চরম দুর্দিন ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে

  20-04-2019 09:17AM


পিএনএস ডেস্ক: চরম দুর্দিন শুরু হয়েছে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর। আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজার নির্ভর এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে চরম তহবিল সঙ্কট। আমানত কমে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে তহবিল সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে এসব প্রতিষ্ঠানের ওপর। আগে ব্যাংকগুলো যেখানে তহবিল খাটাতে এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে ধরনা দিতো, এখন ব্যাংকের তহবিলে টান পড়ায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে তহবিল প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এ সঙ্কট মেটাতে বর্তমান বাজারের তুলনায় উচ্চ সুদেও তহবিল জোগাড় করতে পারছে না কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান। সামনে এ সঙ্কট আরো প্রকট আকার নিতে পারে মর্মে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে সহযোগিতা কামনা করেছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান নির্বাহীরা।

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান ও ন্যাশনাল হাউজিং ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও মো: খলিলুর রহমান এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংককে এগিয়ে আসতে হবে। পুনঃঅর্থায়ন তহবিলের আওতায় গৃহায়ন তহবিল আবার চালু করার বিষয়ে বিবেচনা করতে হবে। পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে কর রেয়াত সুবিধায় বন্ড ছাড়ার অনুমতি দিতে হবে। এ বিষয়ে তারা দীর্ঘ দিন ধরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন। তিনি বলেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ আয়কর প্রদান করে সরকারকে। একই সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে। এসব প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়ার অর্থ হলো মুনাফা কমে যাবে। মুনাফা কমে গেলে সরকার রাজস্ব কম পাবে। একই সাথে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হবে। এ জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর চলমান সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

অপর একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডি জানিয়েছেন, বেশির ভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বর্তমানে চরম আর্থিক সঙ্কটে রয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিলের প্রধান উৎস ব্যাংকিং খাতে তহবিল সঙ্কট শুরু হওয়ার পর তাদের ওপরও এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে। আগে ব্যাংকগুলো যেখানে তাদের উদ্বৃত্ত তহবিল বিনিয়োগ করতে না পারায় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে ধরনা দিতো। বিনিয়োগ চাহিদা না থাকায় ব্যাংকগুলোর তহবিল উদ্বৃত্ত ছিল। তখন ব্যাংকগুলো লোকসান কমাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধার দিতো। এতে সুদ হার কমে এই পর্যায়ে তলানিতে নেমে যায়। যেখানে কলমানি মার্কেট থেকে ২ থেকে ৩ শতাংশ সুদে ধার নেয়া যেতো, তখন কোনো কোনো ব্যাংকের পীড়াপীড়িতে ৫ থেকে ৬ শতাংশ সুদে তহবিল সংগ্রহ করা হতো ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে। অনেক সময় কম সুদের আমানত নিয়ে বেশি সুদের আমানত পরিশোধ করত। কিন্তু এখন হচ্ছে এর উল্টো। ব্যাংকিং খাতে আমানত কমায় অনেক ব্যাংকেরই এখন তহবিল সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ কারণে অনেক ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে রাখা তহবিল প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এখানেই বিপত্তি দেখা দিয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে কোনো কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান তহবিল সঙ্কট মেটাতে উচ্চ সুদেও আমানত পাচ্ছে না। বেশি সুদ দিয়ে এক প্রতিষ্ঠান আরেক প্রতিষ্ঠানের আমানতকারীদের বাগিয়ে নিচ্ছে। বছর খানেক আগেও যেখানে সর্বোচ্চ সাড়ে ৭ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করা যেতো, এখন কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান তা সাড়ে ১০ থেকে ১৪ শতাংশ সুদে আমানত নিচ্ছে। আমানত সংগ্রহে অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে সামনে সঙ্কট আরো ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। এ বিষয়টি ইতোমধ্যেই গভর্নরের কাছে তুলে ধরা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, সামনে ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য নানামুখী সঙ্কট দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ, সঞ্চয়পত্রে সুদ হার বেশি হওয়ায় ব্যাংকের আমানত চলে যাচ্ছে সঞ্চয়পত্রে। এতে ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। বিপরীতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দিন দিন বেড়ে চলছে। প্রচলিত ধারা অনুযায়ী আমানতের প্রবৃদ্ধির চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার কথা থাকলেও এটা হচ্ছে উল্টো, যা মোটেও শুভ লক্ষণ নয়। কারণ, নিয়ম অনুযায়ী যে পরিমাণ ঋণ দেয়া হচ্ছে তা উৎপাদনশীল খাতে যাচ্ছে না। ঋণের অর্থ হয় হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হচ্ছে, না হয় গ্রাহক ঋণ নিয়ে অন্য ঋণ পরিশোধ করছে। অর্থাৎ সঠিক কাজে ঋণের অর্থ ব্যবহার করা হচ্ছে না। আর ঋণ সঠিক কাজে ব্যবহার না হওয়ায় আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে। আর আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ায় ব্যাংকিং খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য কমে যাচ্ছে। আগে যেখানে উদ্বৃত্ত তারল্য প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা ছিল। বছরের শেষ সময়ে এসে তা ৭০ হাজার কোটি টাকায় নেমে গেছে, যার বেশির ভাগই সরকারের কোষাগারে ব্যাংকের অর্থ দীর্ঘ মেয়াদের জন্য আটকে গেছে।

এ দিকে কমছে আমানত। এতে ব্যাংকিং খাতে আবারও তহবিল সঙ্কট শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই কিছু কিছু ব্যাংক আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রেপোর মাধ্যমে ধার নিচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর। ইতোমধ্যে টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে কোনো কোনো ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে।

গত বুধবার একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানিয়েছেন, সুদহার তার কাছে এখন মুখ্য বিষয় নয়, তার দরকার নগদ টাকা। প্রয়োজন মেটাতে তিনি ১২-১৩ শতাংশ হারেও তহবিল সংগ্রহ করতে রাজি আছেন। একটি ব্যাংকের এমডি জানিয়েছেন, আগে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জোর করে টাকা রাখা হতো, এখন তারই টাকার সঙ্কট দেখা দিয়েছে। এ কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে টাকা নিয়ে আসছেন। সামনে এ পরিস্থিতি আরো প্রকট আকার দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন ওই এমডি। এমনি পরিস্থিতিতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বিকল্প তহবিল সংস্থান ছাড়া অন্য কোনো উপায় দেখছেন না এ খাতের শীর্ষ নির্বাহীরা। সূত্র: নয়া দিগন্ত

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন