রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পরিচালকদের দক্ষতা বাড়ানোর উদ্যোগ অর্থ মন্ত্রণালয়ের

  17-11-2018 12:54AM

পিএনএস ডেস্ক: অনিয়ম, দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় সংকটে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাত। বিশেষ ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে সঠিক গ্রাহককে ঋণ না দেয়ায় এ খাতে বাড়ছে খেলাপি ঋণ। ঋণ দিয়ে সেটা ফেরত না পাওয়ার ঝুঁকি রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে প্রকট। অযোগ্য গ্রাহককে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে নিয়োগ দেয়া পরিচালকদের হস্তক্ষেপেরও অভিযোগ রয়েছে। তাই এবার প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক পরিচালকদের ব্যাংক কার্যক্রমে দক্ষ করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

এরই অংশ হিসেবে আগামী ১৮ নভেম্বর শুরু হচ্ছে পরিচালকদের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ক্যাপিটাল মার্কেট (বিআইসিএম) মিলনায়তনে পাঁচদিনব্যাপী এ প্রশিক্ষণ কার্যক্রম শেষ হবে আগামী ২২ নভেম্বর। ১৮ নভেম্বর বিআইসিএম মিলনায়তনে এ কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব মো. আসাদুল ইসলামের সভাপতিত্বে এ সময় অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবিরের উপস্থিত থাকারও কথা রয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের ব্যাংক খাতকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে রাজনৈতিক বিবেচনায় পরিচালক নিয়োগ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করতে হবে। পরিচালক নিয়োগে গলদ রেখে এসব প্রোগ্রাম হতে নিয়ে তেমন কোনো লাভ হবে না। বরং দল-মত নির্বিশেষে যোগ্য লোককে এ পদে নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ তাদের।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সূত্র জানায়, প্রতিদিন পরিচালকদের প্রশিক্ষণ চলবে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত। প্রশিক্ষণে প্রধান প্রশিক্ষক হিসেবে থাকবেন মহা হিসাব-নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের দুজন ডেপুটি গভর্নর ও কয়েকজন টেকনিক্যাল পার্সন। সোনালী, রূপালী ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকরাও প্রশিক্ষক হিসেবে থাকবেন।

এ কার্যক্রমে প্রশিক্ষক হিসেবে যারা আসবেন তাদের জন্য কিছু সম্মানির ব্যবস্থা থাকলেও পরিচালকদের জন্য কোনো সম্মানি থাকবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. ফজলুল হক বলেন, অনেক সময় বিভিন্ন প্রফেশনের লোককেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তাই তারা ব্যাংক খাতের নানা আইন-কানুন এবং তাদের কার্যপরিধির বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকে না। এসব বিষয়ে হালকা ধারণা দেয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো এ কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর পরিচালকরা ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালায় দক্ষ হয়ে উঠবেন বলেও আশা করেন তিনি।

তবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের নাম প্রকাশ না করার শর্তে অপর এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অনেক সময় রাজনৈতিক বিবেচনায় অযোগ্য লোককে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার। নিয়োগ পেয়ে তিনি আবার অযোগ্য ব্যবসায়ীদের ঋণ দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে চাপ প্রয়োগ করেন। ফলে অযোগ্য ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়ে তা আর পরিশোধ করেন না। এ কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। মূলত প্রশিক্ষণে বিভিন্নভাবে পরিচালকদের বোঝানো হবে যে, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে পরিচালকদের হস্তাক্ষেপ করা উচিত নয়। কে ঋণ পাবেন- সেটা বিভিন্ন ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে ব্যাংকের কর্মকর্তারই ঠিক করবেন। এভাবে যোগ্যদের ঋণ দিলে বিতরণকৃত ঋণ ফেরত বাড়বে। কমবে খেলাপি ঋণের পরিমাণও।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, `এটা মেইনলি পরিচালকদের প্রশিক্ষণ না বলে ওরিয়েন্টেশন বলা দরকার। প্রশিক্ষণ দিয়ে কী করবে? তাদের কি ফিন্যান্স, অ্যাকাউন্টিং শিখিয়ে দেবে নাকি? ওরিয়েন্টেশনের মাধ্যমে তাদের বুঝিয়ে দেয়া যায় যে, ব্যাংকের মূল কাজগুলো কী? আইন-কানুনগুলো কী? বিশেষ করে পরিচালক নিয়োগের পর তাদের কর্তব্য হচ্ছে কমপ্লায়েন্স। ব্যাংকিং বিষয়ে নিয়ম ও প্রবিধানগুলো স্বচ্ছতার সঙ্গে পালন করা, নীতিনির্ধারণী বিষয়ে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত- সেসব বিষয়ে আলোকপাত করা যায়।’

`তারা যেন প্রতিদিনের ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমে না যায়- সেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে। আমার মতে, পরিচালকদের যোগ্যতা, তাদের আচরণ-ভঙ্গিও গুরুত্বপূর্ণ। পরিচালক নির্বাচনের ক্ষেত্রেই যতি গন্ডগোল হয় তাহলে ওরিয়েন্টেশন দিয়ে কাজ হবে না।’

‘আবার পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে একেবারে এক্সপার্টদের দিতে হবে- এমনটিও আমি মনে করি না। যারা ডেভেলপমেন্ট ইকোনমি ও ব্যাংকিং নিয়ে কাজ করে বা লেখালেখি করে বা আর্থিক খাতে চাকরি করেছে, অভিজ্ঞতা আছে; পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে এ ধরনের লোকদের অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। এমনকী যিনি ডাক্তার কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নয়নে কাজ করেছেন, তিনিও নিয়োগ পেতে পারেন। কিন্তু একেবারে কিছুই নেই, হঠাৎ করে উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো লোককে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া ঠিক নয়। তাই সবার আগে পরিচালক নির্বাচন করাটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’


‘একেবারেই রাজনীতিমুক্তভাবে এ খাতে পরিচালক নিয়োগ দেয়া উচিত; রাজনীতি মতাদর্শের হতে পারেন। তাবে সোজা কথা হচ্ছে, বোর্ডরুমে কোনো রাজনীতি থাকতে পারবে না’- মন্তব্য করেন প্রবীণ এ অর্থনীতিবিদ।

উল্লেখ্য, ২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অর্থনীতিবিদ, সনদপ্রাপ্ত হিসাববিদ, আর্থিক বাজার, মুদ্রানীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তি, সাবেক ব্যাংকার, আইনজ্ঞ, ব্যবসায়ী এবং কমপক্ষে একজন নারী পেশাজীবীকে ব্যাংকের পর্ষদ সদস্য করা যাবে। কিন্তু গত ১০ বছরে তা মানা হয়নি, বরং সমাজসেবক আখ্যা দিয়ে রাজনৈতিক অনেক নেতাকর্মীকে পর্ষদ সদস্য হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন