দেড় কোটি টাকার ট্রাক ১১ কোটি!

  28-02-2016 07:29AM


পিএনএস: পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ভূমি এবং যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নকাজে ডাম্প ট্রাক কেনায় ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। নিয়ম অনুযায়ী দরপত্রে কম দর দেয়া সরকারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ না দিয়ে তার আট গুণ বেশি দরদাতা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিয়ে প্রায় ১০ কোটি টাকা লুটপাট করেছেন রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) কয়েকজন কর্মকর্তা। এতে প্রধানমন্ত্রী ও একনেকের নির্দেশনা অমান্য এবং বিপুল সরকারি অর্থ অপচয় হতে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টমহলের।
রাজউক সূত্রে জানা যায়, পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ভূমি এবং যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নকাজের জন্য তিনটি ডাম্প ট্রাক (কমপক্ষে ১৫ টন বহন ক্ষমতাবিশিষ্ট) কেনার জন্য ২০১৪ সালের ২০ অক্টোবর রাজউক উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে। কিন্তু মাত্র একটি দরপত্র গ্রহণযোগ্য হওয়ায় আবার দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। গত বছরের ১ এপ্রিল পুনঃদরপত্র আহ্বান করে রাজউক। এতে ১২টি শিডিউল বিক্রি হলেও জমা পড়ে সাতটি। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, বেসরকারি সংস্থা মার্ক ইন্টারন্যাশনাল ও মেসার্স এইচ ইউ ইন্টারন্যাশনাল ছাড়াও একই গ্রুপের মালিকানাধীন চারটি প্রতিষ্ঠান যথাক্রমে ডেলকো বিজনেস অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড, মেসার্স সোহেল এন্টারপ্রাইজ, মেসার্স বিসমিল্লাহ ট্রেডার্স ও মেসার্স সরকার কবির আহমেদ দরপত্র জমা দেয়। এর মধ্যে সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এক কোটি ৪৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা দর প্রদান করে সর্বনি¤œ দরদাতা হিসেবে বিবেচিত হয় এবং মেসার্স সোহেল এন্টারপ্রাইজ ১১ কোটি ২১ লাখ ২৫ হাজার টাকা দর দাখিল করে।
দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি গত বছরের ১ জুন ও ৮ জুন সভা করে দরপত্র জমা দেয়া সাতটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ছয়টিরই যোগ্যতা নেই উল্লেখ করে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান মেসার্স সোহেল এন্টারপ্রাইজকে যোগ্য বিবেচনা করে তাদের কার্যাদেশ প্রদানের সুপারিশ করে। অথচ সব ধরনের গাড়িসংক্রান্ত কাজ এবং ড্রাম্পার ট্রাক সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের রয়েছে দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা। কিন্তু রাজউকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজকে বলা হয়েছে অনভিজ্ঞ এবং একই কারণে এই সরকারি প্রতিষ্ঠানকে ননরেসপনসিভ করা হয়েছে বলে সূত্র জানিয়েছে।
সূত্র মতে, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ প্রতিটি ডাম্প ট্রাকের একক দর ৪৭ লাখ ৮৭ হাজার টাকা দাখিল করে। একই ডাম্প ট্রাক বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড (বিএমটিএফ) ৩৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা দরে সরবরাহ করছে। ওই একই ক্ষমতাসম্পন্ন ডাম্প ট্রাকের বাংলাদেশী এজেন্ট ইফাদ মোটরস লিমিটেড এর মূল্য রাখছে ৪৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অথচ একই মডেল ও ব্র্যান্ডের ডাম্প ট্রাক সরবরাহের জন্য মেসার্স সোহেল এন্টারপ্রাইজকে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়েছে প্রতিটি তিন কোটি ৭৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকা দরে। টেন্ডারে অংশ নেয়া এবং সর্বনি¤œ দর দেয়ার পরও প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজকে কাজ না দিয়ে তাদের দর থেকে আট গুণ বেশি দরে মোট ১১ কোটি ২১ লাখ ২৫ হাজার টাকায় মেসার্স সোহেল এন্টারপ্রাইজকে কাজ দিয়েছে রাজউক। এতে এক দিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, অন্য দিকে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হবে ৯ কোটি ৭৭ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। অভিযোগ রয়েছে, রাজউকের কিছু কর্মকর্তার সাথে চুক্তি প্রাপ্তি নিয়ে বড় ধরনের লেনদেন হয়েছে।
সরকারি ক্রয়প্রক্রিয়ায় ২০১০ সালের ২ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর একনেক সভার সিদ্ধান্ত ও পিপিআর ২০০৬ ও ২০০৮ অনুযায়ী সরকারি প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্রয় করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রয়োজনীয় মালামাল পাওয়া না গেলে বাইরে থেকে ক্রয় করা যাবে। ২০১৪ সালের ২৩ জুলাই প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দেন সরকারি প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত ও সংযোজিত মালামাল অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ক্রয় করতে হবে, যা ওই বছরের ৭ ডিসেম্বর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় পত্রের মাধ্যমে সব মন্ত্রণালয় ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় বিষয়টি জানিয়ে দেয়। এ নিদের্শনা অনুসারে দেশের সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ক্রয়সংক্রান্ত এমনকি প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি, সচিবালয়ের সব গাড়ি সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে ক্রয় করে থাকে।
প্রধানমন্ত্রীর একনেক সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ ছাড়াও সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পরিচালিত বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনী পরিচালিত খুলনা শিপইয়ার্ড লিমিটেড ও নারায়ণগঞ্জ ডকইয়ার্ড অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস লিমিটেড অত্যন্ত সুনামের সাথে সব ধরনের স্থাপনা নির্মাণ, সব ধরনের যন্ত্রপাতি ও মেশিনারিজ সরবরাহের পাশাপাশি ডাম্প ট্রাকও সরবরাহ করে আসছে। গত বছর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দ্বারা পরিচালিত বিএমটিএফ ৩৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা দরে ৬৫টি ডাম্প ট্রাক বিভিন্ন সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় সরবরাহ করেছে। অথচ এই একই ধরনের প্রতিটি ডাম্প ট্রাক রাজউক কিনছে তিন কোটি ৭৩ লাখ ৭৫ হাজার টাকায়।
এ ব্যাপারে প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী তৌহিদুজ্জামান বলেন, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ সরকারি প্রতিষ্ঠান। প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি থেকে শুরু করে সারা দেশের সরকারি সব অফিসে এখান থেকে গাড়ি সরবরাহ করা হয়। তাই প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজের যোগ্যতা নেই প্রশ্ন তোলার কোনো সুযোগ নেই। কোনো মডেল পছন্দ না হলে যে মডেল প্রয়োজন তা জানিয়ে চিঠি দিলেই আমাদের সরবরাহ করার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু রাজউক আমাদের তা জানায়নি।
এ ব্যাপারে রাজউকের চেয়ারম্যান জি এম জয়নাল আবেদীন ভুঁইয়া বলেন, প্রগতি ইন্ডাস্ট্রিজ থেকে গাড়ি কেনা বাধ্যতামূলক নয়, তবে অগ্রাধিকার দেয়ার নিয়ম রয়েছে। তিনি আরো বলেন, প্রগতির ডাম্প ট্রাক সরবরাহ করার সক্ষমতা নেই। এ কারণে আন্তর্জাতিক দর অনুযায়ী বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সোহেল এন্টারপ্রাইজকে কাজ দেয়া হয়েছে। এখানে নিয়মমাফিকই সব কাজ করা হয়েছে। তা ছাড়া এ বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এ নিয়ে তদন্ত হয়। ওই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীও বিষয়টি জানেন।




পিএনএস/বাকীবিল্লাহ্

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন