বাংলাদেশে কি আরও নতুন ব্যাংক দরকার?

  01-11-2017 02:30PM

পিএনএস ডেস্ক: দেশে বর্তমানে ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংক চালু রয়েছে। তবে সরকার মনে করে, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আরও ব্যাংক প্রয়োজন। তাই বেশকিছু নতুন ব্যাংককে অনুমোদন দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। যদিও সম্প্রতি চালু হওয়া ৯টি নতুন ব্যাংকের কার্যক্রম নাজুক থাকায় ইতোমধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে এই খাতে।

এর মধ্যে নতুন দুটি ব্যাংককে অনুমোদন দিতে ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চিঠি দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এছাড়া সরকারি কয়েকটি সংস্থা আর জ্যেষ্ঠ কয়েকজন কর্মকর্তা নতুন ব্যাংকের অনুমোদন চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে প্রস্তাব রেখেছেন।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘নতুন ব্যাংক চালুর বিষয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। দেশের অনেক মানুষ এখনও ব্যাংকিং সেবার বাইরে আছে। বর্তমানে যেসব ব্যাংক প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না সেগুলোকে একীভূত করতে আমরা আইন হালনাগাদ করার উদ্যোগ নিয়েছি।’

তবে অর্থমন্ত্রীর এ বক্তব্যের বিরোধীতা করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ ড. সালেহ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘এ মুহূর্তে নতুন ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়া সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় বিদ্যমান ব্যাংকগুলো যথেষ্ট। এগুলোর কর্মক্ষমতা বাড়ানোর দিকেই বরং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া উচিত।’

দেশে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ ও দক্ষ জনবল নেই বলে মন্তব্য এই অর্থনীতিবিদের। তার ভাষ্য, ‘এত ব্যাংকের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও মনিটরিং করতে গিয়ে ইতোমধ্যে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।’

একই অভিমত অর্থনীতিবিদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এবি মির্জা আজিজুল ইসলামের । তিনি বলেছেন, ‘দেশে নতুন ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। নতুন ব্যাংকের কথা না ভেবে বিদ্যমান ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার কথা ভাবা উচিত।’

সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকে ৮০টি নতুন ব্যাংকের আবেদন জমা পড়ে আছে। যদিও কোনোটিকেই এখনও অনুমোদন দেওয়া হয়নি, তবুও প্রস্তাবিত এসব ব্যাংকের বিনিয়োগকারীরা বর্তমান সরকারের সময়কালে লাইসেন্স পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী।

এ বছর একটি জরিপ পরিচালনা করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। এতে দেখা যায়— ৯৫ শতাংশ ব্যাংকার মনে করেন, দেশে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে নতুন কোনও ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। আবার কেউ কেউ বলেছেন, বাংলাদেশে এমনিতেই প্রয়োজনের তুলনায় বেশি ব্যাংক আছে। তাই কয়েকটি ব্যাংক কমিয়ে দেওয়া উচিত।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ‘কয়েক বছর আগেও রাজনৈতিক বিবেচনায় কয়েকটি ব্যাংককে লাইসেন্স দেওয়া হয়। সেগুলো ইতোমধ্যে মুদি দোকানে পরিণত হয়েছে! কারণ পরিচালক, তাদের বন্ধু ও পরিবারের সদস্যরা সব বিষয়েই হস্তক্ষেপ করে।’


নতুন ব্যাংকের আবেদন করেছেন যারা
‘বাংলা ব্যাংক’ নামের একটি ব্যাংকের লাইসেন্স পেতে বেঙ্গল গ্রুপ আবেদন জমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। গ্রুপটির চেয়ারম্যান মোরশেদ আলম বর্তমান ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য। এছাড়া চট্টগ্রামে থাকা সন্দ্বীপের ব্যবসায়ী এমএ কাশেম ‘পিপলস ইসলামী ব্যাংক’ খোলার জন্য আবেদন করেছেন। সূত্র জানিয়েছে, এ ব্যাংক দুটিকে লাইসেন্স দিতে অর্থমন্ত্রী নিজে প্রধানমন্ত্রী ও গভর্নরের কাছে পৃথক চিঠি দিয়েছেন।

বেঙ্গল গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মো. জসিম উদ্দিন বলেন, “আমরা একটি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন চেয়েছি, কিন্তু এখনও কোনও সাড়া পাইনি। আমরা জানতে পেরেছি, অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগকারীদের যৌথ উদ্যোগে ‘কোরিয়া-বাংলা ব্যাংকে’র অনুমোদন চেয়ে আবেদন করা হয়েছে।”

পেশাজীবীদের জন্য ব্যাংক
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নির্দিষ্ট পেশাজীবীদের জন্য চালু হয়েছে কয়েকটি ব্যাংক। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ট্রাস্ট ব্যাংক লিমিটেড ছাড়া কোনোটাই সুবিধাজনক অবস্থায় নেই। এসবের পরও বাংলাদেশ পুলিশের জন্য শিগগিরই একটি ব্যাংককে অনুমোদন দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকে জমা পড়া আবেদনের তালিকা অনুযায়ী, পৃথক ব্যাংকের অনুমোদন চেয়ে আবেদন করেছে বাংলাদেশ বিমান ও নৌবাহিনী। এছাড়া সরকারি চাকরিজীবীরা নিজেদের কল্যাণে ‘সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংক’ থেকে লাভবান হতে চান।

কোনও নির্দিষ্ট পেশার মানুষদের জন্য ব্যাংকের অনুমোদন দেওয়ার কোনও যুক্তি নেই বলে মন্তব্য এবি মির্জা আজিজুল ইসলামের। তার মতে, ‘এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের ১৯টি ক্যাডারের চাকরিজীবীরা পৃথক ব্যাংকের অনুমোদন চাইবে। এটা এখনই বন্ধ করা উচিত।’

নির্দিষ্ট পেশাজীবীদের জন্য ব্যাংক দেওয়ার বিরোধীতা করেছেন বিআইবিএম-এর অধ্যাপক মো. ইয়াসিন আলীও। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ও বিদ্যমান ব্যাংকের সংখ্যা বিবেচনায় বিভিন্ন পেশার জন্য আলাদা করে এখন নতুন ব্যাংককে অনুমোদন দেওয়ার কোনও প্রয়োজনীয়তা নেই।’

এই অধ্যাপক আরও বলেন, ‘অনাবাসী বাংলাদেশিদের কথা মাথায় রেখে তিনটি ব্যাংক চালু হয়েছিল। তাদের বিশ্বাস ছিল, এর মাধ্যমে দেশে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু তারা তা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এছাড়া প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক আর কর্মসংস্থান ব্যাংকও এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে।’

এ ধরনের বিশেষায়িত ব্যাংক চালুর পরিবর্তে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন ইয়াসিন আলী। একইসঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সুপারভিশনও নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

নতুন ব্যাংকগুলোর টিকে থাকার সংগ্রাম
দেশে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে ২০১১ সালে একটি জরিপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে উল্লেখ করা হয়, দেশের অর্থনীতির আকারের তুলনায় অনেক বেশি ব্যাংক রয়েছে। এরপরও সরকারের চাপ থাকায় ৯টি নতুন ব্যাংককে অনুমোদন দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এগুলোর সব বিনিয়োগকারীই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সম্পর্কিত।

ব্যাংক ৯টি হলো— মেঘনা ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংক, মধুমতি ব্যাংক, এনআরবি ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক, সাউথ-বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক, দ্য ফার্মার্স ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক।

গত বছর বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আধা-সামরিক বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) জন্য সীমান্ত ব্যাংকের লাইসেন্স দিয়েছে।

বিআইবিএম-এর অধ্যাপক মো. ইয়াসিন আলী বলেন, ‘সবশেষ ৯টি ব্যাংককে অনুমোদন দেওয়ার দরকার ছিল না। এগুলো এখনও প্রতিযোগিতায় টিকতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে ও বলার মতো প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। তাই নতুন ব্যাংক চালুর কোনও যৌক্তিকতা নেই। তবে যেসব এলাকায় ব্যাংক নেই সেইসব স্থানে বিদ্যমান ব্যাংকের শাখা খোলা যেতে পারে।’

নতুন চালু হওয়া ব্যাংকগুলোর কার্যক্রম মূল্যায়ন করতে বিআইবিএম থেকে সম্প্রতি একটি জরিপ চালানো হয়। এতে দেখা গেছে, ৯টি ব্যাংকই গ্রাহকদের টাকা সংকটে রেখে বেপরোয়াভাবে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এছাড়া গত দুই বছরে তাদের অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে খেলাপী ঋণের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সম্প্রতি নতুন চালু হওয়া ফার্মার্স ব্যাংককে আর্থিক খাতের জন্য ‘ঝুঁকি’ বলে অভিহিত করেছে। ইতোমধ্যে চার বছর বয়সী ব্যাংকটি উচ্চ সুদ হারে গ্রাহক ও অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রে দুর্নাম কুড়িয়েছে। যদিও এসব ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা ব্যাংকটির নেই।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন