শত বাধার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ : প্রণব মুখার্জি

  16-01-2018 09:14PM

পিএনএস ডেস্ক : ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেছেন, 'শত বাধার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম এগিয়ে যাওয়া দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এ দেশের জাতীয় আয় এই কয়েক বছরে সাত শতাংশের বেশি বেড়েছে। ২০০৮ সাল থেকে সারা পৃথিবীতে অর্থনৈতিক মন্দা চললেও বাংলাদেশ থামেনি। অপুষ্টি দূরীকরণ, নারীশিক্ষা দূরীকরণ, উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণে বাংলাদেশ উন্নতি করছে। অন্যান্য উন্নত দেশগুলো না পারলেও বাংলাদেশ পেরেছে। আজকে যে মাটিতে দাঁড়িয়ে আপনারা আমাকে ডি. লিট দিয়ে সম্মানিত করেছেন সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে আমি উপলব্ধি করছি, গণতন্ত্রের মাধ্যমে দেশকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়।'

পাঁচদিনের ব্যক্তিগত সফরে রোববার ঢাকায় আসা প্রণব মুখার্জি মঙ্গলবার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি. লিট ডিগ্রি নেয়ার পর শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে এসব কথা বলেন।

রাজনীতি, অর্থনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তার চল্লিশ মিনিটের বক্তব্য মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেছেন অতিথিরা। চবি থেকে মাস্টারদা সূর্যসেনের জন্মস্থান রাউজানে যান প্রণব মুখার্জি। রাউজানের নোয়াপাড়ায় সূর্যসেনের ভাস্কর্যে সম্মান জানান তিনি। নগরীর হোটেল র্যা ডিসনে ভারতীয় দূতাবাসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও যোগ দেবেন তিনি।

উপমহাদেশে রাজনৈতিক নেতৃত্ব কেন বারবার আক্রমণের শিকার হচ্ছে— সেই প্রশ্ন তুলে এসব হত্যাকাণ্ডের কারণ জানতে গবেষণার আহ্বান জানিয়ে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী বলেন, 'এ উপমহাদেশে যাদের নেতৃত্বে বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল সে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর কেন বারবার হিংসাত্মক আক্রমণ হয়েছে তা জানতে হবে।'

তিনি ১৯৫৯ সালে শ্রীলংকার সলোমন বন্দরনায়েক, ১৯৪৮ সালের ৩ জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধী, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জিয়াউল হক, জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসি ও শ্রীলংকার প্রেসিডেন্ট রানাসিঙ্গে প্রেমাদাসা নিহত হওয়ার ঘটনাও উল্লেখ করেন।


এ সময় প্রণব মুখার্জি বলেন, 'ভারতে স্বাধীনতার কয়েক মাসের মধ্যে আমাদের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে হারিয়েছিলাম। ১৯৪৮ সালের ৩ জানুয়ারি ঘাতকের বুলেট তাকে আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল। ঠিক তেমনি স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছরের মাথায় একদল ঘাতকের নৃশংস আক্রমণে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আত্মত্যাগ করলেন। প্রায় জন্মলগ্নের মুহূর্তে জাতিকে জাতীয় নেতৃত্বশূন্য করে দেওয়া হলো। পৃথিবীর কোনো দেশে এমন নজির নেই। এ বিপুল রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের কারণ কী, এর পেছনে কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট আছে কি-না তা আমাদের জানতে হবে।'

বাংলাদেশ ও ভারত ছাড়া উপমহাদেশের অন্য দেশগুলোতে সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বেশিদিন স্থায়ী হতে পারেনি কেন তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন প্রণব মুখার্জি। তিনি বলেন, 'বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্র গ্রহণ করেছে ভারতের মতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মানুষের কাছে ক্ষমতা তুলে দিয়েছে। শ্রীলংকা, মিয়ানমারও একই পথে হেটেছে। আরো অনেক দেশ সংসদীয় গণতন্ত্র গ্রহণ করেছে। তবে ভারত, বাংলাদেশসহ দু'একটি দেশ ছাড়া অন্য তেমন কোনো দেশে এটি মজবুত হতে পারেনি। কেন? এসব দেশে দীর্ঘদিন সামরিক শাসন চলেছে। কোন আর্থ সামাজিক কারণে সৈন্যরা ব্যারাক থেকে বেড়িয়ে এসে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেছে তা জানা দরকার। সংসদীয় গণতন্ত্র বা রাষ্ট্রপতি শাসিত গণতন্ত্র মজবুত হতে পারছে না।'

জাতির জনক শেখ মজিবুর রহমান প্রসঙ্গে প্রণব মুখার্জি বলেন, 'অন্য দেশের স্বাধীনতার স্থপতিরা দেশকে গড়ে তোলার অনেক সময় পেলেও বাংলাদেশের জনক শেখ মুজিবুর রহমান তা পাননি। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের স্থপতি। তিনি ছিলেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি।'

তিনি আরও বলেন, 'ভাষার জন্য কোনো দেশের মানুষ জীবন দিয়েছে তার নজির নেই। তবে তা বাংলাদেশের মানুষ করেছে। মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির রক্ষার জন্য তারা জীবন উৎসর্গ করেছে। আজ বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক মার্তৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।'

প্রণব মুখার্জি উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রকে গবেষণা নির্ভর করার ওপর জোর দিয়ে বলেন, 'নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকেই চুম্বকের সাথে তুলনা করতো। চুম্বকের ন্যায় এ বিশ্ববিদ্যালয় সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিভাবান মানুষদের আকর্ষণ করতো। আমি চাইবো— চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও সেই অবস্থানে যাবে। এখান থেকেই বিজ্ঞানী-অর্থনীতিবিদ বের হবে, যারা সারাবিশ্বের কল্যাণে কাজ করে যাবে। আমি চাইবো— এ বিশ্ববিদালয়ের শিক্ষার্থীরা এমন কোনো তত্ত্ব আবিষ্কার করবেন, যাতে করে পুরো বিশ্ব এতে উপকৃত হবে।'

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েই প্রণব মুখার্জি বঙ্গবন্ধু চত্বরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর তিনি শহীদ আব্দুর রব হলের মাঠে প্রবেশ করেন। উদ্বোধনী সংগীত দিয়ে তাকে বরণ করে নেন চবির নাট্যকলা ও সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এরপর তাকে সম্মানসূচক ডি. লিট ডিগ্রি তুলে দেন চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দীন চৌধুরী।

অনুষ্ঠান শেষে প্রণব মুখার্জি ভিসি বাংলোতে মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন। এসময় ভারতীয় হাই কমিশনার হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা, চবির রেজিস্ট্রার, ডিনসহ সিনিয়র শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রওনা দিয়ে বিকেল পৌনে ৪টায় রাউজানের নোয়াপাড়ায় সূর্যসেনের পৈত্রিক ভিটায় পৌঁছেন প্রণব মুখার্জি। রাউজান কলেজের কাছে মুন্সির ঘাটা এলাকায় সূর্যসেনের ভাস্কর্যে সম্মান জানান তিনি। এরপর সূর্য সেন স্মৃতি পাঠাগারের উদ্বোধন করেন। পরে তিনি সেখানে রাখা স্মারক বইয়েও স্মাক্ষর করেন।

এ সময় রাউজানের সংসদ সদস্য ও রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী, রাউজান উপজেলা চেয়ারম্যান এহছানুল হায়দার চৌধুরী বাবুল, সূর্য সেন স্মৃতি পাঠাগারের সভাপতি শ্যামল কুমার পালিত প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

সূর্য সেন পল্লীতে প্রণব মুখার্জির মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জি এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় মধ্য বয়স্ক বেবী দাশ নামের এক নারী শর্মিষ্ঠাকে তার ঘরে আমন্ত্রণ জানান। এ সময় বেবী দাশ বলেন, 'আপনি রাজার মেয়ে। আমি নিঃসন্তান। আপনার মতো ভাগ্যবতী নারী যদি আমার ঘরে একটু বসেন তাহলে ভগবান আপনার মতো আমাকেও সন্তান দান করবেন।' একথা শুনে প্রণব মুখার্জীর মেয়ে শর্মিষ্ঠা স্থানীয় বেবী দাশের ঘরে গিয়ে একটু বসেন এবং তার ঘরে যেন একটি সন্তান আসে এ প্রার্থনা করেন। বেবী দাশ এলাকার হারাধন দাশের স্ত্রী।

পিএনএস/জে এ /মোহন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন