এবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন ১ হাজার!

  13-01-2018 11:00AM

পিএনএস ডেস্ক: একটি স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসার শিক্ষক। কিন্তু মাদ্রাসায় নেই সরকারি বেতনভাতা। টিউশনির টাকায় সংসারের ঘানি টানছেন তিনি। ঘরে অসুস্থ বাবা-মা। অর্থের অভাবে অসুস্থ বাবার চিকিৎসা করাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সরকারি বেতনের অংশ পাবেন- এই প্রত্যাশায় বিনাবেতনে শিশুদের পড়াচ্ছেন ২০০২ সাল থেকে। তার মতো দেশের ৩৪ হাজার ২৪০ শিক্ষকের পরিবার এভাবেই মানবেতর দিনাতিপাত করছেন।

স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণের দাবিতে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শিক্ষকদের আমরণ অনশন কর্মসূচির চতুর্থ দিন পার হলেও সরকারের টনক নড়েনি। পৌষের শীত আর রাস্তার ধুলোয় প্রতিদিন বাড়ছে অসুস্থ শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা। গতকাল পর্যন্ত ১০৬ শিক্ষক অসুস্থ হয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতি।

সংগঠনটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, গতকাল বিকাল পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে সাত শিক্ষক চিকিৎসা নেন। অনশনস্থলে অসুস্থ হয়ে পড়ায় স্যালাইন দেওয়া আছে আরও ১৮ জনকে। এর বাইরে সুস্থ হওয়ায় ঢামেক থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে তিনজনকে। বাকিরা ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতার কারণে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এবতেদায়ি শিক্ষকরা চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে গত ১ জানুয়ারি থেকে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। ৯ জানুয়ারি থেকে শুরু করেন আমরণ অনশন। সরকারের দৃষ্টি কাড়তে শিক্ষকদের অনশন চলছে প্রেসক্লাবের সামনের সড়কে। সারা দেশ থেকে আসা কয়েক হাজার শিক্ষক এই কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন।

শিক্ষকরা জানান, সরকারি হিসাবে দেশে ৬ হাজার ৮৪৮টি স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসা রয়েছে। এর বাইরে আরও চার হাজার প্রতিষ্ঠান আছে। এসব মাদ্রাসা থেকে প্রতিবছর সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে হাজার হাজার শিশু। পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে। স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসাগুলো নিবন্ধিত হয়েছে মাদ্রাসা বোর্ড থেকে। মাদ্রাসার এবতেদায়ি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অথচ এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদানের দায়িত্ব পালন করছেন যে শিক্ষকরা, তারাই বেতনবঞ্চিত। পাচ্ছেন না সরকারের বেতনভাতার সুবিধা।

শিক্ষকরা জানান, ১৯৯৪ সালে একই পরিপত্রে রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাইমারি ও স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষকদের বেতন ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে বিগত সরকারের সময়ে ধাপে ধাপে বেতন উন্নতি হয় শুধু প্রাইমারি স্কুলে। এর পর ২০১৩ সালের ৯ জানুয়ারি মহাজোট সরকার ২৬ হাজার ৯৩টি বেসরকারি প্রাইমারি স্কুল জাতীয়করণ করে। কিন্তু স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসা জাতীয়করণ হওয়া দূরের কথা, শিক্ষকরা বেতন বাবদ পান মাত্র ৫০০ টাকা। কারণ প্রতিথানায় একটি করে এবতেদায়ি স্বতন্ত্র মাদ্রাসার শিক্ষকদের ৫০০ টাকা করে বেতন দিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়। যারা ৫০০ টাকা পেতেন, তারা ২০১৩ সাল থেকে ১ হাজার টাকা করে পাচ্ছেন। এক হাজার টাকা পাওয়া শিক্ষকের সংখ্যা সারা দেশে মাত্র ৬ হাজার ৭৬ জন।
এদিকে সরকারের সাড়া না মেলায় শিক্ষকরাও দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অনশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি কাজী রুহুল আমিন চৌধুরী গতকাল এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

গাইবান্ধা জেলার ফলগাছা দরজিবাড়ী স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসার এক শিক্ষক জানান, এবতেদায়ি শিক্ষকদের দাবিদাওয়া নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে এর আগে কথা হয়েছে। মন্ত্রী তাদের জানিয়েছিলেন, এসব মাদ্রাসা বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে। শিক্ষানীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হলে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখভাল করবে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। ১৮ বছর ধরে বিনাবেতনে চাকরি করে আসা শিক্ষক শামছুল আলম অভিযোগ করে বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকলেও উদ্যোগের অভাবে বৈষম্যের শিকার তারা।

অনশনকারী শিক্ষকরা জানান, তীব্র শীতের মধ্যে রাস্তায় বসে আন্দোলন করলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আশ্বাস তারা পাননি। অথচ তাদের পাশেই আন্দোলন করেছিলেন নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। শিক্ষামন্ত্রী এসে তাদের আশ্বাস দিয়েছিলেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে তারা আন্দোলন স্থগিত করেছেন। শিক্ষকদের অভিযোগ, আমরা একই দেশের নাগরিক। তাদের মতোই শিক্ষক। কিন্তু আমাদের দিকে কারো কোনো দৃষ্টি নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি আজ পর্যন্ত যোগাযোগও করেননি।

বাংলাদেশ স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসা শিক্ষক সমিতির সভাপতি আলহাজ কারি রুহুল আমিন চৌধুরী বলেন, ৩৩ বছর ধরে আমরা অভিভাবকহীন ছিলাম। প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়ার পর ২০১৬ সালের ১৮ মে স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া হয়। মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলে সরকারিকরণের আশ্বাস দিয়েছিলেন তিনি। সরকারি করতে মন্ত্রী একটি ওয়ার্কিং কমিটিও গঠন করে দেন। আমরা খুশিতে বাড়ি ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ আমাদের কিছু না জানিয়েই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে স্বতন্ত্র এবতেদায়ি মাদ্রাসা হস্তান্তর করা হয়। এটা একটা ষড়যন্ত্র। প্রাথমিক শিক্ষা আইনের পরিপন্থী। তিনি আরও বলেন, গত রবিবার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা বিভাগের নবনিযুক্ত প্রতিমন্ত্রী কাজী কেরামত আলীর সঙ্গে দেখা করে স্মারকলিপি দিয়েছি। একই অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গেও দাবির কথা জানানো হয়েছে। তবে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আশ্বাস পাওয়া যায়নি। আমরা যে কোনো মূল্যে জাতীয়করণ চাই। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে।

স্বতন্ত্র এবতেদায়ির এই শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, শিক্ষকদের দাবির বিষয়ে মন্ত্রণালয় আন্তরিক। শিক্ষা খাতে অপ্রতুল বাজেটের কারণে শিক্ষকদের সম্মানী বাড়াতে পারছে না মন্ত্রণালয়। শিক্ষামন্ত্রীর উদ্যোগে তাদের ৫০০ টাকা থেকে ১ হাজার টাকা বেতন উন্নীত করা হয়েছিল। এখন দাবির বিষয়টি সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্যায় দেখবে।

পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন