পিএনএস ডেস্ক: ভারতে আকছারই ঘটছে কন্যাসন্তানের জন্মদানে বধূ নির্যাতন। এ নিয়ে আন্দোলন হয়নি, রাজনৈতিক দলগুলি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কুশ্রী মানসিকতা বদলাতে আসেনি এগিয়ে। মোদীর ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও' স্রেফ একটা শব্দবন্ধ হয়ে রয়ে গেছে।
পুত্রসন্তান ভূমিষ্ট হলে পরিবারে আকাশছোঁয়া আনন্দ। কন্যাসন্তান হলে সবার মুখ ব্যাজার। মেয়ে মানেই সংসারে বোঝা। আর ছেলে বংশরক্ষা করবে, রোজগার করবে, পরিবারে সবার অন্ন জোগাবে আর বৃদ্ধ বয়সে পরিবারের দায়দায়িত্ব সামলাবে। এই বস্তাপচা মানসিকতা সমাজে আজও বদ্ধমূল।
সেকালের কথা আলাদা। মেয়েদের শিক্ষার ছিল নগণ্য। কিন্তু এখন? সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ কি পালটায়নি? কেন পালটায়নি? শিক্ষা-দীক্ষা আর মেধায় মেয়েরা আজ কত এগিয়ে গেছে। রোজগার করছে, ঘরে-বাইরে জীবনের প্রতিটি স্তরে তাঁদের প্রতিভার স্বাক্ষর জ্বলজ্বল করছে। তবু জোর গলায় বলা যাচ্ছে না – হ্যাঁ, পালটেছে বৈকি। রুঢ় বাস্তব বলছে সামাজিক কাঠামোটা মোটামুটি একই রয়ে গেছে। হয়ত স্থানকাল ও পাত্রবিশেষে উনিশ-বিশ হতে পারে।
এই লিঙ্গ বৈষম্য শুরু হয়ে যায় কন্যাসন্তানের জন্মলগ্ন থেকেই। খাওয়া-পরা, পুষ্টি, যত্ন-পরিচর্যা – সবদিক থেকেই কন্যাসন্তান যেন অবহেলার পাত্রী। এরই চরম পরিণতি কন্যাভ্রুণ হত্যা অথবা কন্যা ভূমিষ্ট হবার পর তাকে পরিত্যাগ করা। আল্ট্রাসাউন্ড করে গর্ভস্থ শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ সরকারিভাবে নিষিদ্ধ হলেও, একটা পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে যে, ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে বছরে চার হাজারেরও বেশি কন্যাভ্রুণ হত্যা করা হচ্ছে।
এখনও প্রত্যন্ত গ্রামে সন্তান ভূমিষ্ট হয় ঘরেই। তাই তাদের রেকর্ড অজানাই থেকে যায়। শুধু তামিলনাড়ুতেই নয়, ভারতের অন্যান্য রাজ্যেও ছবিটা মোটামুটি একরকম। আকছারই ঘটছে কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ায় বধূ নির্যাতন।
চারপাশে নজর দিলেই উঠে আসে কত ঘটনা।
এই তো কিছুদিন আগে পশ্চিমবঙ্গের এক গ্রামে রুবিনা বিবিকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলে তার শ্বশুরবাডির লোকেরা। কেন? কারণ আল্ট্রাসাউন্ড করে তাঁর স্বামী জানতে পেরেছিলেন রুবিনার গর্ভে কন্যাসন্তান আছে। স্ত্রীকে গর্ভপাত করাতে বলে কাজ হয় না। স্ত্রী রাজি না হলে স্বামী তার বাপের বাড়ি থেকে একলক্ষ টাকা আনতে বলেন। সেটাও সম্ভব না হওয়ায়, স্ত্রীর গলায় জোর করে তরল বিষ ঢেলে দেন স্বামী। পশুরাও বুঝি লজ্জা পাবে এই আচরণে। আরো আছে। পর পর তিনবার কন্যা সন্তানের জন্ম দেওয়ায় স্ত্রীকে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়, হচ্ছে।
যেন কন্যাসন্তানের জন্য বৌ একাই দায়ী। বারবার মেয়ে হওয়ায় শেষে নবজাত কন্যাকে কাঁথায় মুড়ে ঝোপের মধ্যে ফেলে আসে হতভাগ্য নবজাতকের পরিবার। শিয়াল-কুকুর খাবার আগেই ভাগ্যক্রমে কোনো পথচারী শিশুটিকে উদ্ধার করে হোমে দিয়ে আসে। এর থেকেও বিভত্স ঘটনা রয়েছে।
যেমন নবজাত কন্যাসন্তানকে জ্যান্ত কবর দিয়ে আসে বাড়ির লোকজন। শিশুর কান্না এবং নড়াচড়া কারোর চোখে পড়ায় সে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আল্ট্রাসাউন্ড আসার পর কন্যাভ্রুণ হত্যার হার যেন বেড়ে গেছে। দিল্লিতে প্রতি হাজার ছেলের তুলনায় মেয়ের আনুপাতিক হার ৯৭৯, মহারাষ্ট্রে ৮৯৪, পাঞ্জাবে ৮৪৬ আর গুজরাটে ৮৯০।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের অধ্যাপক বুদ্ধদেব ঘোষ এর পেছনে আর্থিক কারণটাকে প্রধান বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, দেশের যে দু'টি রাজ্য আর্থিক দিক থেকে এগিয়ে সেই পাঞ্জাব এবং হরিয়ানা রাজ্যে লিঙ্গ ব্যবধান, যাকে বলে সেক্স রেশিও, তার তারতম্য সবথেকে বেশি। কারণ কন্যাভ্রুণ হত্যা সেখানে বেশি হয়। মূলত এটা একটা সাংস্কৃতিক ইস্যু। এ নিয়ে যে সামাজিক আন্দোলন হয়নি বা হচ্ছে না, তা নয়। রামমোহন রায়ের সতীদাহ প্রথা নিবারণ থেকে যা শুরু হয়, তা এখনো চলছে অন্যভাবে।
তবে একথা ঠিক যে, ভারতের রাজনীতিতে এই ইস্যুটি নেই। সংসদে মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষণ বিলটি দীর্ঘদিন ধরে আটকে আছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে। প্রধানমন্ত্রী মোদী অবশ্য এ বিষয়ে কিছুটা উদ্যোগ নিলেও, অন্যান্য নেতারা অনাগ্রহী। আরজেডি নেতা লালু প্রসাদ তো সামনাসামনি বলেছেন, মহিলারা আবার রাজনীতিতে কেন? সমাজবাদী পার্টির মুলায়েম সিং যাদবেরও একই মত। অন্য সব রাজনৈতিক দলগুলি মুখে কিছু না বললেও মনে মনে তারাও চায় না যে সংসদে মহিলাদের জন্য রিজার্ভেশন থাক।
এই প্রসঙ্গের রেশ টেনে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সের আপর এক অধ্যাপক দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা শুধু ভারতেই নয়, গোটা দুনিয়াতেই আছে। তবে ভারতে কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্যের একটা বড় কারণ সম্ভবত পণপ্রথা। শহরে পণপ্রথার প্রকৃতি কিছুটা বদলালেও সর্বত্র সেটা দেখা যায় না। পণপ্রথা বেআইনি হলেও তা কার্যকর করতে সরকার গা করে না। চরম নির্যাতন বা বধূ হত্যা বা আত্মহত্যা পর্যন্ত না গড়ালে পুলিশ প্রশাসন নীরব দর্শকই থাকে। অথচ এতবড় একটা সামাজিক ব্যাধি নিয়ে বড় কোনো আন্দোলন তৈরি হচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলি এই ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না, পাছে ভোটব্যাংকে টান পড়ে।
প্রধানমন্ত্রী মোদী নারী স্বশক্তিকরণের লক্ষ্যে ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও' নামে একটা প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। কিন্তু সেটা কত দূর সফল হয়েছে তা বলার সময় এখনও আসেনি। কন্যাসন্তান বোঝা – একমাত্র এই মানসিকতা সমাজের তৃণমূল স্তর থেকে মুছে ফেলতে পারলেই প্রধানমন্ত্রীর এই প্রকল্প সাফল্যের মুখ দেখতে পারবে।
সূত্র: ডয়চে ভেলে
পিএনএস/হাফিজুল ইসলাম
ভারতে কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ায় বধূ নির্যাতন
16-09-2017 07:28AM