অস্থিরতা ভোগ্যপণ্যের বাজার, নেই নজরদারি

  21-10-2019 06:52PM

পিএনএস ডেস্ক : অর্থের প্রয়োজনে প্রায় সময়ই পণ্যের অতিরিক্ত এসও (সাপ্লাই অর্ডার) বিক্রি করেন আমদানিকারকরা। এর (এসও) বিপরীতে অসংখ্য স্লিপ বিক্রি করে অর্থ তুলে নেন এসওধারীও। এভাবে হাতবদল হয় কাগজের। দাম বাড়তে থাকে পণ্যের। অনেক সময় তা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে ভোক্তাদের ওপর।

কখনো আবার এর উল্টোটাও ঘটে। উল্লেখিত তারিখে পণ্য সরবরাহ পান না এসওধারী। ফলে পণ্য বুঝে পান না স্লিপধারীরাও। অনেক ক্ষেত্রে যতদিনে পণ্য বুঝে পান ততদিনে এর দাম পড়ে যায়। এতে লোকসানে পড়তে হয় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীকে। এতেও অস্থিরতা তৈরি হয় ভোগ্যপণ্যের বাজারে। বহু বছর ধরেই ভোগ্যপণ্যের এ ফাটকা ব্যবসা চলছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে। যদিও এতে নজরদারি নেই কারো।

খাতুনগঞ্জে বহুদিন ধরে এসও ব্যবসায় জড়িত এক ব্যবসায়ী বলেন, প্রতিটি প্রতিষ্ঠানই আমদানি পণ্যের কয়েক গুণ বেশি এসও ছেড়ে দেয় বাজারে। প্রতিষ্ঠানের অর্থের প্রয়োজন হলেই তারা এটা করে। মাঝেমধ্যে আমদানি মূল্যের চেয়ে কম দামেও এসও ছেড়ে দেন আমদানিকারক। কম দামে এসও পেয়ে দ্রুত তা সংগ্রহ করতে থাকেন এসও ব্যবসায়ীরা। এর বিপরীতে সরবরাহ করা স্লিপ কিনে নেন বিভিন্ন ব্রোকার ও ব্যক্তি। অতিরিক্ত এসও প্রবাহের কারণে পণ্যের দামও দ্রুত কমে যায়। টিকে থাকার প্রয়োজনে অনেকে কম দামে পণ্য বিক্রি করে ঋণ পরিশোধের চেষ্টা করেন। লোকসানে পড়ে অনেকে আত্মগোপনেও চলে যান।

জানা গেছে, এসওতে উল্লেখিত সময়ের মধ্যে পণ্য উত্তোলনের শর্ত থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে এরও ব্যত্যয় ঘটে। কাঙ্ক্ষিত দর না পেয়ে অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। এরই মধ্যে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান নতুন এসও বাজারে ছাড়লে চাহিদার অতিরিক্ত সরবরাহ তৈরি হয়, যা ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা তৈরি করে। খাতুনগঞ্জের বিভিন্ন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কয়েক হাজার এসও এখনো অবিক্রীত আছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৮ আগস্ট ইস্যুকৃত সিটি গ্রুপ ৩০ ড্রাম বা ৬ হাজার ১২০ কেজির এসও ছাড়ে বাজারে। ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান খাতুনগঞ্জের মেসার্স আরএম এন্টারপ্রাইজ। একই বছরের ১২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসওর বিপরীতে মিল থেকে পণ্য সংগ্রহের কথা ছিল। কিন্তু গতকাল পর্যন্তও ওই এসও খাতুনগঞ্জে ঘুরছে বিভিন্ন ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের কাছে। গতকাল প্রতি মণ পাম অয়েলের দাম ছিল ২ হাজার ১৩৫ টাকা। ফলে ক্রয়মূল্যের (প্রতি মণ ২ হাজার ৩৫০ টাকা) চেয়ে দাম কম হওয়ায় অবিক্রীতই থেকে যাচ্ছে অধিকাংশ এসও। সাম্প্রতিক সময়ে সিটি গ্রুপসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠান আমদানির বিপরীতে আরো এসও বাজারে ছাড়ায় দাম বাড়ছে না পণ্যটির।

জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, যে পরিমাণ পণ্য আমদানি হয়, সেই পরিমাণ এসও বাজারে বিক্রি করা হয়। তাছাড়া পণ্য আমদানির পর এসও নিয়ে মিলগেটে উত্তোলন করতে গেলেই পণ্য দিতে বাধ্য প্রতিটি রিফাইনারি। রিফাইনারিগুলো অতিরিক্ত এসও বিক্রি করলে ভবিষ্যতে ভোগ্যপণ্যের বাজারে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কোনো কোম্পানিই চায় না প্রতিষ্ঠানের সুনাম নষ্ট হোক।

খাতুনগঞ্জের শীর্ষ ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তা বলেন, নিয়মবহির্ভূতভাবে এসও ছাড়ার সুযোগ থাকায় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান চাইলেই নিজেদের পণ্যের দাম কমানো বা বাড়ানোয় ভূমিকা রাখতে পারে। কয়েক মাস আগেও দাম ঊর্ধ্বমুখী হলে ভোজ্যতেলের কয়েক হাজার এসও বাজারে ছাড়েন আমদানিকারকরা। এখন দাম কমে যাওয়ায় এসব এসও কিনে লোকসানে পড়েছেন অনেকে।

কারো পক্ষ থেকে কোনো নজরদারি না থাকায় এমনটা হচ্ছে বলে জানান ভোগ্যপণ্য ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, ব্যবসায়ীরা নিজস্ব মূলধন কিংবা ব্যাংকঋণ নিয়ে এসও কেনেন। কিন্তু আমদানিকারক শুধু একটি কাগজের এসও বাজারে ছেড়ে শত শত কোটি টাকা সংগ্রহ করেন। এ কারণে রোজা, কোরবানিসহ বিভিন্ন উৎসবকেন্দ্রিক অতিরিক্ত চাহিদার সময়ে মিল মালিকরা সময়মতো পণ্য সরবরাহ দিতে পারেন না। আমদানিকারকদের ইচ্ছামাফিক এসও বিক্রির ওপর তাই নজরদারি থাকা জরুরি।
বিষয়টিতে গভীর অনুসন্ধানের প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. জাফর উদ্দীন। তিনি বলেন, প্রমাণসাপেক্ষে এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দেশে আমদানিনির্ভর ভোগ্যপণ্য ভোজ্যতেল, চিনি, গম একসময় ডিও প্রথায় বিক্রি হতো। এ পদ্ধতিতে আমদানিকারক যে কারো কাছে ডিও বিক্রি করতে পারত। এর মাধ্যমে বাজার কারসাজির সুযোগ থাকায় ২০১১ সালে ডিও বাতিল করে এসও প্রথা চালু করে সরকার। এ পদ্ধতিতে আমদানিকারক মনোনীত ডিলারের কাছে এসও বিক্রি করে থাকে।

ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান বা ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানিকারক কোম্পানিটির বিক্রি করা এসওগুলো দিয়ে নির্ধারিত সময়ে পণ্য সরবরাহ দেয়া সম্ভব কিনা সেটি যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তদারকি না থাকায় এসব এসও বাজারে বিক্রি করার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পণ্য সরবরাহের আগেই বাজার থেকে অর্থ তুলে নেয়। এসব এসও মুষ্টিমেয় কয়েকটি ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের কাছে চলে যাওয়ার পর তারা ব্রোকারদের মাধ্যমে অন্যদের কাছে বিক্রি করে। এসওগুলো দিয়ে পণ্য উত্তোলনের নির্ধারিত সময় থাকলেও যতক্ষণ পর্যন্ত ব্রোকার বা ট্রেডিং প্রতিষ্ঠানের লাভ হচ্ছে না ততদিন পর্যন্ত এগুলো হাতবদল হতে থাকে। শেয়ারবাজারের মতোই এসব এসও পণ্যটির সর্বোচ্চ দামে গিয়ে বিক্রি করা হয়। ফলে মুষ্টিমেয় কয়েকটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান বা ট্রেডারের মাধ্যমে বাজারে পণ্যের দামে কারসাজির সুযোগ থাকে। সূত্র: বণিক বার্তা

পিএনএস/মো. শ্যামল ইসলাম রাসেল


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন