মায়ানমারে কথিত ‘মুসলিম বিদ্রোহীদের’ বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু

  17-08-2017 03:04PM


পিএনএস ডেস্ক: মায়ানমারে কথিত মুসলিম বিদ্রোহীদের নির্মূল করার ‘শুদ্ধি অভিযানের’ প্রস্তুতি হিসেবে দেশটির উত্তেজনাপ্রবণ পশ্চিম রাখাইন রাজ্যে বিমান থেকে শত শত সেনা নামিয়েছে সামরিক বাহিনী।

গত বৃহস্পতিবার ৩৩তম লাইট ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের মোতায়েন শুরু হয়। খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেও হেলিকপ্টারে করে এসব সেনাকে রাজ্যের রাজধানী সিত্তইতে নামানো হয়। পর দিন তাদেরকে মাংডুতে মোতায়েন করা হয়। এরপর থেকে তারা ওই এলাকায় নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে বলে স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে।

মায়ানমার সেনাবাহিনী বা তাতমাদাও মৌখিকভাবে উত্তর রাখাইনের গ্রামবাসীদেরকে উত্তরের ম্যায়ু পার্বত্য এলাকায় প্রবেশ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছে। কারণ তারা ওই অঞ্চলে শুদ্ধি অভিযান চালাতে যাচ্ছে। সামরিক বাহিনী মনে করছে, এখানেই ‘সন্ত্রাসীরা’ লুকিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। কয়েক মাস ধরে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী এই এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে। তারা সন্দেহভাজন মুসলিম জঙ্গিদের খুঁজছে বলে সামরিক সূত্র জানিয়েছে। বর্তমানে এসব অভিযানে নতুন করে ৫০০-এর বেশি সেনা যোগ দিয়েছে।

সপ্তাহান্তে ওই টাউনশিপে কারফিউয়ের মেয়াদ বাড়িয়েছে। একইসাথে রাজ্যের মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, সামরিক বাহিনীর ‘শুদ্ধি অভিযান’ জোরদার করায় সরকার প্রয়োজনে নতুন নতুন এলাকায় কারফিউ জারি করবে।

মায়ানমার সরকার যখন রাখাইনে দেশটির সামরিক বাহিনীর অভিযানকালে পরিকল্পিত ধর্ষণ, খুন ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ তদন্তের জন্য আন্তর্জাতিক চাপের মুখে রয়েছে, তখনই এই সামরিক অভিযান শুরু হলো। গত বছর নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর সামরিক বাহিনী ওই অভিযান চালিয়েছিল।

ওই সময় ৭০ হাজারের বেশি মুসলিম গ্রামবাসী সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে পালিয়েছিল। তারপর থেকেই ওই অঞ্চলে থেমে থেমে সহিংসতা চলছে। সরকারের দালাল সন্দেহে গ্রামে ডজন খানেক খুন এবং অপহরণের জন্য বিদ্রোহীদের দায়ী করছে সরকার।

সপ্তাহ খানেক আগে সহিংসতা আরেক দফা বাড়ে। এসময় মাংডুতে ম্রু জাতিগোষ্ঠীর ছয় সদস্যকে হত্যা করা হয়। এরপর ভয়াবহ আতঙ্কের মধ্যে শত শত গ্রামবাসী পালিয়ে যায়। গত কয়েক মাস ধরে মায়ু পার্বত্য এলাকা হয়ে পড়েছে তাতমাদাওয়ের অভিযানের কেন্দ্রবিন্দু। জুনে দুই দিনের অভিযানে নিরাপত্তা বাহিনী তিন সন্দেহভাজন জঙ্গিকে হত্যা করে।

এশিয়ান গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে, ওই এলাকায় বিদেশী তহবিলপুষ্ট প্রশিক্ষণে প্রায় ৩০০ মুসলিম রোহিঙ্গা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ব্যবহার করে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে।

আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামে পরিচিত বিদ্রোহীরা গত অক্টোবরে পুলিশ চৌকিতে হামলার আগে পর্যন্ত তেমন পরিচিত ছিল না। গ্রুপটি জানিয়েছে, তারা রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য লড়াই করছে। তবে তারা অসত্যায়িত টুইটার অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বেসামরিক লোকজনকে হত্যার দায়িত্ব অস্বীকার করেছে।

আঞ্চলিক গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের কাছে প্রচুর পরিমাণে অর্থ ও অস্ত্র পাচার হচ্ছে। এর বেশির ভাগই হচ্ছে মায়ানমারের সাথে থাকা থাই সীমান্ত দিয়ে। এসব অস্ত্র কি কয়েক দশক আগে কম্বোডিয়ার সঙ্ঘাতে ব্যবহৃত হয়েছিল কিনা তা নিশ্চিত করা যায়নি। তবে এটা তুলনামূলকভাবে নতুন বৈশিষ্ট্য বলে গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে।

অক্টোবরের হামলার আগে মায়ানমার গোয়েন্দা সূত্রগুলো মনে করতো, অন্তত ২০০ রোহিঙ্গা পালিয়ে ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তারা মূলত সৌদিদের কাছ থেকে সহায়তা পাচ্ছে বলে ধারণা করা হতো।

অবশ্য গোয়েন্দা তথ্যগুলোর সত্যতা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই। তবে ধোঁয়া যেহেতু আছে, তাই আগুন থাকতেই পারে। অন্তত মায়ানমার সামরিক বাহিনী জোরালোভাবে ধারণা করছে, ওই পার্বত্য এলাকায় বিদ্রোহীরা শক্তি বাড়াচ্ছে। তারা এখন তাদের পুরোপুরি বিধ্বস্ত করতে চায়।

সামরিক কমান্ডার অন্তত এবারের মতো হলেও নিশ্চিত করেছে, স্থানীয় অধিবাসীরাও অভিযানের জন্য অনুরোধ করেছে। বিমানযোগে সেনা নামানোর এক দিন আগে সেনাপ্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন আঙ হলাইঙ নেপাইথোতে আরাকান ন্যাশনাল পার্টির (এএনপি) শীর্ষ রাজনীতিবিদদের সাথে সাক্ষাত করে আশ্বাস দেন, সেনাবাহিনী অলস বসে থাকবে না। তারা সহিংসতাকে চ্যালেঞ্জহীন থাকতে দেবে না। আরাকান রাজনীতিবিদেরা নিরাপত্তা জোরদার এবং আরো সেনা মোতায়েনের অনুরোধ করেন।

সেনাপ্রধানের সাথে সাক্ষাতকারী এএনপি সদস্য ওও হলা সু এমপি বলেন, সেনাপ্রধান বলেছেন, তিনি রাখাইন রাজ্যের জাতিগত গ্রুপগুলোকে পুরোপুরি রক্ষা করবেন এবং অবৈধভাবে অনুপ্রবেশ করা লোকদের পুরোপুরি নির্মূল করে মায়ু পর্বতকে জঙ্গিদের ব্যবহৃত হতে দেবেন না।

আরাকানের রাজনীতিবিদদের সাথে সাক্ষাত করেছিল উচ্চপর্যায়ের সামরিক প্রতিনিধিদল। এতে সেনাপ্রধান ছাড়াও ডেপুটি কমান্ডার-ইন-চিফ অব ডিফেন্স সার্ভিসেস এবং আর্মি কমান্ডার-ইন-চিফ ভাইস-সিনিয়র-জেনারেল সো উইন, চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সেনা, নৌ ও বিমান) জেনারেল মিয়াত তুন ওও উপস্থিত ছিলেন।

সেনাপ্রধান যখন রাখাইনে শক্তি বাড়াচ্ছিলেন, তখন দেশটির বেসামরিক নেত্রী আঙ সান সু চি রাখাইনের পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য সম্প্রতি গঠিত রাখাইন সিকিউরিটি কমিটির এক সভার আয়োজন করেন। বৈঠকে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন মন্ত্রীও উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রীদের মধ্যে সেনাবাহিনী, সীমান্ত রক্ষা, প্রতিরক্ষা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও আছেন। এছাড়া আছেন আঞ্চলিক কয়েকজন মন্ত্রী এবং স্টেট কাউন্সিলরের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তাঙ তুন। তাদের সভার পর ফেসবুকে যে বিবৃতি দেয়া হয়েছে, তাতে সামরিক অভিযানের কথা উল্লেখ করা হয়নি।

ধারণা করা হচ্ছে, সু চির সাথে আলোচনা ছাড়াই সেনাপ্রধান নিজ দায়িত্বে রাখাইন বিদ্রোহী এবং রাখাইনের কথিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে এই গুরুত্বপূর্ণ সার্জিক্যাল অপারেশনের নির্দেশ দিয়েছেন। মিন আঙ হলাইনের সাথে ঘনিষ্ঠ সূত্রের মতে, এটা সেনাপ্রধানের সাংবিধানিক বিশেষ ক্ষমতা। কারণ এটাকে মনে করা হচ্ছে সামরিক বিষয়, ফলে বেসামরিক অনুমোদনের প্রয়োজন নেই।

সাবেক এক সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা জানান, এনএলডি সরকার ক্ষমতা গ্রহণের প্রথম দিকেই আঙ সান সু চি এবং মিন আঙ হলাইঙের মধ্যে স্পষ্ট সমঝোতা হয় যে তারা দুজন একসাথে কাজ করবেন। তবে সেনাপ্রধান দেখবেন নিরাপত্তা বিষয়াদি আর বাকি সব কিছু থাকবে সু চির তদারকিতে।

উভয়েই বুঝতে পেরেছেন, রাখাইন ইস্যুটি পুরোপুরি অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়, এর সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গভীরভাবে জড়িত। কিন্তু সমস্যা হলো, দেশটির সত্যিকারের দুই নেতার মধ্যে আনুষ্ঠানিক আলোচনার কোনো সরাসরি চ্যানেল নেই। যে চ্যানেলটি আছে সেটি হলো ন্যাশনাল ডিফেন্স অ্যান্ড সিকিউরিটি কাউন্সিল। এখানে তারা বসে বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করেন। এই পরিষদের সভা ইতোপূর্বে ছয় বার হয়েছে। তাতে তারা রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাও করেছেন। তবে দুজনের মধ্যে অপারেশন নিয়ে সরাসরি আলোচনার কোনো চ্যানেল না থাকলে এ নিয়ে দু’জনের মধ্যে স্পষ্ট সমঝোতা রয়েছে বলে ওই সিনিয়র অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মন্তব্য করেন।

তবে সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ সূত্র জানিয়েছে, মধ্যবর্তী পর্যায়ে থাকা সামরিক সূত্রগুলো সু চিকে অভিযানটি সম্পর্কে ধারণা দিয়েছেন। বিশেষ করে ভাইস প্রেসিডেন্ট মিয়ান্ত সোই এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে তিনি তথ্য পেয়েছেন। তবে এর মানে এই নয়, তিনি পরিস্থিতি সম্পর্কে খুশি। রোহিঙ্গা গ্রামবাসীদের মতো তিনিও রাখাইনে সামরিক বাহিনীর বারংবারের মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে উদ্বিগ্ন।

তিনি জাতিসঙ্ঘ স্পেশাল রেপোর্টিয়ার ইয়াঙকি লির প্রতিবেদন নিয়েও উদ্বিগ্ন। লি ইতোপূর্বে রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে তার প্রতিবেদনে বলেছিলেন, মুসলিম রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে জাতি নির্মূল অভিযান চালানো হয়ে থাকতে পারে। শুক্রবার তিনি রাখাইনে সামরিক অভিযান চালানো নিয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন। তবে বেশির ভাগ অ্যাক্টিভিস্ট এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা আরো দৃঢ় হওয়ার জন্য আঙ সান সু চির প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।

পিএনএস/আনোয়ার


@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন