বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণ

  26-11-2016 08:32PM

পিএনএস: গর্ভধারণ করতে না পারা, শরীরে পুরুষের মতো লোম, অনিয়মিত মাসিক ইত্যাদি বেশ কিছু সমস্যা হতে পারে পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম থেকে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রোগটি শরীরে আছে তা নির্ণিত হতে সময় লাগে। অথচ জীবনযাপনে সামান্য পরিবর্তন করলেই রোগটি যেসব অসুবিধা করে তা থেকে অনেক ক্ষেত্রে নিজেকে রক্ষা করা যায়।

সংক্ষেপে রোগটি পিসিওএস নামেই বেশি পরিচিত। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম চিকিৎসা করে ভালো হয় কম—এমন অসুখ। মূলত এক ধরনের হরমোনজনিত অসুখ, যা সাধারণত বয়ঃসন্ধি ও প্রজননক্ষম (১৫ থেকে ৪৫ বছর) বয়সের নারীদের মধ্যে দেখা যায়।

বহু ক্ষেত্রে নারীরা পিসিওএসে আক্রান্ত থাকে; কিন্তু জানতে পারে না। যদিও দিনের পর দিন সে অসুবিধাবোধ করে। অজ্ঞতার জন্য অনেকেই রোগটিকে নারী শরীরের প্রাকৃতিক অসুবিধা মনে করে। যেমন অনিয়মিত মাসিক, অতিরিক্ত ওজন ইত্যাদি। কিন্তু এগুলো পিসিওএসের লক্ষণ হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে নারী যখন সন্তান ধারণে অক্ষম হয়, তখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে প্রায়ই দেখা যায় তিনি আসলে পিসিওএসে আক্রান্ত।


রোগটির লক্ষণের মধ্যে আছে—

♦ সন্তান ধারণে অক্ষমতা বা ইনফার্টিলিটি

♦ ঠোঁটের ওপর ও শরীরের বিভিন্ন অংশে অতিরিক্ত লোম

♦ ঘাড়ের পেছনে কালো দাগ হয়ে যাওয়া

♦ গিলতে অসুবিধা

♦ বগল, ঊরু কালো হয়ে যাওয়া

♦ হরমোনের ভারসাম্যহীনতা

♦ হার্ট ও রক্তনালির অসুখ

♦ ডিম্বাশয়ে অসংখ্য ছোট ছোট সিস্ট

♦ পেটে ব্যথা

♦ মাসিকের সময় বেশি রক্ত যাওয়া

♦ বেশি ঢেকুর হওয়া


কেন হয়?

অনেক গবেষক মনে করেন এটি জিনগত (বংশগত) কারণে হতে পারে। কারণ কারো পরিবারে মা, বোন, খালা, নানির পিসিওএস থাকলে ওই পরিবারে জন্ম নেওয়া মেয়েদের পিসিওএসে আক্রান্তের হার বেশি হয়। তবে এ ধরনের ইতিহাস ছাড়াও পিসিওএস হতে পারে। তাই বলা যায়, ঠিক কী কারণে রোগটি হয়, তা এখনো জানা যায়নি। পিসিওএসের আরেকটি কারণ মনে করা হয় হরমোনের ভারসাম্যহীনতাকে। কারণ পিসিওএস থাকলে নারী শরীরে পুরুষ হরমোন এন্ডোজেন ও ইনসুলিন হরমোনের মাত্রা বেড়ে যায়।



সন্তান ধারণে অক্ষমতা

মেয়েদের ডিম্বাশয়ে কিছু হরমোনের (এলএইচ, এফএসএইচ) প্রভাবে ডিম্বাণু পরিপক্ব হয়। সাধারণত মাসিক শুরু হওয়ার দুই সপ্তাহ পর ওই ডিম্বাণু ডিম্বাশয় থেকে বের হয়। একে বলা হয় ওভুলেশন। এই পরিপক্ক ডিম্বাণু পরবর্তীতে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত হয়ে ভ্রূণ তৈরি করে। এ ভ্রূণ থেকেই মানব সন্তানের জন্ম হয়।

পিসিওএসে আক্রান্তদের ডিম্বাশয়ে ঠিকমতো এই হরমোনগুলো তৈরি হয় না অথবা হরমোনের অসামঞ্জস্যতা থাকে। এ কারণে ডিম্বাণুও সময়মতো পরিপক্ব হয়ে ডিম্বাশয় থেকে বের হতে পারে না বা ওভুলেশন হয় না। এ কারণে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত হয়ে ভ্রূণও তৈরি হয় না। তাই বন্ধ্যত্ব দেখা দেয়। এই অপরিপক্ব ডিম্বাণুগুলো আল্ট্রাসনোগ্রাফিতে ছোট ছোট সিস্ট বা ফোসকার মতো দেখা যায়। তাই রোগটিকে পলিসিস্টিক (অনেক সিস্টযুক্ত জরায়ু) ওভারি বলা হয়।



রোগ নির্নয়

সাধারণত উপসর্গ দেখে ধারণা করা হয় রোগটি আছে কি না। তবে নিশ্চিত হতে কিছু হরমোন পরীক্ষাও জরুরি। এগুলোর মধ্যে আছে—

♦ মাসিকের দ্বিতীয় দিন রক্তের এলএইচ, এফএসএইচ হরমোনের মাত্রা পরীক্ষা করা

♦ রক্তের এএমএইচ ও টেস্টোস্টেরন মাত্রা পরীক্ষা

♦ রক্তের চিনির মাত্রা

♦ আল্ট্রাসনোগ্রাফি

পিসিওএসজনিত বন্ধ্যত্বের চিকিৎসা

পিসিওএস একেবারে সেরে যায় না। তবে বহু ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এমনকি গর্ভধারণও সম্ভব হয়।

জীবনযাপনে পরিবর্তন

আক্রান্ত বেশির ভাগ নারীর অতিরিক্ত ওজন থাকে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণ খুব জরুরি। কারণ ওজন কমলে ওভুলেশন নিয়মিত হয়, যা সন্তান ধারণ ক্ষমতা বাড়ায়। ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে যায় এবং হরমোন সামঞ্জস্যতা ফিরে আসে। ফলে মাসিকও নিয়মিত হয়।

খাবারের তালিকায় তাই চর্বি ও কার্বোহাইড্রেট যতটা সম্ভব কমিয়ে দিতে হবে। যেমন—আলু, চিনি, ময়দা, ভাত। প্রয়োজনে লাল আটার রুটি খাওয়া যেতে পারে। বরং প্রতিদিন খেতে হবে সবজি। আম, কাঁঠাল, কলা, আঙ্গুরের মতো মিষ্টি ফল কম খেতে হবে। অন্যান্য ফল খাওয়া চলবে। ভাজাপোড়া ও ফাস্টফুড খাওয়া যাবে না। সকালে অথবা বিকেলে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট হাঁটতে হবে। সম্ভব হলে নিয়মিত ব্যায়ামও করতে হবে।

ক্লোমিফেন সাইট্রেট বা লেট্রোজোল জাতীয় ওষুধ

এ-জাতীয় ওষুধ দিয়েই বেশির ভাগ পিসিওএসজনিত বন্ধ্যত্ব সমস্যায় ভুগছেন এমন নারীদের চিকিৎসা শুরু করা হয়। এসব ওষুধের মূল লক্ষ্য ওভুলেশন বা ডিম্বাণুর পরস্ফুিটন ঘটানো।

ক্লোমিফেন সাইট্রেট লেট্রোজোলের সঙ্গে মেটফরমিন

সাধারণত বেশি ওজন আছে এমন নারীদের ক্ষেত্রে এভাবে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এতে ওভুলেশন বা ডিম্বাণু পরস্ফুিটনের সম্ভাবনা বাড়ে এবং শরীরের ওজন কমাতে সাহায্য করে।

গোনাডোট্রপিন ইনজেকশন

যাদের উপরোক্ত চিকিৎসায় কাজ হয় না, তখন তাদের ডিম্বাণু পরস্ফুিটন ও ডিম্বাণুর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এই ইনজেকশন দেওয়া হয়।

ইনট্রাইউটেরাইন ইনসেমিনেশন

এ প্রক্রিয়ায় প্রথমে ওষুধ দিয়ে ডিম্বাণুর পরস্ফুিটন ঘটানো হয় এবং নির্ধারিত দিনে স্বামীর শুক্রাণু সিরিঞ্জের মাধ্যমে স্ত্রীর জরায়ুতে সরাসরি প্রবেশ করানো হয়। এ চিকিৎসার মাধ্যমে ২০-৩০ শতাংশ পিসিওএস আক্রান্ত নারী গর্ভধারণ করতে পারেন।

ল্যাপারোস্কপিক ওভারিয়ান ড্রিলিং

এটি এক ধরনের সার্জারি চিকিৎসা। কমপক্ষে ছয় মাস থেকে এক বছর কাউকে ওষুধ বা ইনজেকশন দিয়ে চিকিৎসা করার পরেও সন্তান আসেনি, এমন ক্ষেত্রে এটি করা যায়। এতে অত্যাধুনিক ল্যাপারোস্কোপ যন্ত্রের মাধ্যমে ডিম্বাশয়ের গায়ে কয়েকটি ছিদ্র করা হয়। তাই এ প্রক্রিয়াকে ওভারিয়ান ড্রিলিংও বলা হয়।

টেস্ট টিউব বেবি

ওষুধ ও অন্যান্য চিকিৎসায় কাজ না হলে টেস্ট টিউব বেবি পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া হয়। যদিও এটি ব্যয়বহুল চিকিৎসা; কিন্তু এর মাধ্যমে ৬০ শতাংশ পিসিওএসে আক্রান্ত মহিলা (যাদের বয়স ৩৫-এর নিচে) গর্ভধারণ করতে সক্ষম হয়।



মনে রাখুন

বেশির ভাগ পিসিওএসজনিত বন্ধ্যত্বের ক্ষেত্রে ওজন কমিয়ে ওষুধ সেবন করলেই রোগটির উপসর্গ থেকে বাঁচা যায়, গর্ভধারণও করা যায়। তাই যাদের পিসিওএস আছে তাদের উচিত ওজন নিয়ন্ত্রণ করা ও নিয়মিত ব্যায়াম করা। যাদের পিসিওএসের কোনো লক্ষণ আছে, তাদের উচিত ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করা।


পিএনএস/বাকিবিল্লাহ্


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন