এবি ব্যাংকের স্বেচ্ছাচারিতায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠান

  31-03-2019 02:48AM

পিএনএস ডেস্ক : এবি ব্যাংক অতিমাত্রায় সুদ হার ধার্য, প্রণোদনার দু’কোটি টাকা না দেওয়া, সময়নত ঋণ পুনঃতফসিল না করাসহ নানা অনিয়ম করেছে এঞ্জেলস কম্পোজিট নিটিং ইন্ডাস্ট্রিজ নামে একটি শতভাগ রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানের সাথে। ফলে শিল্প প্রতিষ্ঠানটি কার্যত: বন্ধ হয়ে আছে।

শিল্প প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ থাকায় বেকার জীবনযাপন করছে সংশ্লিষ্ট দুই সহস্রাধিক কর্মকর্তা কর্মচারী। আর প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার এখন দিশেহারা। এ বিষয়ে এঞ্জেলস কম্পোজিট নিটিং ইন্ডাস্ট্রিজের এমডি মোঃ গিয়াস উদ্দিন মুরাদ জানান, ঋণ সমন্বয়ের বিষয়ে নানা দেনদরবার করেও ব্যাংক কোনো ধরণের সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। বরং ব্যাংকের কোপানলে পড়ে এলসি মার্জিনের পুরো অর্থ ঋণ দেখিয়ে এখন খেলাপিতে পরিণত হয়েছে।

অপর দিকে এবি ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান কাইজার আহমেদ চৌধুরি বলেন, আমার সব ফিগার মুখস্থ নেই। তাই এসব বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। তবে আমাদের খেলাপি ঋণ বেড়েছে, এটা ঠিক। এজন্য আমরা প্রভিশনও করেছি।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, প্রথম প্রজন্মের ব্যাংক এবি ব্যাংকের অব্যবস্থাপনা এবং সুশাসনের অভাবেই এমনটা হচ্ছে। বিশেষ করে ব্যাংকের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের ব্যাপক হারে দুর্নীতি ব্যাংকের সার্বিক বেবস্থাপনায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। যার কারণে গ্রাহকদের এমন হয়রানীর শিকার হতে হচ্ছে।

বাংলাদেশ-স্পেন যৌথ মালিকানায় এঞ্জেলস কম্পোজিট নিটিং ইন্ডাস্ট্রিজ রাজধানীর অদূরে টঙ্গীর ভাদামে অবস্থিত। শিল্প প্রতিষ্ঠানটি ১৯৯৮ সাল থেকে বিভিন্ন ব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় পণ্য উৎপাদন ও রফতানি করে আসছে। রফতানি আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে স্পেন, ইতালী, ফ্রান্সসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নামীদামী ব্রান্ডের কাছে পণ্য রফতানি করে।

মতিঝিলের এবি ব্যাংকের প্রধান শাখার মাধ্যমে ২০০৮ সালের ২৭ আগস্ট রফতানি আদেশের বিপরীতে ১১ কোটি টাকার শুধুমাত্র ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র (এলসি) সুবিধা প্রদান করে। সে অনুযায়ী পণ্য রফতানিও হয়। পরের বছর পণ্য রফতানির বিপরীতে প্রাপ্য দুই কোটি টাকার সমমানের ইনসেনটিভের (প্রণোদনা) জন্য (২০০৯ সালে) ডকুমেন্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেয় এনজেল কম্পোজিট। এরপরই শুরু হয় ব্যাংকের নানা অসহযোগিতা। অভিযোগ আছে, এবি ব্যাংক এসব ডকুমেন্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠায়নি। ফলে প্রাপ্য দুই কোটি টাকার সমমানের প্রণোদনা থেকে বঞ্চিত হয় এনজেল কম্পোজিট।

২০১০ সালের শুরুতে রফতানি আদেশের বিপরীতে এলসির লিমিট থাকা সত্তেও রহস্যজনক কারণে এবি ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। এতে চরম বিপাকে পড়ে এনজেল কম্পোজিট। ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করেও ইতিবাচক সাড়া পায়নি। ব্যাংক সুত্র জানায়, মামলাজনিত কারণে উর্ধ্বতন শীর্ষ নির্বাহীরা বিদেশে অবস্থান করায় কোনো এই জটিলতা হয়েছিল।

২০১০-১১ সালে এমন বাস্তবতায় ও বিশ্বব্যাপি মন্দার কারণে এঞ্জেলস কম্পোজিটের কয়েক কোটি টাকার রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে যায়। এক্ষেত্রে গ্রাহকের সহায়তায় সব ব্যাংক এগিয়ে আসলেও এবি ব্যাংক তা করেনি। বরং বাংলাদেশ ব্যাংকের সকল নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে এলসি মার্জিনের পুরো অর্থ সমন্বিত করে উচ্চ সুদহারে ১৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা ‘ফোর্স লোন’ সৃষ্টির মাধ্যমে এনজেল কম্পোজিটের বিপরীতে দেনা দেখায়। পুনঃতফসিলের (রি-সিডিউল) নিয়ম থাকলেও প্রতিষ্ঠানটিকে এবি ব্যাংক সে সুযোগ দেয়নি। এমনকি ১২/১৩ শতাংশ সুদ দেয়ার কথা থাকলেও এবি ব্যাংক ২০ শতাংশ উচ্চ সুদ কর্তন করে। এতে এনজেল কম্পোজিটের ঋণের স্থিতি বেড়ে যায়। ফলে চার বছর প্রতিষ্ঠানটি ঋণের বিপরীতে যে টাকা ব্যাংকে জমা দেয়, তা স্থিতি কমাতে পারেনি। এছাড়াও ঋণ রিশিডিউল ২০১১ সালে করার নয়ম থাকলেও তা করেছে চার বছর পরে ২০১৬ সালে।

উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ২০১৬ সালে এনজেল কম্পোজিট কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে শ্রমিকের বেতন-ভাতা পরিশোধের লক্ষ্যে কারখানা চালু রাখে। ২০১৭ সালের শেষ দিকে পৃথক আরেকটি প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় কারখানাটি সচল রাখার উদ্যোগ নেয়। এব্যাপারে ব্যাংকের সঙ্গে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি হয়। চুক্তিতে মালিক ৪০ লাখ টাকা করে প্রদানের জন্য ৬০ কিস্তিতে ঋণ পুন:তফসিল হয়। কিন্তু চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করে কয়েকদিনের মধ্যেই এবি ব্যাংক ৩৬ কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের তফসিল দেয়। এতে সম্ভাবনা জেগে উঠলেও প্রতিষ্ঠানটি নতুন করে বিপাকে পড়ে। এমনি সময়, ২০১৮ সালে এনজেল কম্পোজিট বড় ধরণের দুইটি রফতানি আদেশ পায়। কিন্তু ব্যাংক সহযোগিতা না করায় এলসি দুইটি বাতিল হয়ে যায়।

এঞ্জেলস কম্পোজিটের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গিয়াসউদ্দিন মুরাদ বলেছেন, এবি ব্যাংকের নানামুখী অনিয়ম ও বিধি বহির্ভুত কর্মকান্ডের কারণেই প্রতিষ্ঠানটি চরম বিপাকে পড়েছে। তিনি প্রতিষ্ঠানটি সচল রাখার স্বার্থে ব্যাংকের সংশ্লিষ্টদের শাস্তি ও সুদ মওকুফ সাপেক্ষে মূল ঋণ পুনঃতফসিলের দাবি করেছেন।

এ বিষয়ে এঞ্জেলস কম্পোজিটের সাথা যোগাযোগ করলে এক কর্মকর্তা জানা, আমরা ২০১৭ সালে এক কোটি টাকা দিয়েছি। সেই সাথে অনুরধ করেছে ৫৯ কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দিতে। ব্যাংক সেই মতে আমাদের সাথে চুক্তি করে। কিন্তু পরবর্তীতে তার বিনা নোটিসে চুক্তি ভঙ্গ করে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, ব্যাংকটির অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের ঋণ জালিয়াতিসহ অন্যান্য অনিয়মের ঘটনা বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে রয়েছে। এছাড়াও খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ও প্রভিশন ঘাটতিসহ বিভিন্ন কারণে ইতোমধ্যে ব্যাংকটিতে পর্যবেক্ষক নিয়োগ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু তাতেও গ্রাহকরা খুব বেশি উপকৃত হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, নানা ছলচাতুরতায় গ্রাহকের টাকা লুটপাট হচ্ছে, এসব বন্ধ করতে হবে।

এসব অনিয়মের বিষয়ে এবি ব্যাংকের চেয়ারম্যান কাইজার আহমেদ চৌধুরি’র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমার সব ফিগার মুখস্থ নেই। তাই এসব বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না। তবে গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যাংক সর্বোচ্চ ছাড় দিয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের বিধিনিষেধের ভেতরে থেকেই আমাদের সবকিছু করতে হয়।

পিএনএস/এএ

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন