দীর্ঘদিন ধরে প্রো-ভিসি ও ট্রেজারারবিহীন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়

  26-08-2017 03:34PM

পিএনএস, বিশেষ প্রতিনিধি : রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) প্রো-ভিসি (উপ-উপাচার্য) ও ট্রেজারার (কোষাধ্যক্ষ) ছাড়াই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কার্যক্রম। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার নয় বছরেও নিয়োগ হয়নি প্রো-ভিসি (উপ-উপাচার্য)। অন্যদিকে চার বছর ধরে ট্রেজারার (কোষাধ্যক্ষ) ছাড়াই চলছে হিসাব সংক্রান্ত কোষাধ্যক্ষের কার্যক্রম। পদ থাকলেও নিয়োগের সদিচ্ছা না থাকায় সাবেক উপাচার্যের আমল থেকে অর্থব পড়ে রয়েছে এ দুটি পদ।

বাংলাদেশ গেজেট ২০০৯ সনের ২৯ নং আইনের ১২ নং ধারাতে বলা হয়েছে,‘(১) চ্যান্সেলর প্রয়োজনবোধে,তদ্কর্তৃক (তাঁর মাধ্যমে) নির্ধারিত শর্তে চার বৎসর মেয়াদে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অধ্যাপককে প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ দান করিতে পারিবেন।’ ১৩ নং ধারায় বলা হয়েছে, (১) চ্যান্সেলর, তদ্কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে, চার বছর মেয়াদের জন্য একজন ট্রেজারা নিযুক্ত করিবেন এবং তিনি একজন অবৈতনিক কর্মকর্তা হইবেন, তবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল হইতে চ্যান্সেলর কর্তৃক নির্ধারিত সম্মানী প্রাপ্য হইবেন।’ ২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ট্রেজারার সংবিধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি দ্বারা নির্ধারিত এবং ভাইসচ্যান্সেল কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করিবেন।’

দীর্ঘ দিন ধরে তালাবদ্ধ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার(কোষাধ্যক্ষ)এর কক্ষটি। একই সাথে চার বছর ধরে শুন্য রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদটি। গত তিন বছরে পদটি শুন্য থাকায় নিজেই সিনেট আর সিন্ডিকেটের ট্রেজারার এর পদটি আঁড়ে ধরে রেখেছিলেন সাবেক উপাচার্য ড. একে এম নূর-উন-নবী। বিধি অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় অর্থ হিসাব-নিকাশ ও সেটা সংরক্ষণের দায়িত্ব ট্রেজারারের হাতে থাকবে।

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৯ সালের ৮ এপ্রিল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদকর্তৃক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেট এর ২০০৯ সনের ২৯ নং আইন দ্বারা পরিচালিত । আইনের ১৩ নং ধারাতে বলা আছে, ‘(১) চ্যান্সেলল,তদ্কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে, চার বৎসর মেয়াদের জন্য একজন ট্রেজারার নিযুক্ত করিবেন এবং তিনি একজন অবৈতনিক কর্মকর্তা হইবেন, তবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল হইতে চ্যান্সেলর কর্তৃক নির্ধারিত সম্মানী প্রাপ্য হইবেন।’‘২ নং অনুচ্ছেদে রয়েছে, ট্রেজারার সংবিধি ও বিশ্ববিদ্যালয় বিধি দ্বারা নির্ধারিত এবং ভাইস-চ্যান্সেলর কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব পালন করবেন।’ ‘৩ নং অনুচ্ছেদে আছে, ছুটি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে ট্রেজারারের পদ সাময়িকভাবে শূন্য হইলে সিন্ডিকেট অবিলম্বে চ্যান্সেলরকে তৎসম্পর্কে অবহিত করিবেন এবং চ্যান্সেলর ট্রেজারারের কার্যাবলী সম্পাদনের জন্য যেইরুপ ব্যবস্থা গস্খহণ প্রয়োজন বলিয়া মনে করিবেন সেইরুপ ব্যবস্থা গস্খহণ করিবেন।

৪ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ট্রেজারার বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের সার্বিক তত্ত্বাবধান করিবেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ সংক্রান্ত নীতি সম্পর্কে ভাইস-চ্যান্সেলর, সংশ্লিষ্ট কমিটি,ইনস্টিউট ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে পরামর্শ প্রদান করিবেন। ৫ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ট্রেজারার, সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তি ও বিনিয়োগ পরিচালনা করিবেন এবং তিনি বার্ষিক বাজেট ও হিসাব-নিকাশ পেশ করিবার জন্য উক্ত সিন্ডিকেটের নিকট দায়ী থাকিবেন। ৬ নং অনুচ্ছেদে বলা আছে, যেই খাতের জন্য অর্থ মঞ্জুর বা বরাদ্দ করা হইয়াছে সেই খাতেই যেন উহা ব্যয় হয় তাহা দেখার জন্য ট্রেজারার, সিন্ডিকেট প্রদত্ত্ ক্ষমতা সাপেক্ষে,দায়ী থাকিবেন। ৭ ও ৮ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, যথাক্রমে ‘ট্রেজারার বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অর্থ সংক্রান্ত সকল চুক্ততে স্বাক্ষর করিবেন’ এবং ‘ট্রেজারার সংবিধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য ক্ষমতাও প্রয়োগ করিবেন।’

ট্রেজারার নিয়োগ, দায়িত্ব ও ক্ষমতা সম্পর্কে আইনের এতগুলো অনুচ্ছেদ থাকলেও ট্রেজারার নিয়োগ না দেওয়া ও সংবিধি-প্রবিধি না হওয়ায় ধারাটির প্রয়োগ অকার্যকর রয়ে গেছে। ট্রেজারার না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট ও হিসাব-নিকাশের স্বচ্ছতা ছিলো না সাবেক উপাচার্যের আমলে। মোটা অংকের অর্থ তছরুপের বিষয়টি প্রমাণিত। নিজেই ট্রেজারারের দায়িত্ব থাকায় আত্মসাৎ এবং অপ্রয়োজনীয়ভাবে টাকা খরচের ব্যাপারে কোনো সঠিক হিসাব ছিলো না।

জানা যায়, সাবেক উপাচার্য ড. একে এম নূর-উন-নবী যোগদানের(২০১৩ সালের ৬ মে) মাথায় ২০১৩ সালের ১৭ আগষ্ট ট্রেজারের পদটি শূন্য হয়। কিন্তু উপাচার্য সে পদ পূরণের উদ্যোগ না নিয়ে ‘যোগ্য লোক খোঁজা হচ্ছে’বলে নিজেই সে পদ আঁকড়ে ধরে ছিলেন। নিজেই পদে অধিষ্ঠিত থাকায় আপ্যায়ন বিল করেছেন ইচ্ছামত। ভাউচার বিলে কর্মকর্তার দ্বারা স্বাক্ষর করিয়েছেন ভয় দেখিয়ে,ক্ষমতা প্রয়োগ করে। তাঁর স্বেচ্ছাচারিতার ফলে পদটি ফাঁকাই রয়ে গেছে।

একদিকে ট্রেজারারের পদটি ফাঁকা থাকায় উপাচার্যকে যেমন নিজেই সেটি সামলাতে হচ্ছে অন্যদিকে নয় বছরেও উপ-উপাচার্য না থাকায় উপাচার্যের নিকট দায়িত্বের বোঝা বেড়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। উপ-উপাচার্যের সকল কাজ করতে হচ্ছে উপাচার্যকে। উপাচার্যের অনুপস্থিতিতে উপ-উপাচার্য সে কাজ সম্পাদন করতে পারেন কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পদটি ফাঁকা থাকায় তা হচ্ছেনা। উপাচার্য রংপুরের বাইরে যাওয়া মানে তিনটি পদটি বাইরে যাওয়া। ফলে সংকট দিনে দিনে আরো ঘনীভূত হওয়ার আশংকা করেছেন অনেকেই।

এদিকে ২০০৯ সনের ২৯ নং আইনের প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর নিয়োগ ও ক্ষমতা সংক্রান্ত ১২ নং ধারাতে উল্লেখ রয়েছে, ‘(১) চ্যান্সেলর প্রয়োজনবোধে,তদ্কর্তৃক নির্ধারিত শর্তে চার বৎসর মেয়াদে, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অধ্যাপককে প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর পদে নিয়োগ দান করিতে পারিবেন।’

‘৩ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, প্রো-ভাইস-চ্যান্সেলর সংবিধি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি দ্বারা নির্ধারিত এবং ভাইস-চ্যান্সেলর কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ এবং দায়িত্ব পালন করিবেন।’আইন থাকলেও সংবিধি-বিধি-প্রবিধি তৈরির কোনো স্বদিচ্ছাই প্রতিফলিত ঘটেনি সাবেক দুই উপাচার্যের সময়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্যের সময়ে ৬ জন অধ্যাপক থাকলেও প্রো-ভিসি পদে নিয়োগের ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। বর্তমানে এ সংখ্যা ৭ জনে উন্নীত হলেও তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না বর্তমান উপাচার্য ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ, বিটিএফও এর।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মতিউর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শূন্য সব ক’টি পদেই নিয়োগ জরুরী। প্রো-ভিসি এবং ট্রেজারার পদ শূন্য থাকায় অনেক সমস্যা হয়। বিধি মোতাবেক, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অধ্যাপককে প্রো-ভিসি পদে নিয়োগের বিধান থাকলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। এ সব পদ পূরণ জরুরী।’

এছাড়াও জানা গেছে, আগামী ডিসেম্বরে মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে দু’বছরের পর্যন্ত অস্থায়ীভাবে (এডহক) নিয়োগ পাওয়া রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইব্রাহীম কবীর এর। স্থায়ী রেজিস্ট্রার নিয়োগের ব্যবস্থা না করলে বেড়ে যাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে শুন্যতা।

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম রব্বানী বলেন, ‘উপাচার্য মহোদয় যদি মনে করেন এ দুটো ( প্রো-ভিসি এবং ট্রেজারার) পদে নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন (নিয়োগের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন) তা হলে তিনি দিবেন (ব্যবস্থা করবেন)। প্রয়োজন মনে না করলে দিবেন না।’

উপাচার্য দেশের বাইরে থাকায় যোগাযোগের সুযোগ না থাকায় এ ব্যাপারে রেজিস্ট্রার মুহাম্মদ ইব্রাহীম কবীর শনিবার বলেন, ‘বর্তমান উপাচার্যও ট্রেজারারের অতিরিক্ত দায়িত্বে রয়েছেন। প্রো-ভিসি এবং ট্রেজারার নিয়োগের বিষয়ে তাঁর উদ্যোগের বিষয়টি আমি এখনো জানিনা। তিনি আজ (শনিবার) ইন্দোনেশিয়া থেকে আসবেন। আসলে আপনারা (সাংবাদিকগণ) তাঁকে জিজ্ঞেস করিয়েন।’

তিনি আরো বলেন, সাবেক উপাচার্যের সময় এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল কি না আমার জানা নাই। তবে সাবেক উপাচার্যও ট্রেজারারের অতিরিক্ত দায়িত্বে ছিলেন।

উপাচার্য বিভিন্ন সময় রংপুরের বাইরে থাকেন। বর্তমান তিনি গত ২০ আগষ্ট ইন্দোনেশিয়া সফরে গেছেন। ফলে অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয়। তিনি জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদ (জানিপপ) এর সদস্য এবং গণমাধ্যমে টকশো করায় তার পক্ষে মাঝে মাঝেই বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকা সম্ভব হবে না। এতে বেরোবি আরো অভিভাবকহীন হয়ে পড়ার আশংকা করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারিরা। ফলে ভবিষ্যতে সংকট আরো ঘনীভূত হতে পারে।

সুতরাং এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দানের ব্যবস্থা করা জরুরী হয়ে পড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ মনে করেন। তা না হলে আবারও প্রশাসনিক কাজকর্মে স্থবিরতা আরেক ধাপ বেড়ে যেতে পারে বলে আশংকা শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারির।

পিএনএস/মোঃ শ্যামল ইসলাম রাসেল



@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন