আম রফতানিতে ধস

  24-07-2018 08:12AM


পিএনএস ডেস্ক: বিদেশে আম রফতানিতে এ বছর ধস নেমেছে। আম রফতানির পথে চলতি মওসুমে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পদ্ধতি আরোপের সীমাবদ্ধতাই প্রধান অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞ মহল। যার ফলে সারা দেশে এ পর্যন্ত ২৩৫ টন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে মাত্র ২০ মেট্রিকটন আম বিদেশে রফতানি হয়েছে। অথচ ২০১৬ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ১৫০ টন ব্যাগিং আম রফতানি হয়েছিল। নিরাপদ বিষমুক্ত ও রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনে এ জেলার চাষিরা অনেক দক্ষ হলেও কন্ট্রাক্ট ফার্মিং নামক বিধিবদ্ধতার জাঁতাকলে রফতানিতে সুযোগ পাচ্ছেন না চাষিরা। কন্ট্রাক্ট ফার্মিং এমন একটি ব্যবস্থার নাম যার আওতায় শুধু চুক্তিভিত্তিক চাষি থেকে আম রফতানির জন্য বেছে নেয়া হয়।

বাংলাদেশী আম ২০১৫ সালে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় রফতানি শুরু হয়। রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনের প্রচেষ্টা প্রায় এক যুগ আগে থেকেই চলমান ছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। এরই মধ্যে পণ্য রফতানি ও সংরক্ষণের লক্ষ্যে ফ্রুুট ব্যাগিং প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা শুরু হয়। গবেষণাটি সফল হলে ২০১৫ সালে প্রথম বারের মতো বিজ্ঞানীরা স্বপ্ন দেখেন দেশীয় আম রফতানির। চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্র তথা আম গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন বিজ্ঞানী ড. শরফ উদ্দিনের গবেষণা লব্ধ ব্যাগিং প্রযুক্তির আম পরীক্ষামূলক রফতানি করা সম্ভব হয় ইউরোপের কয়েকটি দেশে। তারপর থেকে আমচাষিরা রফতানিযোগ্য আম উৎপাদনে ব্যাপক আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কিন্তু গত বছর মওসুমের শুরুতেই ইউরোপীয় ইউনিয়ন জানিয়ে দেয় কন্ট্রাক্ট ফার্মিং ছাড়া আম নেয়া হবে না। আম সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের কাছে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বিষয়টি পরিচিত নয়। এ সময় বাংলাদেশ ফল ও সবজি রফতানিকারক সমিতির উদ্যোগে কিছু আমচাষিকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া ২১ চাষির নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর স্থানীয় কৃষি অফিস তালিকাবদ্ধ আমচাষিদের উৎপাদন প্রক্রিয়াটি তদারকি করেন। ২০১৬ সালে দেশে প্রথমবারের মত ৬৬৫ টন আম সফলভাবে রফতানি হয়। যার মধ্যে শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকেই ছিল ১৫০ টন ব্যাগিং আম। প্রত্যেকটি চালানে একজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, সংশ্লিষ্ট কৃষি অফিসার, আমগবেষক ও জেলা প্রশাসকের স্বাক্ষর দ্বারা আম পাঠানো হয়।

এর পর থেকে আমচাষি, আমব্যবসায়ী, রফতানিকারক ও আমগবেষক সবাই নিশ্চিত হন বাংলাদেশের ভালো জাতের আম উত্তম কৃষিপদ্ধতির মাধ্যমে উৎপাদন করলে এবং শেষে ফ্রুট ব্যাগিং প্রযুক্তির ব্যবহার হলে সহজেই রফতানি করা সম্ভব হবে। ২০১৭ সালে শুরু হলো ব্যাপক প্রস্তুতি। সংযোগ চাষির সংখ্যা বাড়িয়ে তিনশোর মতো করা হয় এবং দেয়া হয় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। এই তালিকাবদ্ধ আমচাষিদের মনিটরিংয়ে একজন দক্ষ কৃষিবিদ নিয়োগ দেয়া হয়। আম সংগ্রহের ২০-২৫ দিন আগে একটি বিশেষজ্ঞদল আম উৎপাদনকারী এলাকা পরিদর্শন করে আমের গুণগতমান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন।

এ ছাড়া আম রফতানির দিনক্ষণ বিষয়ে ধারণা দেন। সে বছর চাষিরা প্রায় পৌনে ৩ কোটি আমে ব্যাগিং করেন। ধারণা করা হয় ১০ হাজার টন আম রফতানি সম্ভব হবে। কিন্তু তা হয়নি। আম রফতানির পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনা হলো। ২০১৬ সালে আমচাষিরা আমবাগানে আম সর্টিং, গ্রেডিং ও প্যাকিংয়ের কাজটি সম্পন্ন করে সরাসরি বিমানবন্দরে পাঠিয়ে ছিলেন। কিন্তু এবার আম চাষির বাগান থেকে সংগ্রহ করে ঢাকার শ্যামপুরে কেন্দ্রীয় প্যাকেজিংয়ের একটি ঠিকানায় পাঠাতে বলা হলো। যেখানে আম সর্টিং, গ্রেডিং ও প্যাকিংয়ের কাজটি সম্পন্ন করে পরে বিমানবন্দরে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ফলে জটিলতা দেখা দেয়। রফতানিকারকেরা যে পরিমাণ আম চাষিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতেন এর ৭০-৮০ ভাগ আম বাদ দেয়া শুরু হয়। ফলে খুব কম সময়ের মধ্যেই রফতানিকারকেরা আম রফতানিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। চাষির আম বাগানে পাকতে থাকে। পরে জানানো হয় পাকা আম রফতানি করা যাবে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নির্ধারিত সময়ে চাষিদের কাছ থেকে আম সংগ্রহই করা হয়নি। সাতক্ষীরা ছাড়া প্রত্যেক জেলাতে ১০ দিন পর রফতানিকারকদের পাঠানো হয় ফলে আম গাছেই পেকে নষ্ট হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র অভিযোগ করে। এ সময় এক আমচাষি রাজশাহী অ্যাগ্রো ফুড প্রডিউসার সোসাইটির আহবায়ক আনোয়ারুল হক প্রধানমন্ত্রীর এসডিজি-বিষয়ক সমন্বয়ক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন। তদন্ত শেষে চলতি মওসুমের আম রফতানির জন্য সুপারিশমালা সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়ে দেন। তৎকালীন উদ্ভিদ সঙ্ঘনিরোধ উইংয়ের কর্মকর্তারা জানান, এবার ব্যাগিং পদ্ধতিতে চাষ করা আম রফতানির জন্য অগ্রাধিকার দেয়া হবে। এ বছর আম রফতানি কমে দাঁড়ায় ৩২৪ টনে।

পরে ২০১৮ সালের জন্য রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৩১২ আমচাষির সাথে ২৮ জন রফতানিকারকের চুক্তি সম্পাদিত হয়। তবে অজ্ঞাত কারণে ১০-১২ চাষির সাথে সাদা কাগজে চুক্তি সম্পাদিত হয়। অথচ রফতানিকারকদের সাথে আমচাষিদের আইনি বাধ্যবাধকতাসম্পন্ন কাগজে চুক্তি সম্পন্ন করতে হবে বলে সূত্রে জানা যায়। এ চুক্তিতে কোন জাতের আম কোন সময়ে কত টাকা কেজি দরে ক্রয় করা হবে তা উল্লিখিত হতে হবে। চুক্তিটি হওয়ার কথা ছিল আগস্ট-সেপ্টম্বরে। কিন্তু হয়েছে ফেব্রুয়ারিতে। এতে অনেক নিয়মকানুন অনুসৃত হয়নি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখানে উল্লেখ্য, চলতি বছর রফতানির প্রস্তুতিস্বরূপ চুক্তিবদ্ধ চাষিরা প্রায় ৮ কোটি আমে ব্যাগিং করেছিলেন।
শিবগঞ্জ ম্যাংগো অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল খান শামীম জানান, আম রফতানিতে চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে আমরা হচ্ছি থার্ড পার্টি। রফতানিকারকদের মর্জির ওপর নির্ভর করতে হয়। এতে চাষিদের স্বার্থ সংরক্ষিত হয় না। রফতানিকারকরা সরকারি তালিকাভুক্তির জন্য নিয়মমাফিক একটি নির্ধারিত ফরমে স্বাক্ষর নেন। তবে এতে কোন আম কত তারিখে যাবে তা লিপিবদ্ধ থাকে না।

তিনি আরো জানান, কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের কারণে আমচাষি রফতানিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। ভারত ও পাকিস্তান থেকে বিশেষ প্রসেসিং ব্যবস্থার মাধ্যমে আম রফতানি করা হয়। সে রকম মেশিন স্থাপিত হলে রফতানিতে নতুন মাত্রা যোগ হবে।

তিনি অভিযোগ করেন, অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশে আম উৎপাদনে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শীর্ষ স্থানীয় হলেও সরকারি রফতানি জেলাওয়ারি তালিকায় ১২-১৩ নম্বরে রাখা হয়।
বাংলাদেশে ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতির উদ্ভাবক ও আম বিজ্ঞানী ড. শরফ উদ্দিন আম রফতানির ক্ষেত্রে কন্ট্রাক্ট ফার্মিং পদ্ধতিটি সময় মতো শুরু করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন।
তিনি জানান, রফতানির সাথে সংশ্লিষ্ট সবার সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজটি করতে হবে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আলাদা মনিটরিং টিম গঠন করতে হবে। যারা আম রফতানির বিষয়টি মনিটরিং করবে। এতে আম রফতানি বাধামুক্ত হবে এবং জটিলতা হ্রাস পাবে।

তিনি জানান, দেশে ২০১৬ সালে ৬৬৫ টন দিয়ে আম রফতানির দুয়ার উন্মোচিত হয়। এর মধ্যে ১৫০ টন ছিল চাঁপাইনবাবগঞ্জের ব্যাগিং আম। ২০১৭তে ৩২৪ টন আম রফতানি হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা হতে ৩১ টন, মেহেরপুর হতে ১২ টন, রাজশাহী হতে ২৯ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে ২ টন। তবে এর মধ্যে ৭৪ টন আম চাষিদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়। বাকি আম স্থানীয় বাজার হতে অত্যন্ত কমমূল্যে সংগ্রহ করা হয়। চলতি মওসুমেও ২০১৮ সালে আমের রফতানি আরো কমেছে। সর্বশেষ ২৩৫ টন রফতানির খবর প্রচারিত হয়েছে। এর মধ্যে সাতক্ষীরা হতে ২৭ টন, রাজশাহী হতে ১৯ টন এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ হতে মাত্র ৩ টন আম রফতানি হয়েছে বলে জানা যায়। ৪৯ টন আম আমচাষিদের কাছ থেকে নেয়া হয়েছে। বাকি আম স্থানীয় বাজার থেকে ক্রয় করে রফতানি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে প্রশ্ন উঠেছে এটি কোন ধরনের কন্ট্রাক্ট ফার্মিং। অথচ আমচাষিদের আম গাছে পচে গেছে এবং ভালোমানের আম পানির দরে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন চাষিরা। চলতি মওসুমে কন্ট্রাক্ট ফার্মিংয়ের ৩১২ জন আমচাষির কাছ থেকে পরিমাণ মত আম রফতানি করা সম্ভব হলে প্রায় ১৫০০ টন অনায়াসে রফতানি করা সম্ভব হতো। চলতি মওসুমে জাপান, সুইজারল্যান্ড হতে আমদানিকারকেরা আম নেয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কন্ট্রাক্ট ফার্মিং সিস্টেমের বাধ্যবাধকতায় তা সম্ভব হয়নি। সময়মতো আম রফতানি হলে ওই সময়ে স্থানীয় আমবাজারে চাঙ্গাভাব বিরাজ করত। আমচাষিদের কষ্টের আম পানির দামে বিক্রি করতে হতো না। বর্তমানে আম রফতানির প্রতিটি ধাপে জটিলতা বিরাজ করছে যা দূর করা সম্ভব না হলে আগামীতেও এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলেও মতপ্রকাশ করেন তিনি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হামিম রেজা জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশী আমের ভালো বাজার রয়েছে। চলতি বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের দুই তরুণ কাতারে ৫০ টন ফজলি আম সফলভাবে রফতানি করেছেন। তিনি আম রফতানিতে বিরাজিত সমস্যা দূর করে রফতানিপ্রক্রিয়া সহজ করার আহ্বান জানান। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের রুমন ও রুমি নামে ওই দুই তরুণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে এ আম কাতারের আল রাফেদিন ফর ভেজিটেবল ফ্রুটস অ্যান্ড ফুড, আল আজিজিয়ায় প্রেরণ করেন।

এ দিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম রফতানির পথে একটি চক্রের নেতিবাচক মনোভাব কাজ করছে। রফতানির সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারি একটি দফতরে থেকে ওই চক্রটি আঞ্চলিকতার টানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকে রফতানি অযোগ্য ঘোষণার প্রচেষ্টায় থাকে। এদের নানা প্রচেষ্টায় অন্য জেলা থেকে নন ব্যাগিং আম নিয়ে রফতানি করা হচ্ছে। এসব নন ব্যাগিং আমে পুরোমাত্রায় কোয়ারাইন্টাইন ঝুঁকি বলবৎ থাকে। অথচ চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিশ্বসেরা ব্যাগিং আম রফতানিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন