কেমন মানুষ ছিলেন কিম জং-ন্যাম?

  21-02-2017 02:50PM


পিএনএস ডেস্ক: জীবনের শেষ কয়েক বছরে ভীষণ প্যারানয়ায় ভুগছিলেন উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং-উনের সৎ ভাই কিম জং-ন্যাম। সম্প্রতি তাকে মালয়েশিয়ার একটি বিমানবন্দরে হত্যা করা হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা বৃটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে জানান, এ ক’টি বছর তিনি শাসকগোষ্ঠীর কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রেখে চলছিলেন। নিজের দেশের দুরাবস্থার কথা ভেবে নিজের অসহায়ত্বও প্রকাশ করতেন তিনি।

গার্ডিয়ানকে দেওয়া একটি এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকারে কিম জং-ন্যামের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহচর তার মুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি ও ব্যাক্তিত্ব নিয়ে কথা বলেন। তার ধারণা, এই মুক্তচিন্তার কারণেই তিনি উত্তর কোরিয়া থেকে নির্বাসিত হন। অথচ, একসময় তিনিই ছিলেন সিংহাসনের উত্তরাধিকারী। শেষ পর্যন্ত মারাই গেলেন তিনি।

গত বছর জেনেভাই বেশ কয়েকবার সফর করেছেন জং-ন্যাম। সর্বশেষ গেছেন কয়েক মাস আগে। সেখানে অ্যান্থনি সাহাকিয়ান নামে নিজের কিশোর বয়সের বন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি। তারা ছোটবেলায় জেনেভায় খুবই নামিদামি একটি আন্তর্জাতিক স্কুলে পড়ালেখা করেছেন। কিম যখন জেনেভায় অবস্থান করছিলেন তখন সাহাকিয়ান প্রায় প্রতিদিন তার সঙ্গে দেখা করতেন। সাহাকিয়ানের কাছে তার পরিচয় ছিল ‘লি’। জং-ন্যামের কাছে এমন সব তথ্য ছিল যা তার শাসক ছোট ভাই কিম জং-উন হয়তো নিজের শাসনের প্রতি হুমকি ভেবেছিলেন। সাহাকিয়ান বলেন, ‘আমরা আসলে ওই শাসনের বিষয়েও কথা বলেছিলাম। তার ছোট সৎ ভাই সহ অন্যান্য ব্যাপারেও। আমি একটা বিষয় বলতে পারি, সে কখনই ক্ষমতা নিয়ে আগ্রহী ছিল না। সে সবসময়ই এ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইতো। দেশ শাসনের কোন উচ্চাকাঙ্খা তার ছিল না। এটা ঠিক উত্তর কোরিয়ায় যা চলছিল তা তিনি মেনে নেননি বা গ্রহণ করেননি। আর শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে তিনি অত ঘনিষ্ঠও ছিলেন না।’

মালয়েশিয়ার কর্তৃপক্ষ জানায়, কিম জং-ন্যাম যখন ম্যাকাও যেতে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে অবস্থান করছিলেন, তখনই দুই নারী তাকে বিষপ্রয়োগ করেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই দুই নারীকে নিয়োগ দিয়েছে উত্তর কোরিয়া। পরে হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।

সাহাকিয়ান আরও বলেন, ‘সে খুব ভীত ছিল। সে ছিল প্যারানয়েড। রাজনৈতিকভাবে সে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি। তাই দুশ্চিন্তায় ভুগছিল। সে নিশ্চিত দুশ্চিন্তায় ভুগছিল।’ তার পিতা ও সাবেক শাসক কিম জং-ইল মারা যাওয়ার আগেই তাকে উত্তরাধিকার হওয়া থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়। তবে এর কারণ জানা যায়নি। তার খালা উত্তর কোরিয়ার পক্ষত্যাগ করে অন্যত্র চলে যান। পরে নিজের এক আত্মজীবনীতে তিনি লিখেন, নিজের এই প্রথম সন্তান নিয়ে কিম জং-ইল খুবই অনুরক্ত ছিলেন। তাকে খুবই ভালোবাসতেন। আগলে রাখতেন। কিন্তু কিম জং-ন্যামের দাদা ও উত্তর কোরিয়ার আধুনিক জনক ‘গ্রেট লিডার’ কিম ইল-সাং তার পিতা-মাতার বিবাহবহির্ভূত স¤পর্ক মানেননি। জং-ন্যামের মা ছিলেন স্থানীয় একজন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী।

ছোটবেলায় কিম জং-ন্যাম দেশ ছাড়েন। প্রথমে রাশিয়া পরে সুইজারল্যান্ড। সুইজ্যারল্যান্ডে তিনি ফ্রেঞ্চ, রাশিয়ান, জার্মান ও ইংরেজি শেখেন। এ সময়ই সাহাকিয়ানের সঙ্গে তার দেখা। তাদের বয়স ছিল ১২-১৩। জং-ন্যামের পরিচয় দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রদূতের ছেলে হিসেবে। কিন্তু তার আসল পিতাকে তখন দেশের ভবিষ্যৎ নেতা হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছিল। সাহাকিয়ান বলেন, ‘ওই সময় আমরা জানতামই না যে, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে পার্থক্য কী। সে খুবই মজার শিশু ছিল, খুবই বন্ধুপরায়ন, খুবই দয়াদ্র আর দারুণ, আর অকৃপণ। সে সময় জীবনটাকে খুব পছন্দ করতো সে। একেবারে দুষ্টু ছিল। আমরাও কিছুটা ছিলাম। কিন্তু সাধারণ কিছু নয়।’

এক সময় দেশে ফিরলেন কিম জং-ন্যাম। তার খালার আত্মজীবনীতে বলা হয়, ইউরোপে বড় হয়ে নিজ দেশে ফেরত গিয়ে তিনি বেশ হতোদ্যম হয়ে পড়লেন। কারণ, উত্তর কোরিয়াকে তখন সবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন। ২০০১ সালে ডমিনিক্যান রিপাবলিকের ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করে জাপানে ঢোকার চেষ্টা করেন তিনি। আর ধরা পড়েন! এ বিষয়টি জানাজানি হলে উত্তর কোরিয়ার শাসকগোষ্ঠী বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে। আর তখনই পিতার সুনজর থেকে আরওপ ছিটকে পড়েন তিনি। এর পর থেকে তিনি ম্যাকাউয়ে নির্বাসনে ছিলেন। সেখানে তিনি ও তার স্ত্রীর ছেলেমেয়ে ছিল। পরে সিংগাপুরেও ছিলেন। আরেক বন্ধু জানান, বেইজিং-এও একটি বাড়ি ছিল তার।

মাঝেমাঝেই জিন্স ও টি-শার্ট পরা জং-ন্যামকে দেখা যেত বিমানবন্দরে। প্যারিস কিংবা ইন্দোনেশিয়ার কোন রেস্তোরাঁয়। সাংবাদিকদের দিকে খুব ভদ্রভাবে হাসতেন কিম। তবে একবার সাংবাদিকদের ¯পষ্ট করে জানিয়ে দেন, তিনি পক্ষত্যাগ করেননি। ধরে নেওয়া হতো তিনি নির্বাসনে আছেন। হয় তাকে জোর করে নির্বাসনে পাঠানো হয়েছে, অথবা নিজ থেকে।

২০১১ সালে তার শাসক পিতার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। তখন হয়তো সংস্কারের সুযোগ দেখতে পেয়ে নিজের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জাপানের সাংবাদিক ইয়োজি গোমির সঙ্গে কথা বলেন তিনি। কিন্তু এর কয়েক মাস পরই ছোটভাই কিম জং-উন ক্ষমতায় আসেন। এর পরে ২০১২ সালে যখন গোমি বইটি প্রকাশ করেন, তখন জং-ন্যাম নিশ্চুপ হয়ে যান। ওই বইয়ে উত্তর কোরিয়ার বংশ-ভিত্তিক শাসনব্যবস্থার সমালোচনা ছিল। ধারণা করা হয়, তখন শাসন ভাইয়ের রোষানল থেকে বাঁচতেই তিনি চুপ ছিলেন। এক বছর পর কিম জং-ন্যামের ঘনিষ্ঠ ও একসময় উত্তর কোরিয়ার দ্বিতীয় ক্ষমতাধর লোক হিসেবে পরিচিত তাদের দু’ জনেরই চাচাকে কিম জং-উন হত্যা করেন। অভিযোগ ছিল, ‘নোংরা রাজনৈতিক উচ্চাবিলাস’ ছিল তার। এরপর থেকে খুবই গোপনে চলাফেরা করতেন জং-ন্যাম। সাহাকিয়ান বলেন, ‘দেশের পরিস্থিতি নিয়ে ন্যাম খুবই ব্যাথাতুর ছিলেন। তিনি নিজের জনগণের কথা চিন্তা করতেন। আর এটা তার ওপর চাপ বাড়িয়ে দেয়, কারণ তিনি এ নিয়ে কিছুই করতে পারতেন না।’

এই ঘনিষ্ঠ বন্ধু আরও বলেন, কিম জং-ন্যাম চিন্তাশীল ছিলেন। দেশে সংস্কার চাইতেন। তবে অসহায়ত্ব বোধ করতেন। যদিও সাবেক শাসকের বড় ছেলে হিসেবে দেশে তার জন্য বড় পদ এমনিতেই নির্ধারিত, তবুও উত্তর কোরিয়ার ভয়াবহ রাজনীতিতে প্রবেশ করার চরিত্র বা ইচ্ছা তার ছিল না। তার ভাষ্য, ‘এসব করতে হলে আপনার শিরায় বরফ থাকতে হবে। এই পরিস্থিতি পাল্টাতে হলে রক্তগঙ্গা বইয়ে দিতে হবে। কিন্তু আমি মনে করি না, জং-ন্যাম তা চাইতো।’ তিনি জোর দিয়ে বলেন, সহজে বলতে গেলে কিম কোন দানব ছিল না। আবার তা-ই বলে, তিনি কোন বিলাসবহুল বিমানে চড়া, ক্যাসিনো-আসক্ত, নারীপ্রিয় প্লেবয়ও ছিলেন না। অথচ, মিডিয়া তাকে প্রায়ই এভাবে চিত্রিত করে।

গার্ডিয়ানকে ওই সাক্ষাৎকার দিতে রাজি হওয়ার অন্যতম কারণ হিসেবে সাহাকাইন বলেন, তিনি চান তার বন্ধুকে ‘ভদ্র মানব’ হিসেবে চিত্রিত করতে। তার মতে, ‘সে হয়তো জুয়া খেলেছে। সে হয়তো মাতাল অবস্থায় ধরা পড়েছে। নারীও হয়তো পছন্দ করতো। কিন্তু তাতে সমস্যাটা কী?’ জং-ন্যাম তাকে বলেছেন, তিনি উত্তর কোরিয়ার শাসকগোষ্ঠীর টাকা ছোঁবেন না। ইউরোপে তাদের বেশ কয়েকটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন তিনি। যখন জেনেভায় গেছেন তিনি, তখন স্বল্পমূল্যের এয়ারবিএনবি ব্যবহার করেছেন।

কিন্তু সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করাটা ছিল কঠিন। ‘এর কী বড় ধরণের মানসিক চাপ কারও ওপর পড়ে, তা আপনাকে কল্পনা করতে হবে। কারণ, এক একনায়কের ছেলে হিসেবে আপনার গুণ কী? আপনি কী করেন? আপনি গোল্ডম্যান স্যাখসের জন্য কাজ করবেন? কোনকিছুই তার জন্য সহজ ছিল না।’ আবার বিশ্বের সবচেয়ে বিচ্ছিন্নি দেশটির শাসক পরিবারের সদস্য হওয়ায় বিদেশে যেতে হলে প্রায়ই ওই দেশের সরকারকে জানাতে হতো তাকে। সাহাকিয়ান বলেন, ‘আমাকে সে বলেছিল যে, ভ্রমণের আগে লোকজনের সঙ্গে কথা বলে নিতে হয় তাকে। কোন ধরণের কারণ দর্শানো ছাড়া তাকে মুক্তভাবে চলতে দেওয়া হতো না তাকে, আমি কল্পনা করতে পারি।’ এর একটি কারণ হতে পারে যে, তার আন্তর্জাতিক লাইফস্টাইল ও বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যোগসূত্রকে হয়তো পিয়ংইয়ং হুমকি মনে করেছিল।
কিম জং-ন্যামের মৃত্যুর পর, সাহাকাইন অনেকগুলো কারণ চিন্তা করেন। তবে একটিতে গিয়ে তার চিন্তা থমকে যায়। তার মতে, কোন এক কিম জং-উনকে ঘিরে রাখা জেনারেলদের কেউ একজন হয়তো তার প্রিয়পাত্র হওয়ার চেষ্টা করেছে। সুপ্রিম লিডারকে দিতে চেয়েছে এক চমকপ্রদ উপহার। সাহাকাইন বলেন, ‘সেখানে যে প্যারানয়া, তাতে রাজাকে খুশী করতে হয়তো কেউ একটু বেশিই চলে গিয়েছে। কিন্তু এ কাজ করতে হলে, আপনাকে অবশ্যই তার ভাইয়ের অনুমতি নিতে হবে।’

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন