জাহাঙ্গীরনগরে আমন্ত্রণ

  25-03-2017 01:59AM

পিএনএস ডেস্ক: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশের 'সাংস্কৃতিক রাজধানী' বলে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। 'সাংস্কৃতিক রাজধানী'- এই শব্দ যুগলের মধ্যেই নিহিত আছে বাংলাদেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসল সৌন্দর্য্য। পৃথিবীর কয়টা দেশের এমন 'সাংস্কৃতিক রাজধানী' আছে? খুব বেশি নেই হয়ত।

১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় যেন সোনার বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। শত সংকট মোকাবেলা করে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের যোগ্য সারথি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। জন্মলগ্ন থেকে বাংলাদেশের হেন কোনো সংকট নেই যেখানে জাহাঙ্গীরনগর এগিয়ে এসে ইতিবাচক ভূমিকা রাখেনি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রামে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে সঙ্গে নিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালে দেশের অন্যান্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে জাহাঙ্গীরনগরকেও স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন। জাতির জনকের আকাঙ্ক্ষার প্রতিদান দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর।

একটি সত্যিকারের অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে জাহাঙ্গীরনগর অসামান্য অবদান রেখে চলেছে। জাহাঙ্গীরনগরের সন্তানেরা এখান থেকে পড়াশোনা করে বের হয়ে গিয়ে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখে চলেছেন। সনদ নিয়ে টাকা কামাই করা শিখছে না শুধু। দেশপ্রেমিক, কর্মঠ, সৎ ও প্রগতিশীল মানুষ গড়ার কারখানা হিসেবে গত ৪৫ বছর ধরে সদা জাগ্রত ভূমিকা রেখে চলেছে জাহাঙ্গীরনগরের সন্তানেরা।

এরই ধারাবাহিকতায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসনের উদ্যোগে শনিবার (২৫ মার্চ) থেকে শুরু হচ্ছে 'মুক্তি সংগ্রাম নাট্যোৎসব' শীর্ষক সাতদিনব্যাপী সাংস্কৃতিক মহোৎসব। শুধু নাম শুনে এর মহিমা এবং গভীরতা অনুধাবন করা যাবে না। সাতদিনে দেশের ৫৪ জন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে সম্মাননা দেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। মরণোত্তর সম্মাননা দেয়া হবে কয়েকজন গুণী ব্যক্তিত্বকে। জীবিত যারা সাতদিন এই সবুজ ক্যাম্পাসে আসবেন, তাদের মুখ থেকে নতুন প্রজন্ম শুনবে মুক্তিযুদ্ধের গল্প, রাজনীতির অলিগলিতে অর্জিত অভিজ্ঞতা আর দেশ গড়ার দীর্ঘ ইতিহাস। ২৫শে মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের জাতীয় দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে এই আন্দোলনের অংশ হিসেবেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে।

প্রথম দিনের কর্মসূচি প্রাথমিকভাবে শুরু হবে চারুকলা বিভাগের আয়োজনে সকাল ১০ টায় ক্যাফেটেরিয়া প্রাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের আর্ট ক্যাম্প এ ছবি আঁকার মধ্য দিয়ে। এখানে ছবি আঁকবেন দেশের বিখ্যাত সব আঁকিয়ে। সাথে থাকবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। ছবি আঁকা শেষ হলে শুরু হবে প্রদর্শনী। যারা ছবি আঁকার কদর বোঝেন তারা অনুধাবন করতে পারবেন এমন একটি ক্যাম্পের গুরুত্ব এবং সৌন্দর্য্য।

২৫শে মার্চ বিকাল চারটা ৩৫ মিনিটে জাতীয় সংগীতের সাথে জাতীয় পতাকার উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সপ্তাহব্যাপী এ উৎসবের উদ্বোধন করবেন বীর মুক্তিযোদ্ধা তারামন বিবি, বীরপ্রতীক। এই মহান নারীকে সঙ্গ দিবেন বাংলাদেশের প্রথম নারী উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম। এদিন প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী।

সন্ধ্যার মুক্তমঞ্চের আলো-আধারির খেলায় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও নাট্য আন্দোলন নিয়ে বক্তব্য দেবেন অধ্যাপক এ কে এম ইউসুফ হাসান, নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি, সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য ও সাবেক জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. শরীফ এনামুল কবির, বিকন ফার্মাসিউটিক্যালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবাদুল করিম বুলবুল।

রাতে প্রদান করা হবে গুণী ব্যক্তিত্বদের স্মারক সম্মাননা। অন্যান্যদের মধ্যে মরণোত্তর স্মারক সম্মাননা পাবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র, উপমহাদেশের কিংবদন্তি অভিনেতা হুমায়ুন ফরিদী। নাট্য ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, এবাদুল করিম বুলবুল, ডা. দীপু মনি এমপি, নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন (মরণোত্তর), আব্দুল্লাহ আল মামুন (মরণোত্তর), কবি সৈয়দ শামসুল হক (মরণোত্তর), শহীদ জননী জাহানারা ইমাম (মরণোত্তর), তারামন বিবি বীর প্রতীক এবং স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। প্রথম দিনের অনুষ্ঠান শেষ হবে পদাতিক নাট্য সংসদ (টিএসসি) এর পরিচালনায় নাটক ‘কালরাত্রি’ মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে।

২৬ মার্চ ৩০ লাখ বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে মহান স্বাধীনতা দিবসে অনুষ্ঠান শুরু হবে। রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদ দেশব্যাপী ৩০ লাখ বৃক্ষরোপণের উদ্বোধন করবেন। এর সাথে সঙ্গতি রেখে দুপুর তিনটায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়েও শুরু হবে বৃক্ষরোপণ। ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মুখপাত্র অধ্যাপক শাহরিয়ার কবির অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করবেন। এদিন সাংস্কৃতিক পর্ব পরিচালনা করবে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাবি, শেখ রাসেল স্মৃতি সংসদ, জাবি এবং জয় বাংলা সাংস্কৃতিক জোট।

২৭ মার্চ তারিখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা ও সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করতে উপস্থিত থাকবেন গাজী গোলাম দস্তগীর গাজী এমপি, নাট্যব্যক্তিত্ব আতাউর রহমান, অভিনয় ব্যক্তিত্ব ফেরদৌসী মজুমদার। প্রধান অতিথি হিসেবে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেবেন ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম। এছাড়া তিনি সম্মাননা স্মারকও গ্রহণ করবেন। এদিন বেইলি রোডের ‘থিয়েটার’ এর পরিবেশনায় মঞ্চস্থ হবে নাটক ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’।

২৮ মার্চ বিকাল ৫টা থেকে অনুষ্ঠান শুরু হবে। এদিন সম্মাননা জানানো হবে বধ্যভূমির আবিষ্কারক ডা. মো. আবুল হোসেন, সাংবাদিক মনজরুল আহসান বুলবুল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা আকম মোজাম্মেল হক, সিআরপির প্রতিষ্ঠাতা ভেলরি এন্ড টেলরকে। নাটক ‘সময়ের প্রয়োজনে’ মঞ্চস্থ করবে থিয়েটার আর্ট ইউনিট।

২৯ মার্চ প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পিএসসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাদিক। বিশেষ অতিথি হিসিবে উপস্থিত থেকে সম্মাননা গ্রহণ করবেন শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, নারায়ণগঞ্জের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভি, বিশিষ্ট নগর পরিকল্পনাবিদ ও ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। সবশেষে নাটক ‘নটপাল’ মঞ্চস্থ হবে বিধান চন্দ্র সিনহা ও তার দলের পরিবেশনায়।

শেষ দুদিনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিনেতা তারিক আনাম খান, ডাক্তার নুজহাত চৌধুরী, মাহাবুব আরা গিনি এমপি, পিএসসির চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ সাদিক, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আবু নাসের কামাল চৌধুরী, নাট্য ব্যক্তিত্ব সারা যাকের, রামেন্দু মজুমদার, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব এন্ড্রু কিশোরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের গুণী ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত থেকে স্মারক সম্মাননা গ্রহণ করবেন। এসময় নাটক মঞ্চস্ত হবে যথাক্রমে ‘মৃত্যুপাখি’ ও ‘জেরা’। শেষের দিন মরণোত্তর সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হবে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মিশুক মুনিরকে।

সাংবাদিক হিসেবে অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি, টানা সাতদিন এতসংখ্যক উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব বাংলাদেশের আর কোথাও একই স্থানে উপস্থিত হয়েছেন বলে আমার জানা নেই। যারা সাংবাদিকতার মত মহান পেশায় নিয়োজিত আছেন তাদের জন্য এ এক বিরাট এবং বিরল সুযোগ। এত বড় বড় মানুষকে কাছ থেকে দেখা, তাদের সান্নিধ্য পাওয়া, তাদের কথা শোনার সুযোগ পেতে জীবনের অনেক দিন পার করতে হয়। অথচ এই সাতদিন দূরের বড় বড় মানুষগুলো আমাদের সামনে আসবেন। এরা কী বলে, কীভাবে বলে সবই আমাদের জন্য শিক্ষণীয়।

মোট পাঁচটি নাটক মঞ্চস্ত হবে মুক্তমঞ্চে। নামে শুধু মুক্তমঞ্চ না, কাজেও মুক্তমঞ্চ। নাটক দেখতে এক টাকাও লাগবেনা মনে হয়। টিকেটের কথা শুনিনি। এত বড় সুযোগ নাটক প্রেমীদের হেলায় হারানো উচিত হবেনা। জাগরণের গান হবে, নাচ হবে। সবাইকে জাহাঙ্গীরগরের মুক্তমঞ্চে দাওয়াত রইল।

এতবড় একটা প্রোগ্রাম মন্ত্রণালয় থেকে করলেও হিমশিম খেতে হবে। বাজেট হয়ত হবে কোটি কোটি টাকা। তারপরেও ঠিকমত হবে কিনা তার নিশ্চয়তা থাকবেনা। কিন্তু একটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের সীমিত সামর্থ্যের ভেতরে এত কম সময়ের ভেতরে এত বড় একটা প্রোগ্রামের পরিকল্পনা করেছে তা ভাবা যায়না। জাহাঙ্গীরনগর বলেই এটা সম্ভব হচ্ছে। দেশে নানা সংকট রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে কোনোদিন জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দেবে কেউ কল্পনাও করেনি। সব রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সংকট মোকাবেলায় জাহাঙ্গীরনগরের এই সাত দিনের মহোৎসব অসাধারণ ভূমিকা রাখবে, কোনো সন্দেহ নেই।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন