নায়িকা থেকে মুখ্যমন্ত্রী, রূপকথার একজীবন

  06-12-2016 01:16PM


পিএনএস ডেস্ক: রূপকথার মতোই বর্ণাঢ্য একজীবন কাটিয়ে পরলোক চলে গেলেন তামিলনাড়ুর প্রাণের মানুষ ‘আম্মা’। ভারতের তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জে জয়ললিতাকে তার লাখ লাখ ভক্ত আম্মা বলেই ডাকতেন। অভিনেত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী হওয়া ভারতের এই জননেত্রী ৬৮ বছর বয়সে দুনিয়া ছাড়লেন। জয়ললিতার পরলোকগমনে শোকের কালো চাদরে ঢেকেছে গোটা তামিলনাড়ু।

জয়ললিতা জয়রামের সবার কাছে পরিচিত জে জয়ললিতা, কুমারী জয়ললিতা, জয়া, পুতরাচি থালাইভিসহ নানা নামে। তবে যে ভালোবাসার নামটিতে তিনি সবচেয়ে খ্যাত তা হল ‘আম্মা’। গোটা দক্ষিণ ভারতেই তিনি আম্মা নামে ছোট বড় সবার কাছে পরিচিতি পেয়েছেন। আর তামিলনাড়ুতে তাঁকে নিয়ে যে ধরনের উন্মাদনা ও উচ্ছ্বাস তা ওই দেশের আর কোনও রাজ্যের নেতা-নেত্রী পেয়েছেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে।

ভারতের রাজনীতিতে অন্যতম কুশলী জয়ললিতা একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী ছিলেন। একসময় এমজি রামচন্দ্রনের নায়িকা হিসেবে একের পর এক সুপারহিট ছবিতে অভিনয় করেন। রাজনীতিতে তিনিই জয়ললিতার গুরু। দক্ষিণ ভারতে জয়া হলেন সেই স্মার্ট অভিনেত্রী যিনি তামিল ছবিতে প্রথম স্কার্ট পরেছিলেন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত জয়ললিতা বেশিরভাগ সময়ই এমজি রামচন্দ্রনের সঙ্গে ছবি করেছেন। এরপর ১৯৮২ সাল থেকে এমজিআরের হাত ধরেই রাজনীতিতে পা রাখেন আম্মা. হাল ধরেন আন্না দ্রাবিড় মুনিত্রা কাঝাগম -এআইএডিএম দলের। জয়ললিতার দূরদর্শী নেতৃত্ব দ্বিধাবিভক্ত দলকে বসায় তামিলনাড়ুর মসনদে। মাঝে ষড়যন্ত্রীদের ওঠানো দূনীর্তির অভিযোগ তাকে ঠেলে দিয়েছিল কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে। সেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করেই বিপুল বিক্রমে ২০১৬ সালে ফের মুখ্যমন্ত্রী হন জয়ললিতা৷

রূপকথার মতোই জীবন কাটিয়ে যাওয়া ‘আম্মা’ জয়ললিতার জন্ম ১৯৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মহিশূরের (বর্তমানে কর্ণাটক) মাণ্ড্য জেলার পাণ্ডবপুরা তালুকে। তার বাবার নাম জয়রাম ও মায়ের নাম বেদবল্লি। বাড়িতে জয়ললিতাকে সবাই জয়া নামেই ডাকতো। জন্মের দুই বছর পরই বাবা জয়রাম মারা যান। এরপরই সংসার চালাতে কাজে নামতে হয় জয়ার মা বেদবল্লিকে। বিধবা বেদবল্লি বোন অম্বুজাবল্লির সঙ্গে চলে আসেন মাদ্রাজে। জয়া থেকে যান মহিষাশূরে। ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত তিনি কর্ণাটকেই দাদু-দিদার কাছেই ছিলেন।

জয়ার মা বেদবল্লি একসময় শখের নাটকে অভিনয় করতেন। চেন্নাইয়ে সেই বিদ্যা কাজে লাগিয়ে উপার্জনে জন্য তামিল সিনেমায় ছোটখাট চরিত্রে অভিনয় শুরু করেন। পর্দায় তাঁর নাম ছিল সন্ধ্যা। ধীরে ধীরে তামিল ছবিতে সন্ধ্যার ব্যস্ততা বাড়ে, অার্থিক অবস্থারও পরিবর্তন হয়। ১৯৫৮ সালে জয়াকে তিনি চেন্নাইয়ে নিয়ে আসেন। সেখানকার চার্জ পার্ক কনভেন্ট কলেজেই গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন মেধাবী জয়লতিতা। তবে তার অাগেই লাবণ্যময়ী মেয়েটির অভিষেক হয়ে যায় রূপালী পর্দায়।

মায়ের সঙ্গে ছবির শুটিং দেখতে গিয়েই জয়ললিতা চেন্নাইয়ের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের চোখে পড়ে যান। ১৯৬১ সালে ১৩ বছর বয়সে শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় তার। ১৯৬৫ সালে তামিল ছবি ‘ভেন্নিরা আদাই’-তে প্রথম নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করেন জয়ললিতা। একই বছরে তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও পরবর্তীকালে জয়ললিতার রাজনৈতিক গুরু এম জি রামচন্দ্রনের বিপরীতে প্রথম অভিনয় করেন। এরপর জয়ললিতা-রামচন্দ্রনের দু’যুগের রঙীন সম্পর্কের সূচনা হয়।

১৯৬১ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত সময়ে মোট ১৪০টি সিনেমায় অভিনয় করেছেন জয়ললিতা। তামিল সিনেমার অন্যতম কিংবদন্তি অভিনেত্রী ছিলেন তিনি। তামিল ছাড়াও তেলুগু কন্নড় সিনেমায় তিনি সমান দক্ষতায় কাজ করেছেন। এছাড়াও তিনি নৃত্যশিল্পী হিসাবেও অসম্ভব দক্ষ ছিলেন। জয়াকে তামিল সিনেমার ‘কুইন’ বলেও ডাকা হত।

১৯৮২ সালে অভিনেতা তথা তামিলনাড়ুর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এমজি রামচন্দ্রণের হাত ধরে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন জয়ললিতা। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন তিনি। ১৯৮৭ সালে রামচন্দ্রণ প্রয়াত হলে দলে বিভাজন তৈরি হয়। একদল ছিলেন এমজিআরের স্ত্রী জানকি রামচন্দ্রণের সঙ্গে আর একদল ছিলেন জয়ললিতার সঙ্গে। তবে অভিনেত্রী থেকে রাজনীতিক হওয়া ‘আম্মা’র দূরদর্শী নেতৃত্বেই তাকে আন্না দ্রাবিড় মুনিত্রা কাঝাগম -এআইএডিএম দলটির মূলধারা করে তোলে। এর দুই বছর পরই ১৯৯১ সালে বিপুল ভোটে জিতে প্রথমবার তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন জয়া। তিনিই তামিলনাড়ুর প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী৷ ধীরে ধীরে রাজ্য তথা ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে মহীরূহ হয়ে ওঠেন জয়া।

চিরকুমারী জয়ললিতা ১৯৯২ সালে পালিত পুত্র সুধাকরণের রাজকীয় বিয়েতে প্রচুর টাকা খরচ করে বিতর্কের মুখে পড়েন। কিছু আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে জড়িয়ে পড়েন তিনি। এই অভিযোগ মাথায় নিয়ে ১৯৯৬ সালে বিধানসভা নির্বাচন করে হেরে যান। ওইবছর ডিসেম্বরে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার হন। হিসাববহির্ভূত সম্পত্তির মামলায় দোষী সাব্যস্ত করে তাকে কারাগারে পাঠান আদালত। জয়ার ঠাই হয় কারাগারে। তবে উচ্চ আদালতে আপিল করে এক মাস পরেই তিনি মুক্তি পান। ২০০১ সালে দ্বিতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন ৷

২০০৭ সালের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ডিএম পার্টি জয়ী হলে বিরোধী দলনেতার পদে বসতে হয় তাকে। ২০১১ সালে তৃতীয়বারের মতো তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হল জয়ললিতা। ২০১৪ সালে ১৮ বছর আগের সেই আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি মামলা ফের আদালতে ওঠে। জয়ললিতাকে চার বছরের কারাদণ্ড এবং ১০০ কোটির জরিমানা করে আদালত। এক মাস জেলে কাটিয়ে জামিন পান তিনি। ২০১৫ সালে ভারতের সুপ্রিমে কোর্ট আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তি মামলায় জয়া নির্দোষ বলে রায় দেন। চলতি বছর মে মাসে বিধানসভা ভোটে জিতে চতুর্থবারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেনে জয়ললিতা।

জয়ললিতা নিজে চিরকুমারী জীবন বেছে নিলেও অন্যদের বিয়েতে মধ্যস্ততা করে আনন্দ পেতেন। সামর্থ্যের অভাবে বিয়ে করতে পারছেন না—এমন যুগলদের জন্য তিনি হয়ে ওঠেন আশীর্বাদ। ২০১১ সালে জুনে ১ হাজার ৬টি যুগলকে এক অনুষ্ঠানে বিয়ে দিয়ে বিশ্বজুড়ে শোরগোল তোলেন। জমকালো এই বিয়েতে রাজ্যের তহবিল থেকে খরচ হয় সাড়ে চার কোটি রুপি, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা। এতে আবারও মামলায় জড়িয়ে যান তিনি। এবার তার বিরুদ্ধে কোষাগারের অর্থ অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়। গত আগস্টেও তাকে এ মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনে আদালতেও যেতে হয়েছে।

সেপ্টেম্বর থেকেই শারীরিক অবস্থা ভালো যাচ্ছিল না ফুসফুসের সংক্রমণজনিত রোগে আক্রান্ত তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রীর। একাধিকবার তাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকে তত্বাবধানে থাকতে হয়েছে। গত রোববার হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে চেন্নাইয়ের অ্যাপোলো হাসপাতালে ভর্তি হন। সোমবার (৫ ডিসেম্বর) তার দেহে অস্ত্রোপচার হয়। এদিন বিকেল থেকেই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জয়ললিতার মৃত্যুর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। তবে হাসপাতালের পক্ষ থেকে তা অস্বীকার করে বলা হয়, তিনি লাইফসাপোর্টে আছেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতাল কতৃপক্ষ আম্মা মারা গেছেন বলে ঘোষণা দেয়।

ভারতীয় রাজনীতিতে প্রভাবশালী এ নেত্রীর মৃত্যুতে চেন্নাই শহর থমকে গেছে। জয়ললিতার মৃত্যুতে সমর্থকেরা কান্নায় মাতাম চলছে অলিতেগলিতে। ‘আম্মার’ মৃত্যুতে রাজ্যে সাত দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। দলের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে মঙ্গলবার রাজ্যের নতুন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেবেন।

রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিসহ ভারতের শীর্ষ রাজনীতিক ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা জয়ললিতার মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন