ভুলে ভরা দুর্বোধ্য পাঠ্যবই

  08-11-2017 05:04PM

পিএনএস ডেস্ক: প্রথম শ্রেণির আমার বাংলা বইয়ের ১১ নম্বর পৃষ্ঠায় পাঠ ৭-এ শিশুদের স্বরবর্ণ ‘অ’ চেনাতে একটি ছাগলের ছবি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘অজ আসে’। অথচ গ্রাম বা শহরের শিশুরা কেউ ‘অজ’ চেনেই না।

১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় স্বরবর্ণ ‘ও’ চেনাতে ওড়নার ছবি এঁকে বলা হয়েছে ‘ওড়না চাই’। এতে প্রথম শ্রেণিতেই কন্যাশিশুদের নাজুক পরিস্থিতির শিকার করা হয়েছে। একই বইয়ের ৭১ নম্বর পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে ছবিটি ব্যবহার করা হয়েছে তা দেখে বোঝার উপায় নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ছবিটি আরো সুন্দর ও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন।

বানানের অবস্থাও যাচ্ছেতাই। দ্বিতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ের ১৯ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা আছে ‘ভিতরে’, যার শুদ্ধ বানান হবে ‘ভেতরে’। হবে ‘কথোপকথন’ অথচ বইয়ে লেখা হয়েছে ‘কথপোকথন’। ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘ডাঁশা ডাঁশা’ বানান, যা আসলে হবে ‘ডাসা ডাসা’। ৬৫ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘সুরঙ্গ’ বানান লেখা হয়েছে, যা হবে ‘সুড়ঙ্গ’।

তৃতীয় শ্রেণির বাংলা বইয়ে কুসুমকুমারী দাশের ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটির বেশির ভাগই ভুল লেখা হয়েছে। চতুর্থ শ্রেণির বাংলা বইয়ের ১৩ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে ‘বির্তক’, যা আসলে হবে ‘বিতর্ক’। ৮০ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘ঘুরে আসি সোনারগাঁও’ প্রবন্ধে একটি ছবির নিচে লেখা হয়েছে ‘শখের হাঁড়ি’। অথচ ওই প্রবন্ধের কোথায়ও ‘শখের হাঁড়ি’র উল্লেখ নেই। পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ের ৩ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘সমুদ্র’ বানান লেখা হয়েছে ‘সমুদ’, ৯ পৃষ্ঠায় ‘অতীত’ বানান লেখা হয়েছে ‘অতিত’। ৯৪ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘সকাল’-এর জায়গায় ‘সকল’ লিখে পুরো বাক্যটির অর্থই বদলে দেওয়া হয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) প্রণীত প্রাথমিকের প্রায় প্রতিটি বই এ রকম অজস্র ভুল-ত্রুটিতে ভরা। অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বোধ্য শব্দ-বাক্য-ছবি ব্যবহার করা হয়েছে, যা শিশুদের বুঝতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। সম্প্রতি পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ তদন্তে জাতীয় নাগরিক কমিশন তাদের প্রতিবেদনেও পাঠ্যবইয়ের নানা ভুল-ভ্রান্তি তুলে ধরেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তৃতীয় শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ১৬ নম্বর পৃষ্ঠায় শিক্ষা লাভের অধিকার ছবিতে বই পড়ার ছবি দেওয়া হয়েছে। অথচ এখানে স্কুলের ছবিই বেশি মানানসই। খাদ্যের অধিকারে ভাত খাওয়ার ছবি দেওয়া হয়েছে। অথচ এখানে রুটিও রাখা যেত। ১৯ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘এসো বলি’তে বলা হয়েছে, ‘তোমার পরিবারে ছেলে ও মেয়েদের কী সমানভাবে দেখা হয়?’ অথচ এখানে প্রশ্ন করা যেত, ‘তোমার পরিবারে তুমি কি কি কর, তোমার ভাই-বোন কি কি করে?’ ৩০ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘একটি সত্যি ঘটনা’য় একজন মানুষের বর্ণনা আছে। অথচ তার নাম ও পেশার উল্লেখ নেই। এ রকম নানাভাবে দুর্বোধ্য করা হয়েছে বইটি।

চতুর্থ শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ৯ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, ‘কী কী ধরনের চাহিদার শিশু থাকতে পারে?’ কিন্তু তা সহজ করেও বলা যেত। যেমন ‘শিশুরা কী কী সমস্যা বা অসুবিধায় ভুগতে পারে’। ১০ নম্বর পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় লাইনে বলা হয়েছে, ‘বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমাহারের কারণে’ অথচ সহজ করে লেখা যেত ‘বিভিন্ন জনগোষ্ঠী থাকার কারণে’। একই বইয়ের ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় গ্রামাঞ্চলে কী কী সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন তা উল্লেখ করতে গিয়ে তালিকার শুরুতেই বলা হয়েছে, ‘শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য সেবা’। অথচ তালিকায় তারপরই আবার লেখা হয়েছে ‘স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা’। সে ক্ষেত্রে এ দুটি বিষয় দিয়ে আসলে কী বোঝানো হয়েছে তা বোধগম্য নয়। একইভাবে ৪৬ নম্বর পৃষ্ঠায় শহরাঞ্চলে কী কী সুবিধা থাকা প্রয়োজন তার উল্লেখ করতে গিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান হাসপাতাল’। কিন্তু তালিকায় তার পরই আবার আলাদা করে ‘হাসপাতাল’ লেখা হয়েছে।

একই বইয়ের ৭৮ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ’ প্রবন্ধের চতুর্থ প্যারায় শুধু রাজাকার-আলবদরের কথা লেখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে জাতীয় নাগরিক কমিশন তাদের প্রতিবেদনে সুপারিশ করেছে যে উল্লিখিত প্যারার সঙ্গে আরো যোগ করা প্রয়োজন, ‘জামায়াতে ইসলামী নেতা গোলাম আযম, নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদীসহ অনেক যুদ্ধাপরাধীর নেতৃত্বে শান্তি কমিটি, রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠিত হয়। এরা লাখ লাখ নারী-পুরুষ শিশুদের হত্যা করে। ’

পঞ্চম শ্রেণির বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয় বইয়ের ১৫ নম্বর পৃষ্ঠায় এসো লিখি-তে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা তিনটি পক্ষ থেকে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ সেখানে মীরজাফরের কথা উল্লেখ করা হয়নি। প্রয়োজনে তিন পক্ষের বদলে চার পক্ষও লেখা যেতে পারে। ৩৪ নম্বর পৃষ্ঠায় পাটের বর্ণনায় পাট থেকে শুধু রশি ও চটের থলে বা বস্তা তৈরি হয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ পাট থেকে ব্যাগ, জুতা, জামা-কাপড়, সাজসজ্জার উপকরণ ও খেলনা তৈরির বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। ৩৮ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে, ‘কাগজ কলগুলোতে গাছের গুড়ি থেকে কাগজ তৈরি হয়। ’ অথচ বাঁশ থেকেও কাগজ তৈরি হয়। এরপর বলা হয়েছে, ‘চিনিকলগুলোতে চিনি উৎপাদন ও পরিশোধন করা হয়’। অথচ আখ থেকে যে চিনি তৈরি হয় তা উল্লেখ করা হয়নি। এভাবে প্রাথমিকের প্রায় সব বইয়ে নানা অসামঞ্জস্য রয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘কারিকুলাম নিয়ে মূলত এনসিটিবিই কাজ করে। তবে আমরা নির্ভুল বই চাই, যাতে শিশুরা ভুল না শেখে। বইগুলো যত সহজ করা যাবে শিশুরা ততই আনন্দের সঙ্গে পড়বে। সেটাও আমরা বলেছি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে প্রাথমিকের বইগুলো রিভিশন হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে আবারও রিভিশন হবে। ’

কিন্ডারগার্টেনের বইয়েও শিশুদের সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। পাঠ্যপুস্তক সাম্প্রদায়িকীকরণ তদন্তে জাতীয় নাগরিক কমিশনের প্রতিবেদনে কিন্ডারগার্টেনের বইয়ে সাম্প্রদায়িক শিক্ষার চিত্র তুলে ধরা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শত বছর ধরে প্রচলিত সীতানাথ বসাক প্রণীত ‘আদর্শ লিপি’ বইটি বর্ণপরিচয়ের একটি অসাম্প্রদায়িক বই। এর কোথায়ও সাম্প্রদায়িক শব্দ ব্যবহার করা হয়নি। তবে এই বইটি খুব কম প্রকাশিত হচ্ছে। বর্তমান সময়ে বাজারের বেশির ভাগ বর্ণ পরিচয়ের বই বের হচ্ছে সাম্প্রদায়িক শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করে।

জাতীয় নাগরিক কমিশনের তদন্তেও সাম্প্রদায়িকতার বিষ্পপাপ ছড়ানো বেশ কিছু বইয়ের উদাহরণ দেওয়া হয়। তাতে ফ্রেন্ডস বুক সেন্টার, হিউম্যান পাবলিকেশনস, শিশু সাহিত্য সেন্টার, সাজু পাবলিকেশনসসহ বিভিন্ন বইয়ের কথা উল্লেখ রয়েছে। এসব বই সাধারণত কিন্ডারগার্টেনের প্লে শ্রেণিতে পড়ানো হয়। অভিভাবকরা শিশুদের প্রথম পাঠ হিসেবে বাসায়ও শিশুদের হাতে এসব বই তুলে দেন। ফলে একটি শিশু তার প্রথম পড়ালেখার সময়ই সাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা পাচ্ছে।

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬-১৭, বাংলাবাজার থেকে প্রকাশিত ‘শিশু সাহিত্য সেন্টার’ প্রকাশনীর ‘একের ভিতর পঁচিশ’ নামের বইয়ের প্রায় সব বাক্যই ধর্মভিত্তিক। বইটিতে মূলত বিভিন্ন বর্ণ দিয়ে একই কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হয়েছে। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণ মিলিয়ে ৫০টি বর্ণের মধ্যে ২৯টি বর্ণ দিয়ে ধর্মীয় বাক্য গঠন করা হয়েছে।

পাঠ্যপুস্তকের সাম্প্রদায়িকীকরণ তদন্তে জাতীয় নাগরিক কমিশনের সদস্যসচিব অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘সাম্প্রদায়িকীকরণের এই ধারা শুধু জাতীয় শিক্ষা পাঠক্রমেই নয়, এর বাইরে কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন ধরনের স্কুলে সাম্প্রদায়িক ও বর্ণবাদী শিক্ষা গুরুত্ব পাচ্ছে। কোমলমতি শিশুদের বর্ণশিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষার পুরো বইটি ধর্মশিক্ষার বইয়ে পরিণত হয়েছে। আর শিশুদের যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে তাদের মনমানসিকতাও সেভাবে তৈরি হচ্ছে। তবে এসব ব্যাপারে কোথায়ও কোনো আলোচনা হচ্ছে না। ’ সূত্র: কালের কন্ঠ।

পিএনএস/কামাল

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন