প্রকৌশলী থেকে জাতিসংঘের মহাসচিব

  13-01-2017 08:58AM



পিএনএস ডেস্ক: শুরুটা ছিল প্রকৌশল বিদ্যা দিয়ে। রাজনীতিতে আসেন ১৯৭৪ সালে। ‘কার্নেশন বিপ্লব’-এর পরই হয়ে ওঠেন পর্তুগালের প্রধানমন্ত্রী। এরপর জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন প্রধানের দায়িত্ব পান। সবশেষে জাতিসংঘের নবম মহাসচিব নিযুক্ত হন লিসবনে জন্ম নেওয়া পর্তুগিজ প্রকৌশলী ও রাজনীতিবিদ।

১৩ অক্টোবর ২০১৬। বহু জল্পনা-কল্পনার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের নবম মহাসচিব নিযুক্ত হন পর্তুগালের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্তোনিও গুতেরেস। এর আগে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশন প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। আন্তোনিও গুতেরেস ছিলেন পর্তুগালের ১১৪তম প্রধানমন্ত্রী।

সাবেক এই পর্তুগিজ প্রধানমন্ত্রীর পুরো নাম আন্তোনিও ম্যানুয়েল দ্য অলিভেইরা গুতেরেস। ৬৭ বছর বয়সী গুতেরেসের জন্ম ও শৈশব কাটে লিসবনে। জন্মসূত্রে তিনি পর্তুগিজ। বাবা ভার্জিলিও ডায়াস গুতেরেস ও মাতা ইলদা কান্ডিডা দে অলিভেইরা। মাতৃভাষা পর্তুগিজ ছাড়াও ইংরেজি, স্প্যানিশ এবং ফারসি ভাষায় পারদর্শী গুতেরেস পড়াশোনা করেন পর্তুগালের স্বনামধন্য লিসিও দে ক্যামোসে। সেখান থেকেই ১৯৬৫ সালে পড়াশোনা শেষ করেন। তিনি ছিলেন পর্তুগালের এক ময়কার প্রিমিও ন্যাশিওনাল দোস লিসেয়াস পুরস্কার অর্জনকারী। এটি দেশটির সেরা ছাত্রের পুরস্কার। ১৯৭১ সালে ইনস্টিটুটো সুপেরিয়র টেকনিকো থেকে পদার্থবিজ্ঞান ও ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর স্নাতক ডিগ্রিও লাভ করেন। এরপর সিস্টেমস থিওরি ও টেলিকমিউনিকেশন সিগন্যালে শিক্ষকতা শুরু করেন।

শুধু শিক্ষাজীবনেই নয়, ব্যক্তিগত জীবনেও গুতেরেস একজন প্রেমিক এবং স্বামী। বিয়ে করেন লুইসা অ্যামেলিয়া গুইমারায়েজ ই মেলোকে। লুইসার জন্ম ১৯৭২ সালে। তিনি গুতেরেসের প্রথম স্ত্রী। দুই সন্তান নিয়ে ছিল গুতেরেস-লুইসার সুখের সংসার। পেড্রো গুইমারায়েজ ই মেলো গুতেরেস ও মারিয়ানা গুইমারায়েজ ই মেলো দে অলিভেইরা গুতেরেসের দুই সন্তান। ১৯৯৮ সালে তার প্রথম স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এরপর ২০০১ সালে ক্যাটরিনা মার্কুয়েস দে আলমেইডা ভাজ পিন্টোকে বিয়ে করেন।

পেশায় প্রকৌশলী হলেও গুতেরেস রাজনীতিতে আসেন ১৯৭৪ সালে। পর্তুগালের সোশ্যালিস্ট পার্টিতে যোগদানের মধ্য দিয়ে গুতেরেসের রাজনৈতিক জীবনের সূত্রপাত। সে সময় পর্তুগালে একনায়কতন্ত্র চলছিল। একই বছরের ২৫ এপ্রিল পাঁচ দশক ধরে চলা স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে ‘কার্নেশন বিপ্লব’-এর মাধ্যমে। একই বছরে দেশটিতে স্বৈরশাসকের অবসান ঘটিয়ে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময় গুতেরেস হয়ে ওঠেন সোশ্যালিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ একজন। ১৯৭৪ ও ৭৫ সালে গুতেরেস শিল্প সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৭৬ থেকে ১৯৯৫ পর্যন্ত লিসবন ডেপুটি এবং পরবর্তীতে কাস্তেলো ব্রাঙ্কো পৌর এলাকার সংসদ সদস্য হন। ১৯৮৮ সালে সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রধান এবং ১৯৯২ সালে সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সহকারী সভাপতি হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৯৫ ও ১৯৯৯ সালে সোশ্যালিস্ট পার্টির হয়ে পরপর দুবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০০০ সালে গুতেরেস ইউরোপীয় কাউন্সিলের সভাপতিত্ব করেন। ২০০২ সালে সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির কাছে পরাজিত হয়ে রাজনীতি থেকে অবসর নেন। এরপর ২০০৫ সাল পর্যন্ত সোশ্যালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের সভাপতি ছিলেন গুতেরেস। রাজনীতি থেকে অবসর নেওয়ার পর ২০০৫ সালে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের প্রধান নির্বাচিত হন। এরপর এক দশক তিনি ব্যস্ত ছিলেন সিরিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাকের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোর শরণার্থী সংকট নিরসনে। যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থীদের আরও বেশি সহায়তা দিতে পশ্চিমা বিশ্বকে বার বার অনুরোধ করেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তার হাত ধরেই বিশ্বের সর্ববৃহৎ মানবাধিকার সংগঠন জাতিসংঘ এগিয়ে যায় অনেক দূর। তার মেয়াদকালে তিনি ১২৬ দেশে কর্মরত প্রায় ১০ হাজার কর্মীকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি প্রায় ৬০ মিলিয়ন শরণার্থী বাস্তুচ্যুত লোকের সহায়তায় এগিয়ে যান। গুতেরেসের হাত ধরেই ‘ইউএনএইচসিআর’ সারা বিশ্বে ব্যাপক সমাদৃত হয়।

বিবিসির এক সাক্ষাৎকারে গুতেরেস বলেন, ‘ইরাকি শরণার্থীদের দুর্দশা ১৯৪৮ সালের পর মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংকটের একটি। ’ যদিও পরবর্তীতে গুতেরেস সিরীয়, লেবানন ও জর্ডানের শরণার্থীদের জন্য কাজ করেন। তার লক্ষ্য, শরণার্থী শিবিরের বাস্তুচ্যুত লোকদের বাঁচার অধিকার। তিনি আরও বলেন, ‘জীবনের জন্য পালিয়ে বেড়ানো মানুষগুলোকে হতাশ হতে দিতে পারি না। ’ এ ছাড়াও টাইম ম্যাগাজিনের এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘তারা আসবে, তাদের আগমনে আমরা কতটা ভালো থাকতে পারি এবং এটা আদৌ কি মানবিক হবে!’

গত বছরের ১৩ অক্টোবর আরেক সাক্ষাৎকারে গুতেরেস বিবিসিকে জানান, ‘ইউএনএইচসিআর-এর কাজগুলো মহাসচিব হওয়ার আগের চমৎকার প্রস্তুতি ছিল। আমদের বিশ্বে যে বাস্তুচ্যুত শরণার্থীদের নিয়ে বসবাস করছি তারা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে এবং আপনি দেখবেন এর সমাধান করা বেশ কঠিন। ’ আন্তোনিও গুতেরেসের প্রশংসায় পর্তুগালের সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যানিবাল কাভাবো সিলভা বলেন, ‘গুতেরেস শরণার্থীবিষয়ক কমিশনে ‘কিংবদন্তিতুল্য’ কাজ করে চলেছেন। ’ গুতেরেস হাইকমিশনের ইতিহাসে প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মেয়াদকালের ব্যক্তি। জাতিসংঘের নবম মহাসচিব অনেক গুণে গুণান্বিত। নিজ ভাষাসহ আরও তিনটি ভাষায় বেশ পারদর্শী গুতেরেস। ব্যক্তিগত জীবনে গুতেরেস অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হন। ২০০২ সালে ৫৭টি পৃথক দেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে গড়া স্বাধীন অলাভজনক সংগঠন মাদ্রিদ ক্লাবের একজন সদস্য।

নতুন মহাসচিবকে গোটাবিশ্ব স্বাগত জানিয়েছে। সবার প্রত্যাশা আন্তোনিও গুতেরেস গোটাবিশ্বকে শান্তির পায়রায় রূপান্তর করবেন।

সাত দশকের পুরনো বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘের মহাসচিব পদে নিযুক্ত হওয়ার জন্য এবার বিভিন্ন দেশের ১৩ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এবার প্রার্থীদের মধ্যে সাতজনই ছিলেন নারী। ২০১৫ সালে প্রণীত একটি রেজুলেশন অনুযায়ী, সাত দশক ধরে চলা গোপন পদ্ধতি রদবদল করে এবারই প্রথমবারের মতো নির্বাচনের জন্য মুখোমুখি করা হয় প্রার্থীদের। এরপর জাতিসংঘের মহাসচিব নির্বাচনের লক্ষ্যে সংস্থাটির নিরাপত্তা পরিষদে অনুষ্ঠিত হয় ছয় ধাপে গোপন বা আনুষ্ঠানিক ভোট (ঝঃত্ধ িচড়ষষ)। ২১ জুলাই ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত হয় প্রথম ধাপের ভোট। এরপর বিভিন্ন তারিখে অনুষ্ঠিত হয় আরও চারটি ভোট। প্রতিটি ধাপের ভোটেই সবচেয়ে বেশি হ্যাঁ সূচক ভোট পেয়ে শীর্ষে ছিলেন আন্তোনিও গুতেরেস। ৫ অক্টোবর ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ এবং সর্বশেষ ধাপের ভোটে নিরাপত্তা পরিষদের ১৩ সদস্য রাষ্ট্র তার নাম অনুমোদন করেন। এরপর ১৩ অক্টোবর ২০১৬ তা সর্বসম্মতভাবে অনুমোদন পায়। ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে নবম মহাসচিব হিসেবে শপথ নেন পর্তুগিজ এই প্রকৌশলী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী। ১ জানুয়ারি ২০১৭ সালে তিনি জাতিসংঘের নবম মহাসচিব হিসেবে অফিস শুরু করেন।

এক নজরে
আন্তোনিও ম্যানুয়েল দ্য অলিভেইরা গুতেরেস

জন্ম— ৩০ এপ্রিল ১৯৪৯ লিসবন, পর্তুগাল

রাজনৈতিক দল— সোশ্যালিস্ট পার্টি

ধর্ম— রোমান ক্যাথলিক

নবম মহাসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ— ১ জানুয়ারি ২০১৭

দশম জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার— ১৫ জুন ২০০৫ থেকে ৩১ ডিসেম্বর ২০১৫

১১৪তম প্রধানমন্ত্রী— ২৮ অক্টোবর ১৯৯৫ থেকে ৬ এপ্রিল ২০০২

সোশ্যালিস্ট পার্টির মহাসচিব— ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ থেকে ২০ জানুয়ারি ২০০২

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন