১০ টাকার কলম ৮০ টাকা দেখিয়ে ২ কোটি উত্তোলন

  31-10-2019 01:38AM



পিএনএস ডেস্ক: কিশোর-কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও পরিচ্ছন্নতা এবং বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের বিষয়ে অবহিতকরণের লক্ষ্যে আইইসি অপারেশনাল প্ল্যানের আওতায় দেশের বিভিন্ন উপজেলায় ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৪৮৬টি কর্মশালার জন্য সাত কোটি টাকা বরাদ্দ করে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের আইইএম ইউনিট।

কিন্তু কর্মশালার আয়োজন না করে প্রকল্প পরিচালক আশরাফুন্নেছা ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে টাকা উত্তোলন করেছেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এই কাজে তাকে সহযোগিতা করেছেন একই বিভাগের বিভিন্ন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। এরই মধ্যে দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন প্রকল্প পরিচালক।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কর্মশালার আয়োজন না করে ভুয়া বিল ভাউচার দিয়ে প্রকল্পের টাকা উত্তোলন করেছেন পরিচালক। সেই সঙ্গে প্রতিটি পণ্যের দাম নির্ধারিত দামের চেয়ে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর মধ্যে ১০ টাকা মূল্যের একটি কলমের দাম ধরেছেন ৮০ টাকা, ২০ টাকার একটি প্যাডের দাম দেখিয়েছেন ৭০ টাকা। একটি ব্যাগের দাম ৩৭০ টাকা গায়ে লেখা থাকলেও ভুয়া ভাউচারে ওই ব্যাগের দাম এক হাজার ৫০ টাকা দেখিয়েছেন। একইভাবে অন্যান্য উপকরণের দাম কয়েকগুণ বেশি দেখিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক।

অনুসন্ধানে দেখা যায়, যেসব দোকান থেকে এসব পণ্য কেনা হয়েছে বাস্তবে তার অস্তিত্ব নেই। ৪৮৬ কর্মশালার মধ্যে মৌলভীবাজারের রাজনগর ও বড়লেখায় কর্মশালার আয়োজন করা হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে। আদৌ সেখানে কোনো কর্মশালা হয়েছে বলে কারও জানা নেই। এরপরও রাজনগর ও মৌলভীবাজার জেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তারা বলছেন, তারা ওসব কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু দুই কর্মশালার নামে যেসব বিল ও ভাউচার করা হয়েছে তার অনুসন্ধান করতে গিয়ে কোনোটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।

মৌলভীবাজারের রাজনগর ও বড়লেখার অনুষ্ঠিত কর্মশালার জন্য মৌলভীবাজারের স্টেশন রোডের ‘মেসার্স রফিক ফটোকপি অ্যান্ড কম্পোজ’ নামের দোকান থেকে তিন হাজার টাকার ফটোকপি করা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু বাস্তবে এই নামের কোনো দোকান এমনকি ‘স্টেশন রোড’ নামে কোনো রোড মৌলভীবাজারে নেই।
১০ টাকার কলম ৮০ টাকা, ৩৭০ টাকার ব্যাগ ১ হাজার ৫০ টাকা এবং ২০ টাকার প্যাড ৭০ টাকায় যেসব দোকান থেকে কেনা হয়েছে তার একটি ‘মেসার্স আঁচল পেপার, স্টেশনারি অ্যান্ড লাইব্রেরি’। এটির ঠিকানাও স্টেশন রোড মৌলভীবাজার ব্যবহার করা হয়েছে। অথচ মৌলভীবাজারে ‘স্টেশন রোড’ নামে কিছুই নেই। তবে এ বিলের মেমোতে ক্রেতার নাম-ঠিকানা লেখা হয়েছে পরিচালক আইইএম এবং প.প. অধি. ঢাকা।

এদিকে, ‘সাম্পান রেস্টুরেন্ট অ্যান্ড ক্যাটারিং’ নামে একটি হোটেলে কর্মশালার উদ্বোধনী ও আপ্যায়ন সমাপনীর বিল করা হয়েছে। বাস্তবে এই নামের কোনো হোটেল নেই। তবে সিলেট সিটি সাম্পান নামের একটি রেস্টুরেন্ট ছিল যা অনেক দিন ধরে বন্ধ। এই প্রকল্পে শুধু ভুয়া বিল ভাউচার নয়, কর্মশালায় ব্যবহারের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো ধরনের টেন্ডার বা কোটেশনের নিয়ম মানা হয়নি।

এছাড়া কর্মশালায় রিসোর্স পার্সনদের সম্মানীভাতা আয়করসহ ১ হাজার ৬৮০ টাকা, স্থানীয় সমন্বয়কারীদের সম্মানীভাতা আয়করসহ এক হাজার টাকা, অংশগ্রহণকারীদের ভাতা ৭০০ টাকা দেখিয়ে বিল উত্তোলন করা হয়েছে।

উপজেলা পর্যায়ে কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের সম্মানী প্রদানের তালিকার নাম ও স্বাক্ষর ঢাকা অফিসে বসে ইচ্ছামতো বসিয়ে এসব টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন একই বিভাগের অন্য কর্মচারীরা। এমন কিছু তথ্য-প্রমাণ জাগো নিউজের হাতে রয়েছে। পাশাপাশি একই হাতের লেখা কিন্তু অসংখ্য বিল এমন কিছু বিল-ভাউচার রয়েছে। কর্মশালা না করে শুধু কাগজে-কলমে দেখিয়ে অধিদফতরের আইইএম ইউনিটের পরিচালক আশরাফুন্নেছা এসব টাকা উত্তোলন করেছেন।

এরই মধ্যে বিষয়টি জানতে পেরে গত বৃহস্পতিবার অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সেখানে ধরা পড়েছে নানা অসঙ্গতি। দরপত্রের শর্ত লঙ্ঘন করে আমদানি-রফতানিকারকের লাইসেন্সধারী ‘সুকর্ন ইন্টারন্যাশনাল কোং’ এবং ‘মেসার্স রুহি এন্টারপ্রাইজ’ নামে দুটি প্রতিষ্ঠানকে বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজ দেয়া হয়েছে। দুটি প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি ৮৫ লাখ টাকার বিল প্রদান করা হয়েছে বলে দুদকের কাছে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইইএম ইউনিটের এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, সিলেট-চট্টগ্রামে ব্যাপকহারে কাগজে-কলমে এসব কর্মশালা করা হয়েছে। বাস্তবে কিছুই হয়নি। যেহেতু বিল ভাউচারের সঙ্গে বাস্তবের কোনো প্রমাণ নেই, ধরে নেন সবই ভুয়া। এসব কর্মশালা শুধু কাগজে-কলমে হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মাত্র তিনদিনে ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলার ৩৩টি উপজেলায় কর্মশালা সম্পন্ন করা হয়েছে। যা বাস্তবে অসম্ভব। এসব কর্মশালাও কাগজে-কলমে হয়েছে।
কোনো কাজ না করেই ৪৮টি কোটেশনের মাধ্যমে দুই কোটি ৪০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন আশরাফুন্নেছা। যার কোনো নথিপত্র নেই। ভুয়া কার্যাদেশ তৈরি করে বিলের সঙ্গে সংযুক্ত করে এসব বিল এজি অফিস থেকে পাস করানো হয়েছে। যদিও সরকারি নিয়ম অনুযায়ী একজন পরিচালক বছরে ছয়টির বেশি কোটেশন করার নিয়ম নেই। এসব বিল উত্তোলন করে ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে রেখেছেন তিনি। যদিও সরকারি অর্থ ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে রাখার বিধান নেই।

এসব বিষয়ে জানতে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের পরিচালক (আইইএম) আশরাফুন্নেছার মোবাইল নম্বরে বার বার কল দিলেও রিসিভ করেননি।

মৌলভীবাজার পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের উপপরিচালক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, মৌলভীবাজারের রাজনগর এবং বড়লেখায় কর্মশালা হয়েছে। সেখানে আমি উপস্থিত ছিলাম। তবে ভুয়া বিল ভাউচারের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। এই প্রকল্পে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।

জানতে চাইলে পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের মহাপরিচালক কাজী আ খ ম মহিউল ইসলাম বলেন, তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।

পিএনএস/ হাফিজুল ইসলাম


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন