'রাস্তায় যখন খালি পেটে ঘুরতাম, তখনও বাঁচার ইচ্ছেটা ছিল'

  21-01-2017 08:30PM

পিএনএস: বলিউডের বর্তমান সময়ে বেশ আলোচিত অভিনেতা নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন বেশ কয়েক বছর। উদ্যোক্তাদের বলে দিচ্ছেন, তার অভিনীত কোনও চরিত্রকে যেন পুরস্কারের জন্য ভাবা না হয়! তার বিশ্বাস, যতই প্রশংসা করা হোক, শেষমেশ সেরার শিরোপা পাবেন এমন কেউ, যার অভিনয়কে হয়তো দশে এক দেবেন তিনি স্বয়ং।

আজকাল মাঝে মাঝেই হতাশায় ভোগেন। নিজের কেরিয়ার নিয়েও হাজারটা প্রশ্ন ভিড় করে মনে। কখনও মনে হয়, বলিউডের চলতি সময়টাই তার জন্য নয়। ঠিক এমনই দোলাচলে থাকা নওয়াজকে যখন ফোনে ধরা গেল তখন তিনি ভারসোভা-র বাড়িতে। সন্ধে হয়-হয়। সারা রাত শ্যুটিংয়ের জন্য তৈরি হচ্ছেন।

বেশ কয়েক দিন ধরে ভাল করে ঘুমোতে পারেননি। কাজের ক্লান্তিতে নয়, প্রিয় অভিনেতা ওম পুরী আর কোনও দিন ক্যামেরার সামনে দাঁড়াবেন না, অবিশ্বাস্য এই কাণ্ডটি যে ঘটে গেছে অল্প কয়েক দিন আগেই, তাই...!

''এখন সবাই ওর অভিনয় নিয়ে এত চোখের জল ফেলছেন, কিন্তু একবারও কেউ ভেবে দেখেছেন, ওর মতো অভিনেতা সারা জীবনে কতটুকু স্বীকৃতি পেয়ে গেলেন?'' ঘুম-ঘুম গলায় নওয়াজের প্রশ্ন।

''এখানে তো অভিনেতার কোনও কদর নেই। যদি ওম পুরীজিকে শেষ জীবনে স্রেফ পয়সার জন্য টুকরো কাজ করে যেতে হয়, আমাদের অবস্থাটা ভাবুন একবার'', চোরা আবেগ ছড়িয়ে পড়ল বিয়াল্লিশ বছরের অভিনেতার গলায়, যাকে কয়েক বছর আগে বলিউডের কয়েক জন বিদ্রুপ করে নাম দিয়েছিলেন, ''গরিবোঁ কা নওয়াজ'' (গরিবের নওয়াজ)।

শাহরুখ ‘পাগল’, তিনিও তাই। আগামী সপ্তাহে সেই ‘গরিব’-এর সঙ্গেই অবশ্য স্ক্রিন শেয়ার করবেন বলিউডের বাদশা শাহরুখ খান! এটাই নওয়াজের সেরা ছবি, বলে দিয়েছেন স্বয়ং শাহরুখ।

শাহরুখ সম্পর্কে নওয়াজ বলেন, ''শাহরুখের সঙ্গে কাজ করার একটা আলাদা মজা আছে। অত বড় অভিনেতা, অথচ যখন সেটে আসে, তখন একদম সাধারণ মানুষ''।

নিজের সম্পর্কে তিনি বলেন, ''মাঝে মাঝে মনে হয়, ভুল সময়ে জন্মেছি। যে রকম কাজ করতে চাই, সেটা হয় না। আর যেগুলো হয়, সেগুলোয় অনেক সময়ই মন ভরে না।''

নিজের নতুন ছবি ‘হারামখোর’ মুক্তি পেয়েছে গত সপ্তাহে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফেস্টিভ্যালে সেরার স্বীকৃতি পেলেও, সেই ছবি দেশের দর্শক দেখছেন প্রায় চার বছর পর। এ কথা তুলতেই আবার ক্ষোভ তার গলায়।

''আসলে আমাদের দেশে অধিকাংশ পরিচালকই একটা গণ্ডির বাইরে বেরোন না। সেই পাঁচটা গান, একটা ফাইট সিকোয়েন্স, আর শেষ পর্যন্ত নায়ক-নায়িকার মিলন। এই হচ্ছে অধিকাংশ মেনস্ট্রিম সিনেমার ভাষা।''

কয়েক বছর আগে যখন অনুরাগ কাশ্যপ, সুজয় ঘোষ-রা অন্য ধারার ছবির ধারণাটা বদলানোর চেষ্টা করছিলেন, তখন সেই ‘নিঃশব্দ বিপ্লব’ নিয়ে সবচেয়ে আশাবাদী যিনি ছিলেন, তারই নাম নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি।

''তবে আমরা বোধহয় ভুল ভাবছিলাম। যে ছবি ফেস্টিভ্যালে ভাল করছিল, আমরা ভাবছিলাম সেগুলো এখানেও ভাল করবে। কিন্তু...,'' বলছিলেন নওয়াজ।

কয়েক সেকেন্ড থেমে যোগ করলেন, ''আজকাল মাঝেমধ্যে বুঝতে পারি না যে, দর্শক ঠিক কী চায়? খুব ডিপ্রেসড লাগে মাঝেমাঝে। যে ছবিগুলো বিদেশে এত ভাল করে, সেগুলো তো আবার অনেক সময় এখানে মুক্তিই পায় না চট করে...!''

নাচতে শিখছেন, বাঁচতেও। গত ছ’বছরে আটটা ছবিতে তিনি নায়ক। অথচ, তার একটাও এখনও রিলিজ করেনি। আদৌ করবে যে, সেটাও হলফ করে বলতে পারছেন না তিনি স্বয়ং।

তবু, ওই রকম অন্য ধারার ছবিই আরও করতে চান নওয়াজ। তিনি বলেন, ''পপুলার ছবি করলে পেট ভরবে ঠিকই, কিন্তু মন ভরবে না যে! ওই ছবিগুলো না করলে বাঁচতে পারব না তো। স্বপ্নও দেখতে পারব না যে।''

যখন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-র ‘আনোয়ার কা আজব কিস্সা’ শ্যুট করতে কলকাতায় এসেছিলেন, ভেবেছিলেন বুদ্ধদেবের সেই ছবি তাক লাগিয়ে দেবে দেশের দর্শকদের। কিন্তু সেই ‘কিস্সা’ ফেস্টিভ্যালের বাইরে মুক্তি পায়নি আজও।

''প্রতিটা ফ্লপ বা মুক্তি না পাওয়া ছবি থেকেও কত কিছু শেখার আছে। ছবি বেরোবে কি না বেরোবে, এই নিয়ে ভাবলে তো অভিনেতা কোনও দিন কাজই করতে পারবে না। বুদ্ধদা’র ওই ছবিটা করার পরই তো আরও ভাল কাজ করেছি। শিখছি তো প্রত্যেক দিন'', তিনি বলছিলেন।

বলিউডে তার ঘনিষ্ঠরাও মানছেন এই কয়েক বছরে সত্যিই অনেক কিছু শিখেছেন নওয়াজ। যেমন, নাচ। প্রশ্ন করতেই একটু হাসলেন। স্বীকার করলেন ‘মুন্না মাইকেল’ ছবির জন্য নাচ শেখাটা জরুরি ছিল। ''আমি একটুও নাচতে পারতাম না আগে। ভালও লাগত না। কিন্তু একদিন মনে হল, যদি ছবির প্রয়োজনে গরিবের ছেলে গল্ফ খেলতে পারে, তা হলে নাচতে পারবে না কেন?''।

''মুম্বাইয়ের রাস্তায় যখন খালি পেটে ঘুরে বেড়াতাম, তখন যেমন বাঁচার ইচ্ছেটা ছিল। আজও তাই মনে হয়। ভাগ্যিস এতগুলো রিলিজ না হওয়া ছবি ছিল!''

''বাঙালি ডিরেক্টররা আমায় খুব ভালবাসেন বোধহয়...'' কথা বলতে বলতেই ইয়ার্কির সুরে বলছিলেন ‘কাহানি’-র ইন্সপেক্টর খান। খুব ভুল যে বলেননি, তার প্রমাণ দেয় তার সিভিতে এতগুলো বাঙালি পরিচালকের নাম।— সুজয় ঘোষ, বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, ঋভু দাশগুপ্ত...। এবার নওয়াজের ইচ্ছে সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অন্তত একটা বাংলা ছবি করার।

কথা বলতে বলতে শ্যুটিংয়ে বেরোনোর জন্য তৈরি হচ্ছিলেন নওয়াজ। নিজের ভারসোভা-র বিলাসবহুল ফ্ল্যাট থেকে বেরোলে আজও চোখে পড়ে রাস্তার সেই দোকানগুলো, যেখান থেকে এক সময় নিয়মীত খেতেন।

সেই দিনগুলো ভোলেননি এই মুহূর্তের বলিউডের অন্যতম ব্যস্ত অভিনেতা। আসলে ক্যামেরা বন্ধ হলে আজও যে তিনি সেই গরিবের নওয়াজ।

সূত্র: আনন্দবাজার


পিএনএস/বাকিবিল্লাহ্

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন