দক্ষিণ এশিয়া নিরাপত্তা ঝুঁকিতে

  16-09-2017 09:00AM


পিএনএস ডেস্ক: মিয়ানমারে চলা সামপ্রতিক সহিংসতা থেকে বাঁচতে প্রায় ৪ লাখ মুসলিম রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। এই সহিংসতা অঞ্চলজুড়ে সামপ্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি করার হুমকিও দিচ্ছে। রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের প্রস্থান উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও বাংলাদেশে ভারতের মতো দেশগুলোর রাজনীতিকরা রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নিয়ে জনগণের ক্ষোভকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারেন। সামপ্রতিক দিনগুলোতে উল্লিখিত দেশগুলোর কোনো কোনোটিতে রোহিঙ্গাদের সমর্থনে সমাবেশও করা হয়েছে। জঙ্গি গোষ্ঠী আল কায়েদা
মুসলিমদের, বিশেষ করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ফিলিপাইনের মুসলিমদেরকে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের অর্থনৈতিক, সামরিক ও শারীরিকভাবে সাহায্য করার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। তারা মিয়ানমার সরকারকে হুমকি দিয়ে বলেছে, মিয়ানমার তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি ভোগ করবে। বুধবার পর্যবেক্ষ সংস্থা সাইট ইন্টিলিজেন্সের এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত বিবৃতিতে জঙ্গি গোষ্ঠীটি বলেছে, আমাদের মুসলিম ভাইদের প্রতি যে বর্বর আচরণ করা হয়েছে তার শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে। আমাদের মুসলিম ভাইরা যে স্বাদ ভোগ করেছে তা মিয়ানমার সরকারকেও আস্বাদন করতে হবে। জাপান টাইমসের এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এদিকে জেনেভাভিত্তিক সংস্থা সেন্টার ফর হিউম্যানিটারিয়ান ডায়লগের এশিয়া শাখার পরিচালক মাইকেল ভাটিকিওটিস বলেন, রাখাইন সংকটের আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ক প্রভাব মূলত দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম সমপ্রদায়গুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঝুঁকি থেকে উদ্ভূত। পুরো অঞ্চলটির অর্ধেকের বেশি মানুষের মধ্যে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নিয়ে ক্ষোভ বাড়ছে। ‘ব্লাড এন্ড সিল্ক: পাওয়ার এন্ড দ্য কনফ্লিক্ট ইন মডার্ন সাউথইস্ট এশিয়া’ বইয়ের লেখক ভাটিকিওটিস বলেন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা খুব সহজেই এই সেন্টিমেন্ট কাজে লাগাতে পারেন। দেশগুলোতে এমনিতেই ‘আইডেন্টিটি পলিটিকসের’ কারণে ধর্মীয় সংঘাতের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে।

উল্লেখ্য, আইডেন্টিটি পলিটিকস হচ্ছে বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর দৃষ্টিভঙ্গি ও আগ্রহের ওপর ভিত্তি করে তৈরি রাজনৈতিক অবস্থান। ভাটিকিওটিস বলেন, বাংলাদেশে ৩ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা এসে পৌঁছেছে। সেখানে ত্রাণ ও আশ্রয়ের জন্য প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। অনেক রোহিঙ্গা নৌকায় চড়ে সেখান থেকে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় চলে যাওয়া শুরু করতে পারে। শুক্রবার ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সেখানে শরণার্থী সংখ্যা ১০ হাজার বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্দোনেশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম সংস্থা মোহাম্মদিয়ার ডেপুটি চেয়ারম্যান হাজরিয়ান্তো থোহারি বলেন, রোহিঙ্গারা ইন্দোনেশিয়ার জন্য একটি দেশীয় সমস্যা হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজিজু পূর্বে বলেছেন, ভারত সরকার দেশটিতে বসবাসকারী ৪০ হাজার রোহিঙ্গাকে ভারত থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল। বুধবার তার এক টুইটে তিনি বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি ভারতকে দুর্বল করে দেয়। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় অবশ্য বৃহসপতিবার জানিয়েছে, এটি বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের সাহায্যার্থে ত্রাণ পাঠাচ্ছে। বৈদেশিক নীতিমালা সমপর্কিত থিংক-ট্যাংক কার্নেগী এন্ডোওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিস এর ভারত শাখা কার্নেগী ইন্ডিয়ার এক কর্মচারী কনস্টান্টিনো জাভিয়ার বলেন, চট্টগ্রামে ভারতের মানবিক সহায়তা এটা দেখায় যে এই অঞ্চলে জরুরি পরিস্থিতিতে সবার আগে প্রতিক্রিয়া গ্রহণের ইচ্ছা ও ক্ষমতা ভারতের রয়েছে।

এ ছাড়াও এটি বাংলাদেশে শরণার্থীদের প্রবাহ থামানো নিয়ে ভারতের উদ্বেগের দিকেও ইংগিত দেয়। এতে করে রোহিঙ্গাদের ভারতের সীমানা পার করার উদ্দীপনাও কমে যাবে। ভারত সরকার বৃহসপতিবার সুপ্রিম কোর্টকে জানিয়েছে যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি একটি হুমকি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতে বাসরত রোহিঙ্গা মুসলিমদের ভারতে থেকে বের করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দিল্লিতে বসবাসকারী দুই রোহিঙ্গা তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বর্তমানে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। বর্তমানে আবেদনটির শুনানি চলছে। জাতিসংঘের হিসাবে, গত দশকজুড়ে ভারতে প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসেছে। এদের মধ্যে মাত্র ১৫ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী তালিকায় নথিভুক্ত হয়েছে। কিন্তু ভারত এদের সবাইকে দেশ থেকে ফেরত পাঠাতে চায়। ভারত সরকারের হয়ে লড়া এক জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বৃহসপতিবার বলেছেন, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সন্দেহ, ভারতের রোহিঙ্গা মুসলিম নেতাদের সঙ্গে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠীর যোগাযোগ রয়েছে। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সামপ্রতিক অভিযান শুরু হয় মিয়ানমারের বিদ্রোহী দল আরাকান সালভ্যাশন আর্মির (আরসা) এক হামলার পর। ২৫শে আগস্ট আরসার হামলায় ১২ পুলিশকর্মী নিহত হয়।

এরপর থেকেই রাখাইন রাজ্যে সামপ্রতিক সহিংসতার শুরু। বাংলাদেশে সামপ্রতিক সপ্তাহগুলোতে ৪ লাখের মতন রোহিঙ্গা শরণার্থী পালিয়ে এসেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই শরণার্থীদের আবাসনের ব্যবস্থা করার জন্য শিবির তৈরি করতে হাজার একরের জমি বরাদ্দ করে দিয়েছেন। ইউরাশিয়া সংস্থার এক এশিয়া বিশ্লেষক সাশা রিসার ফোনে বলেন, তবুও শরণার্থীরা যত বেশিদিন এদেশে থাকবে বাংলাদেশিরা তত কম অতিথিপরায়ণ হয়ে উঠবে। বুধবার রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘের এক সাধারণ অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সুচির সেখানে যোগ দেয়ার কথা থাকলেও তিনি নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে যোগ দেননি। এক শীর্ষ মার্কিন আইনকর্তা বৃহসপতিবার বলেন, সুচি তাকে নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি রোহিঙ্গাদের কাছে ত্রাণ পাঠানোর জন্য কাজ করছেন। সুচির বহুদিনের সহচর ও বন্ধু সিনেট মেজরিটি লিডার মিচ ম্যাককনেল। তিনি জানান, এক ফোনকলে সুচি তার সঙ্গে একমত হয়েছেন যে, মিয়ানমারে তাৎক্ষণিক ও উন্নত মানবিক সহায়তা পৌঁছানো উচিত, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সংস্থা রেড ক্রসের মাধ্যমে। তিনি বলেছেন যে, তিনি এমনটি ঘটানোর চেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছেন। ম্যাককনেল সুচির বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন সমালোচনা না করতে সতর্ক করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, এই সামরিক বাহিনী দেশটি ৫০ বছর ধরে শাসন করেছে সেই শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুচির নেই।

তিনি বলেন, আমার মতে, জনসম্মুুখে বার্মার (মিয়ানমার) গণতাত্রিক সংস্কারের সেরা আশা অং সান সুচির সমালোচনা করা গঠনমূলক নয়। এটা প্রতিনিধি সরকারের উন্নয়নের গতি ধীর করে দিতে পারে। গত সপ্তাহে জন ম্যাককেইনসহ সিনেটররা রোহিঙ্গা নির্যাতনের নিন্দা জানিয়ে সুচিকে পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। ম্যাককেইন মিয়ানমারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহযোগিতার বিস্তারিত বিবরণসহ প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় সমপর্কিত একটি বিল থেকে ভাষা মুছে ফেলার চেষ্টাও করেছিলেন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী জানিয়েছে, সামপ্রতিক সপ্তাহগুলোতে ৪ শর বেশি রোহিঙ্গা হত্যা করেছে তারা। বাংলাদেশের পুলিশ পরিদর্শক মইনুদ্দীন খান বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে বিভক্তকারী নাফ নদে অন্তত ১০০ মানুষের লাশ পাওয়া গেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুল জানিয়েছে, নিহতদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। এদিকে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ও দুর্বৃত্তদের এক বৃহৎ পরিসরের স্কর্চড-আর্থ-অভিযানের প্রমাণ পেয়েছে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। উল্লেখ্য, স্কর্চড আরথ অভিযান হচ্ছে একটি বিশেষ সামরিক কৌশল যেটিতে প্রতিপক্ষের কাজে আসতে পারে এমন সবকিছুকে টার্গেট করা হয়। অ্যামনেস্টি আরো জানিয়েছে সেনারা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালাতে রোহিঙ্গাদের বহুল ব্যবহৃত দুটি রাস্তায় স্থলবোমা পেতে রেখেছে। সংস্থাটি শুক্রবার রাখাইন রাজ্যের পুড়ে যাওয়া গ্রামের কয়েকটি নতুন স্যটেলাইট-ইমেজ প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি অভিযোগ করেছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী তিন সপ্তাহ ধরে রোহিঙ্গা বসতিদের পদ্ধতিগতভাবে উচ্ছেদ করেছে। অঞ্চলটির অন্তত ২৬টি গ্রামে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। সংস্থাটি বিভিন্ন রোহিঙ্গা প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য ব্যবহার করেছে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, নিরাপত্তা বাহিনী ও দুর্বৃত্তরা গ্যাসোলিন বা শোল্ডার-ফায়াড-রকেট লঞ্চার (কাঁধে রেখে রকেট ছোঁড়া যায় এমন লঞ্চার) ব্যবহার করে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তারপর গ্রামবাসী পালাতে চাইলে তাদের ওপর গুলি ছুড়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এক গবেষক অলফ ব্লমকিউভিস্ট বলেন, এটাকে যেকোনো উপায়ে রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশ থেকে বের করে দিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর একটি ইচ্ছাকৃত চেষ্টা ছাড়া অন্যকিছু বলা কঠিন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন বৃহসপতিবার বলেন, আমাদের অং সান সুচি ও তার নেতৃত্বকে সমর্থন করতে হবে। কিন্তু ওই সরকারের ক্ষমতার অধিকারী সামরিক শক্তির বিষয়ে খুব সপষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন থাকতে হবে যে এটি অগ্রহণযোগ্য। স্থলবোমার খবর প্রকাশের পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় থেকে এর প্রতিবাদ জানিয়ে মিয়ানমারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী শহিদুল হক জাপান টাইমসকে ফোনের মাধ্যমে ওই চিঠির সত্যতা সম্বন্ধে নিশ্চিত করেন। তবে চিঠিতে কি লেখা আছে তা প্রকাশ করেননি। জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টনিও গুতেরা বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, পরিস্থিটি বিপর্যয়কর। সামপ্রতিক বছরগুলোতে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন নিয়ে বারবার গণহত্যার অভিযোগ উঠেছে। মিয়ানমারের ৫ কোটি ৩০ লাখ নাগরিক রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী হিসেবে দেখে। উল্লেখ্য, ১৯৮২ সালে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়া হয়েছে। রাখাইন রাজ্যের মুসলিমরা বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দেশহীন মুসলিম সমপ্রদায়। আন্তর্জাতিক নিন্দার ফলে মিয়ানমারে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। গত অর্থবছরে দেশটিতে বিদেশি বিনিয়োগের হার ছিল ৩০ শতাংশ। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দেশটির অর্থনীতিতে ১২ মাসে ৯৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে। সরকারের অর্থনৈতিক এজেন্ডার দিকনির্দেশনা নিয়ে উদ্বেগের সঙ্গে মিলে সেই বিনিয়োগের হারে ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। ইনলে এডভাইজোরি সংস্থা এবং ইউএস অফিস ফর সেপশাল রিপ্রেজেনটেটিভ অ্যান্ড পলিসি কো-অর্ডিনেটর ফর মিয়ানমারের সাবেক বিশেষ সহকারী এরিন মার্ফি বলেন, একটি প্রধান উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে মিয়ানমার নিষেধাজ্ঞা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের সমার্থক হয়ে যাবে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন