কিন ইমেজে এগিয়ে হিলারি বিতর্কে বিপর্যস্ত ট্রাম্প

  29-10-2016 01:05AM

পিএনএস:বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আগামী ৮ নভেম্বরের নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন চলছে শেষ মুহূর্তের প্রচার-প্রচারণা। প্রধান দুই প্রার্থী ডেমোক্র্যাট পার্টির হিলারি কিনটন ও রিপাবলিকান পার্টির ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত চষে বেড়াচ্ছেন।

নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত প্রকাশিত সবগুলো জরিপের ফলাফলেই স্পষ্টত এগিয়ে আছেন হিলারি। বিভিন্ন পর্যবেক্ষক সংস্থা ও সংবাদমাধ্যমের এসব জরিপে বেশির ভাগ ভোটারের সমর্থন সাবেক এই ফার্স্ট লেডির প্রতি। এ থেকে ধারণা করা যায়, মার্কিনিরা হয়তো তাদের পরবর্তী রাষ্ট্রনেতা হিসেবে মিসেস কিনটনের ওপরই আস্থা রাখবে। হিলারির প্রতি মার্কিনিদের এই আস্থার যথাযথ কারণ দুই প্রার্থীর মধ্যে গুণ ও মানগত কিছু বিষয়, যা পার্থক্য গড়ে দিয়েছেন নির্বাচনের মাঠে।

গ্রহণযোগ্য হিলারি, অচেনা ট্রাম্প
দীর্ঘ দিন ধরেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হিলারি কিনটন একটি পরিচিত নাম। ১৯৯৩ সালে ফার্স্ট লেডি হিসেবে হোয়াইট হাউজে আসেন তিনি। স্বামী বিল কিনটন দুই দফায় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার কারণে দীর্ঘ আট বছর ছিলেন ফার্স্ট লেডির ভূমিকায়। শুরু থেকেই হিলারি ছিলেন অন্যান্য প্রেসিডেন্টের স্ত্রীদের চেয়ে ব্যতিক্রম। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ও স্বতন্ত্র পেশাদার ক্যারিয়ার সমৃদ্ধ ফার্স্ট লেডি। শুরু থেকেই প্রেসিডেন্ট কিনটনের সাথে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজে ভূমিকা রাখেন হিলারি। এমনকি রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী বিভিন্ন ইস্যুতেও তার ভূমিকা থাকত বলে সমালোচকরা বলেন। তবে বিভিন্ন সেবামূলক কাজে তিনি বেশ জনপ্রিয় হন। কিনটন হেলথ কেয়ার প্রোগ্রামের প্রধান ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শিশুদের স্বাস্থ্যবীমা, বিশ্বব্যাপী নারী ও শিশু নির্যাতনের প্রতিরোধে পদক্ষেপসহ বিভিন্ন সামাজিক কার্যক্রমে খ্যাতি ছিল এই ফার্স্ট লেডির। ১৯৯৫ সালে বেইজিংয়ে জাতিসঙ্ঘের নারীবিষয়ক সম্মেলনে তার বিখ্যাত উক্তিÑ ‘নারীর অধিকারই মানবাধিকার, মানবাধিকারই নারীর অধিকার’ বিশ্বব্যাপী তুমুল আলোচিত হয়। এসব কিছুর সুবাদেই মার্কিন সমাজে হিলারির ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা, যা কাজে লাগিয়ে ২০০০ সালে নিউ ইয়র্ক থেকে সিনেটর নির্বাচিত হন তিনি। এরপর দিনে দিনে নিজের রাজনৈতিক দক্ষতাও প্রমাণ করেছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নের জন্য লড়াই করেন। সেবার বারাক ওবামার কাছে হেরে গেলেও পরের বছরই ওবামা সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান।

বিপরীতে ডেমোক্র্যাট দলীয় প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্পূর্ণই অচেনা মার্কিন ভোটারদের কাছে। বড় ব্যবসায়ী ও টিভি উপস্থাপক হিসেবে তার পরিচিতি থাকলেও রাজনীতিক হিসেবে তিনি ছিলেন আলোচনার বাইরে। অবশ্য তার রাজনৈতিক জীবন নানা ঘটনায় ভরপুর। কয়েক দফা দলবদল করে নাম লিখিয়েছেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টি, রিফর্ম পার্টি, রিপাবলিকান পার্টিতে। কিছু দিন ছিলেন দলছুট স্বতন্ত্র রাজনীতিক হিসেবে। তাই রাজনৈতিক দক্ষতা ও নৈপুণ্য বিবেচনায় হিলারির তুলনায় ভোটের মাঠে পিছিয়ে থাকার যথেষ্ট কারণ রয়েছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের।
কিন ইমেজের হিলারি, ট্রাম্পের সঙ্গী বিতর্ক
এবারের নির্বাচন আলোচনা-সমালোচনায় অতীতের যেকোনো মার্কিন নির্বাচনকে হার মানিয়েছে। এত সমালোচনা, বিতর্ক আর ব্যক্তিগত কাদা ছোড়াছুড়ি আর কোনো দিন দেখেনি যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। আর এ ক্ষেত্রে মূল ভূমিকায় রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। শুরু থেকেই ট্রাম্প ছিলেন স্বমহিমায় (!) উজ্জ্বল। একের পর এক বিতর্কিত মন্তব্য ও কর্মকাণ্ডের কারণে সব মহলের সমালোচনায় বিদ্ধ হয়েছেন এই রিপাবলিকান। মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করা, অভিবাসীদের দেশ থেকে বের করে দেয়া, কৃষ্ণাঙ্গ ও নারীদের সম্পর্কে অপমানসূচক বক্তব্য, ম্যাক্সিকো সীমান্তে দেয়াল নির্মাণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বিতর্কিত বক্তব্য ছাড়াও সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল কিনটনের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন ও হিলারিকে ‘নেস্টি ওম্যান’ বলে মন্তব্য করেছেন। এখন পর্যন্ত ১১ জন নারী ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছেন। নারীদের নিয়ে অশ্লীল কথোপকথন ফাঁস হওয়ার পর জনসমক্ষে ক্ষমাও চেয়েছেন। সর্বশেষ গত সপ্তাহে অভিযোগ তুলেছেন নির্বাচনে কারচুপির। পরাজিত হলে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করারও হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প।

বিপরীতে হিলারি কিনটন অনেকগুণ ইতিবাচক ইমেজ নিয়ে হাজির হয়েছেন ভোটের মাঠে। ট্রাম্পের বিভিন্ন আক্রমণের যুক্তিযুক্ত জবাব দিলেও কখনো ব্যক্তিগত আক্রমণের পথে হাঁটেননি। এমনকি অবশিষ্ট দিনগুলোতে ট্রাম্পের কোনো কথার প্রতিক্রিয়াও জানাবেন না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একমাত্র ই-মেইল কেলেঙ্কারি ছাড়া আর কোনো বিষয়েই হিলারিকে বিতর্কের মুখোমুখি হতে হয়নি। নর্থ ক্যারোলিনার রিপাবলিকান কার্যালয়ে হামলার পর ট্রাম্প যখন ডেমোক্র্যাটদের দায়ী করে ‘জানোয়ার’ বলে মন্তব্য করেছেন, রাজনৈতিক শিষ্টাচারের নজির স্থাপন করে হিলারি সেই ঘটনার নিন্দা ও তদন্তের দাবি জানিয়েছেন।

রাষ্ট্রনীতি ও দৃষ্টিভঙ্গিতে পার্থক্য
যেকোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীকে তার ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রনীতির বিষয়ে ভোটারদের কাছে স্পষ্ট ধারণা পৌঁছে দিতে হয়। এবারের মার্কিন নির্বাচনে অবশ্য তা কমই হয়েছে। তার মধ্যেও হিলারি কিনটন তার কিছু ইতিবাচক ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা পেশ করেছেন, যেগুলোর মধ্যে রয়েছেÑ গ্রহণযোগ্য ট্যাক্স পদ্ধতি, দারিদ্র্য বিমোচন, এইডস প্রতিরোধ ও স্বাস্থ্যসেবা, অস্ত্র আইন। পাশাপাশি মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে তার রয়েছে বাস্তব অভিজ্ঞতা। এ বিষয়গুলো ভোটারদের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রেখেছে।

অন্য দিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প কিছু বিষয়ে ইতিবাচক পরিকল্পনা পেশ করলেও সমালোচিত হয়েছেন বৈদেশিক নীতির বিষয়ে। ইতোমধ্যেই রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সাথে তার সখ্যের একটি ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। নির্বাচিত হলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সামরিক জোট ন্যাটো ভেঙে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন, মুসলিমদের কর্মকাণ্ডের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। তার কট্টর অভিবাসন নীতি ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনাও ভোটারদের মন জয় করতে পারছে না।

যেখানে পিছিয়ে হিলারি
রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। তাই ভোটের মাঠের এ চিত্রই যে সরাসরি নির্বাচনের ফলাফলে প্রতিফলিত হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনপদ্ধতির জটিলতার কারণে প্রায়ই জরিপের ফলাফল সরাসরি নির্বাচনে অনূদিত হয় না। ২০০০ সালে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী আল গোর জাতীয়ভাবে বেশি ভোট পেলেও ইলেক্টোরাল কলেজে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের আরেকটি প্রবণতা হচ্ছে টানা দুই মেয়াদে একটি দলকে ক্ষমতায় রাখে, এরপর অন্য দলকে দেশ পরিচালনার সুযোগ দেয়। সে ক্ষেত্রে হিলারির প্রতিপক্ষ হতে পারে এই ঐহিত্য। বিগত ৬৮ বছরে মাত্র একবারই কোনো দল টানা তৃতীয় নির্বাচনে জয় পেয়েছে (রিপাবলিকানÑ ১৯৮০, ৮৪ ও ৮৮)। গত দুই মেয়াদে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বারাক ওবামার পর তাই একই দল থেকে নির্বাচিত হওয়া হিলারির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া একজন নারীকে মার্কিনিরা দেশ পরিচালনার ভার দিতে কতটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও হিলারির কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য হয়নি মার্কিনিদের কাছে। পাশাপাশি অনেকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের কট্টর মানসিকতাকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন। তাদের ধারণা, ট্রাম্প হয়তো জঙ্গিবাদের মতো হুমকিগুলো কঠোরহস্তে দমন করতে পারবেন।


হিলারি ফ্যাক্ট ফাইল
ষপররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে হিলারির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বুশ প্রশাসনের রেখে যাওয়া ভঙ্গুর পররাষ্ট্রনীতি মেরামত করা, যা অত্যন্ত সফলভাবেই করেছেন।
ষপারমাণবিক কর্মসূচির কারণে ইরানের ওপর আন্তর্জাতিক অবরোধ এবং ওসামা বিন লাদেনকে হত্যার জন্য মার্কিন জনগণ হিলারিকে সফল মনে করে।
ষ৯/১১ হামলার পর আহতদের চিকিৎসা সহায়তা ও নিউ ইয়র্ক নগরী পুনর্গঠনে তহবিল সংগ্রহ করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
ষদীর্ঘ ৪০ বছর লড়াই করেছেন পরিবার ও শিশুদের সুরক্ষায়। বিশ্বব্যাপী নারী নির্যাতন রোধে রেখেছেন ব্যাপক ভূমিকা।
ষ২০১২ সালে মধ্যপ্রাচ্য সফরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইসরাইল ও হামাসকে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত করেছেন।
ষকূটনৈতিক বৈরিতা সত্ত্বেও চীনে ৫০ শতাংশ রফতানি বৃদ্ধি করেছেন।
ষআফগানিস্তান ও ইরাক যুদ্ধে সমর্থন এবং লিবিয়া অভিযানের পরিকল্পনাকারী হিসেবে সমালোচিত দেশে-বিদেশে।
ষঅভিযোগ আছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ক্ষমতা ব্যবহার করে কিনটন ফাউন্ডেশনের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে তহবিল সংগ্রহের।
ষব্যক্তিগত ই-মেইলে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান-প্রদান নিয়ে সমালোচনার শিকার হয়েছেন।




পিএনএস/বাকিবিল্লাহ্

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন