সু চির পুরস্কারগুলো কেড়ে নেওয়া শুরু

  21-09-2017 04:29AM

পিএনএস ডেস্ক: সামরিক জান্তার কবলে গৃহবন্দি থাকার সময় মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চিকে বিশ্ব গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আন্দোলনের রোল মডেল খেতাবসহ নানা উপাধি ও পদক দিয়েছিল পশ্চিমা বিশ্ব। এখন তারাই সেসব খেতাব, উপাধি ও পদক স্থগিত করা শুরু করেছে। রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতার পর সু চিকে নিয়ে তাদের মোহ এখন অনেকটাই কেটে গেছে।

সু চির মতোই শান্তিতে নোবেল পাওয়া বিশ্ব ব্যক্তিত্বরা তাঁকে ‘একঘরে’ করে দিয়েছেন আগেই। এবারে যুক্তরাজ্যের ট্রেড ইউনিয়ন ইউনিসন সু চিকে দেওয়া সম্মানসূচক সদস্য পদ বাতিল করেছে। অক্সফোর্ড শহর থেকে দেওয়া ‘ফ্রিডম অব দ্য সিটি’ খেতাব স্থগিত করা হবে জানিয়ে তাঁকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি স্থগিতের চিন্তা করছে ব্রিস্টল বিশ্ববিদ্যালয়। এ ছাড়া গ্লাসগো, বাথ ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শহর থেকে পাওয়া নানা রকম খেতাব ও সম্মানসূচক ডিগ্রির সবই বাতিল ও স্থগিত করা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।

কানাডায় সু চিকে দেওয়া সম্মানসূচক নাগরিকত্ব বাতিলে আন্দোলন চলছে, যা সমর্থন করেছেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড।

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে সু চিকে টেলিফোনে উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, যত দিন রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান না হবে, তত দিন মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া স্থগিত রাখবে দেশটি।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ সহিংসতা বন্ধ করে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে বলেছেন।

সু চিকে ফোন করে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা বন্ধ করা ও উচ্ছেদ হওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসনও। জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কুনো উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এটিই সত্য যে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের কারণেই চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
এমনকি মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্র চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইও সংকট সমাধানে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার পরামর্শ দিয়েছেন মিয়ানমারকে। উদ্বেগ জানিয়েছে আসিয়ানভুক্ত ১০টি দেশ, যার সদস্য মিয়ানমারও।

তবে সু চি এখনো একগুঁয়ে আচরণ করে যাচ্ছেন। মঙ্গলবার রেডিও ফ্রি এশিয়াকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে সেনাবাহিনীর প্রতি নমনীয় থাকার কথা অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘আমরা কখনোই আমাদের অবস্থান পাল্টাব না। ’

যুক্তরাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম ট্রেড ইউনিয়ন ইউনিসন অং সান সু চিকে দেওয়া ‘সম্মানসূচক সদস্য পদ’ গত মঙ্গলবার স্থগিত করে দিয়েছে। ইউনিসনের প্রেসিডেন্ট মার্গারেট ম্যাককে বলেছেন, ‘আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপে হলেও সু চি রোহিঙ্গাদের রক্ষায় সাড়া দেবেন। ’

যুক্তরাজ্যের খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটি ১৯৯৮ সালে সু চিকে সম্মানসূচক ডিগ্রি দিয়েছিল। ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চলমান নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতার প্রেক্ষাপটে তারাও ওই উপাধি বাতিল বা স্থগিত করার বিষয়টি বিবেচনা করছে। ব্রিটিশ দৈনিক দ্য গার্ডিয়ানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপাত্র বলেছেন, ‘পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আমরা প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেব। ’

২০১২ সালে লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসে সম্মান জানানো হয়েছিল সু চিকে। প্রতিষ্ঠানটির স্টুডেন্টস ইউনিয়ন তাঁকে ‘সম্মানসূচক প্রেসিডেন্ট’-এর উপাধি দিয়েছিল। ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহাথির পাশা বলেছেন, “মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর পরিচালিত জাতিগত নিধন কর্মে সু চির নীরব ভূমিকা এই ইউনিয়নের মতাদর্শের বিরোধী। তাঁকে দেওয়া ‘অনারারি প্রেসিডেন্সি’ পদবি বাতিল করা হবে। ”

সু চিকে দেওয়া ‘ফ্রিডম অব দ্য সিটি’ খেতাব স্থগিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড সিটি কর্তৃপক্ষ। অক্সফোর্ড সিটি কাউন্সিলের নেতা বব প্রাইস ও অক্সফোর্ডের লর্ড মেয়র কাউন্সিলর জিন ফোক’স সু চিকে চিঠি পাঠিয়েছেন।

১৯৯৭ সালে সু চিকে ফ্রিডম অব দ্য সিটি খেতাব দেওয়া হয়, যা ২০১২ সালে নরওয়ে থেকে নোবেল পুরস্কার নেওয়ার সময় অক্সফোর্ডে গিয়ে গ্রহণ করেন সু চি। সেই ঘটনার উল্লেখ করে চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘এখন আপনার দেশেই জাতিগত নিধনযজ্ঞ চলছে। ’

অক্সফোর্ড কাউন্সিল বোর্ড মেম্বার জন ট্যানার যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড মেইলকে বলেছেন, ‘যদি কোনো পরিবর্তন না হয়, আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় সিটি কাউন্সিলের বৈঠকেই তাঁর খেতাব স্থগিত করা হবে। ’

যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে মঙ্গলবার সু চিকে ফোন করে মিয়ানমার সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কর্মসূচি স্থগিত করার ঘোষণা দেন। তিনি সু চিকে বলেন, ‘রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর যে নির্যাতন চলছে, তাতে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সেনাবাহিনী সেখানে যে অত্যাচার চালাচ্ছে, তা বন্ধ করার জন্য পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নিন। ’

নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনকালে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কুনো উদ্বেগ প্রকাশ করে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘মিয়ানমারের পরিচালিত হত্যাকাণ্ডের কারণেই চার লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, এটিই সত্য। ’

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়া ও উচ্ছেদ হওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তা করতে মঙ্গলবার সু চিকে ফোন করে আহ্বান জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন।

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে যে সহিংসতা চলছে, তা গ্রহণযোগ্য নয়। মিয়ানমার সরকারকে এটি বুঝতে হবে যে এ ধরনের সহিংসতা সমাজে অস্থিরতা ছড়ায়। রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘকাল ধরে চলমান, এটি খুবই জটিল ও স্পর্শকাতর সংকট।

সিনহুয়াকে ওয়াং বলেন, নিরপরাধ মানুষের কোনো ক্ষতি না করে যত দ্রুত সম্ভব রাখাইনে স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনতে হবে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার মৌলিক সমাধান নিশ্চিত করতে হবে।

তবে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে এক বৈঠকের পর চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে সংলাপ চায় চীন। তারা চায়, দুই দেশ সমঝোতার ভিত্তিতে এ সংকটের সমাধান করুক। তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে চীন সহানুভূতিশীল এবং শিগগিরই তাদের জন্য সহায়তা পাঠানো হবে।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ বলেছেন, রাখাইনে সামরিক অভিযান অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। সহিংসতা বন্ধ করে মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য তাঁরা নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে একটি উদ্যোগ নেবেন বলেও তিনি জানান।

তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়িপ এরদোয়ান বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত মিয়ানমার ট্র্যাজেডির অবসান না হয়, সংকট নিরসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে তত দিন সক্রিয় হতে হবে।

নিউ ইয়র্কে আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর সংসদ সদস্যরাও রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নির্যাতনে গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। মঙ্গলবার আসিয়ান ইন্টারপার্লামেন্টারি অধিবেশনে যৌথ বিবৃতিতে সদস্য দেশগুলো বলেছে, রাখাইনে চলমান সহিংসতা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। মিয়ানমার নিজেও আসিয়ানের সদস্য। দেশটির আগাম আপত্তির কারণে রোহিঙ্গাদের পক্ষে যৌথ কার্যবিবরণী ঘোষণা করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে ফিলিপাইনের সংসদ সদস্য ডাকিলা কুয়া বলেছেন, সব সদস্য রাষ্ট্রই এ বিষয়ে উদ্বিগ্ন।

মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত : জাতিসংঘ মানবাধিকার প্রধান মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে দেশটির ওপর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন সংস্থাটির মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান জেইদ রাদ আল-হুসেইন। সূত্র : বিবিসি বাংলা।

‘রোহিঙ্গা জঙ্গিরা’ই সহিংস পরিস্থিতি তৈরি করেছে—মিয়ানমার সরকারের এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে জেইদ রাদ আল-হুসেইন বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমপ্রদায়কে পুরোপুরি নির্মূল করার লক্ষ্যে কয়েকজন রোহিঙ্গা চরমপন্থীর কার্যক্রমের উদাহরণ একটা অজুহাত হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ’


পিএনএস/আলআমীন

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন