আদায় হিসাবে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ আদায় হিসেবে যে অর্থ দেখানো হয়েছে তার সিংহভাগই প্রকৃত খাতার হিসাব-নিকাশ মাত্র।

সোনালী ব্যাংক : দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক ব্যাংক এটি। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত হিসেবে ব্যাংকটি ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে ৩৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। অর্থাৎ ঋণ বিতরণ করতে না পারায় সংগৃহীত আমানতের ৬৩ শতাংশই অলস পড়ে রয়েছে। বিতরণকৃত ঋণের মধ্যে খেলাপী হয়ে গেছে ১১ হাজার ৪৪২ কোটি টাকা। গত বছরে জুনে এই পরিমান ছিল ৯ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে খেলাপী ঋণ বেড়েছে সাড়ে ২২ শতাংশ। গত বছরে জুনে ব্যাংকটির পরিচালনায় ৩৪৭ কোটি টাকা লোকসান হলেও এই বছরে মুনাফা হয়েছে ২৪৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটির আদায় ৬০৩ কোটি টাকা থেকে কমে হয়েছে ৪৮৮ কোটি টাকা। তবে মোট আদায় কমলেও নগদ আদায় ৩৭৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০৩ কোটি টাকা। অর্র্থাৎ গণহারে খেলাপী ঋণ পুনতফসিলের নীতি থেকে সরে এসেছে ব্যাংকটি। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটির লোকসানী শাখা দাঁড়িয়েছে ২৮৫ টিতে।

সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, কয়েক বছর আগে ব্যাংকিং খাতে দুর্নীতির সুনামী বয়ে গেছে। তার রেশ এখনও রয়ে গেছে। সেটি কাটিয়ে উঠতে আমরা চেষ্টা করছি। কিন্তু আশানুরুপভাবে ঋণ বিতরণ বাড়াতে পারছি না বিভিন্ন কারণে। প্রচুর অলস তারল্য থাকায় আয় বাড়ানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে আদায় বাড়িয়ে ভালো মুনাফার ধারায় ফিরে আসতে চায়। সেই আদায় অবশ্যই নগদ আদায়। পুনতফসিল বা অন্য কোন উপায়ের আদায়ে আমি বিশ্বাসী নই।

জনতা ব্যাংক : আকারে দ্বিতীয় হলেও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে আর্থিক সূচকের দিক থেকে সবচেয়ে ভালো জনতা ব্যাংক। অন্য তিনটির বাড়লেও এই ব্যাংকের খেলাপী ঋণ সাড়ে ৫’শ কোটি টাকা কমেছে। চলতি বছরে জুনে খেলাপী ঋণ ৫ হাজার ৯১৪ কোটি টাকা থেকে কমে ৫ হাজার ৩৭১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। ব্যাংকটির লোকসানী শাখাও সবচেয়ে কম ৫৮টি। তবে ব্যাংকটির মোট আদায় বাড়লেও নগদ আদায় কমেছে। বেশির ভাগই কাগুজে আদায়। জুন পর্যন্ত ১ হাজার ২৮১ কোটি টাকা আদায় করেছে; এর মধ্যে নগদ আদায় মাত্র ৩৩৯ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে নগদ আদায় ছিল ৫৬৬ কোটি টাকা। এই বছর যে আদায় দেখানো হয়েছে তার সাড় ৭৩ ভাগই পুনতফসিল ও সুদ মওকুফ। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি ৬৪ হাজার ৯৭৪ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে ৪২ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। পরিচালন মুনাফা ৩২৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে জুনে হয়েছে ৪০৪ কোটি টাকা।

অগ্রণী ব্যাংক : ব্যাপকভাবে ঋণ পুনতফসিল ও সুদ মওকুফ করে খেলাপী ঋণ কমাতে পারেনি অগ্রণী ব্যাংক। উল্টো গত বছরের তুলনায় খেলাপী ১৪ শতাংশ বেড়ে হয়েছে ৫ হাজার ৭০০ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে খেলাপী ঋণ ছিল ৪ হাজার ৯৯২ কোটি টাকা। জুনে খেলাপী ঋণ থেকে মোট আদায় হয়েছে ১ হাজার ২১৮ কোটি টাকা। এরমধ্যে নগদ আদায় মাত্র ৩৯০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিপুল পরিমান ঋণ পুনতফসিল ও সুদ মওকুফ করায় আদায়ের ৬৮ ভাগই কাগুজে। ব্যাংকটির পরিমান মুনাফা ১০৫ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে ৩০১ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে। জুন পর্যন্ত ব্যাংকটি ৫১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে ২৮ হাজার ৯ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। জুন পর্যন্ত হিসেব ব্যাংকটির লোকসানী শাখা রয়েছে ১১৬টি।

অগ্রণী ব্যাংকের এমডি শামস-উল-ইসলাম খেলাপী ঋণ ব্যাংকিং খাতের জন্য বিরাট সংকট। অগ্রনী ব্যাংকের খেলাপী ঋণও অনেক বেশি। এটি অতীত থেকে প্রাপ্ত সংকট। খেলাপী ঋণ কমানোর জন্য আদায় কার্যক্রম অনেক গুণ বাড়ানো হয়েছে। কর্মকর্তাদের আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দিয়েছি। আদায়ভালো হওয়ায় পরিচালনা মুনাফা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩ গুণ বেড়ে ৩০১ কোটি টাকা হয়েছে।

রূপালী ব্যাংক : হিসাবায়নের কারসাজিতে আগে আর্থিক সূচকে ভালো অবস্থানে ছিল রূপালী ব্যাংক। কিন্তু সঠিকভাবে হিসাব করতে গিয়ে গোপন রাখা খেলাপী ঋণ ধরা পড়তে থাকে। যার ফলে প্রতিনিয়ত বাড়ছে খেলাপী ঋণ। এক বছরের ব্যবধানে ব্যাংকটির খেলাপী ঋণ দ্বিগুনেরও বেশি বেড়ে হয়েছে ৪ হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা। গত বছরের জুনে যা ছিল ২ হাজার ৩৬০ কোটি টাকা। তবে পুনতফসিল ও সুদমওকুফের ধারা থেকে বের হতে পারেনি ব্যাংকটি। যার ফলে ৪১৮ কোটি টাকা মোট আদায়ের মধ্যে নগদ আদায়ের পরিমান ২১৫ কোটি টাকা। আদায়ের প্রায় অর্ধেক নগদ টাকার বিকল্প কাগুজে আদায়। ব্যাংকটি জুন পর্যন্ত ৩১ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করেছে। ঋণ বিতরণ করেছে ১৮ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। এক বছরে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা বেড়েছে ৬ গুণ। গত বছরে জুনে মুনাফা ছিল ৩৫ কোটি টাকা এ বছরের জুনে হয়েছে ২০৮ কোটি টাকা। লোকসানী শাখার সংখ্যা ১৩৯টি থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৭৪টিতে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন