নতুন চমক আঙ্কারা-মস্কো সম্পর্কে

  21-09-2017 11:23AM


পিএনএস ডেস্ক: দ্রুত বদলে যাচ্ছে বিশ্বরাজনীতি। এর প্রভাব পড়ছে আঙ্কারা-মস্কো-ওয়াশিংটন সম্পর্কেও। তুরস্ক-রাশিয়া এখন পরস্পরের বন্ধু। অথচ দীর্ঘ সময় ধরে তুরস্ক-রাশিয়া পরস্পর বৈরী প্রতিবেশীই শুধু নয়; রয়েছে সীমান্ত, প্রক্সিযুদ্ধ, গোপন ও রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের ইতিহাস। তুরস্ক-রাশিয়া ঐক্য এ অঞ্চলের রাজনীতিতে আনতে পারে বড় ধরনের পরিবর্তন। অন্যদিকে আঙ্কারা-ওয়াশিংটনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে চির ধরেছে।

তুরস্ক-রাশিয়ার মধ্যে কয়েক বছর আগেও সম্পর্ক ছিল উত্তেজনাকর। তুরস্কে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত আন্দ্রেই কারলভ আততায়ির গুলিতে নিহত হওয়া, ২০১৫ সালের নভেম্বরে তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগে তুরস্কের রুশ যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করা, আসাদ সরকারকে মতায় টিকিয়ে রাখতে সিরিয়ায় পুতিনের সরাসরি জড়িয়ে যাওয়া, সিরিয়া থেকে উগ্র সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস যে তেল পাচার করছে সেই তেল তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের পরিবারের লোকজন কিনে নিচ্ছে বলে অভিযোগের ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল। রুশ বিমান ভূপাতিত করায় তুর্কি পণ্য ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। এমনকি ইস্তাম্বুলে পরমাণু বোমা ফেলতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছিলেন দেশটির এক রাজনৈতিক নেতা। কিন্তু দুই দেশের সম্পর্কে বড় ধরনের যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর হয়েছে রুশ বিমান ভূপাতিত করার ঘটনার পরে এরদোগানের দুঃখ প্রকাশের মাধ্যমে। মস্কোর সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক উন্নত করার কৃতিত্ব এরদোগানেরই।

অন্য দিকে মার্কিন কংগ্রেস তুরস্কের কাছে অস্ত্র বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নেয়া, ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই তুরস্কে সামরিক বিদ্রোহের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের তথা সিআইএ’র জড়িত থাকার অভিযোগ, সিরিয়া ও ইরাকের কুর্দি বিদ্রোহীদের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন, ব্যর্থ অভ্যুত্থানের নেপথ্যে থাকা যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী তুরস্কের বিরোধী রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা ফেতুল্লাহ গুলেনকে ফেরত পাঠাতে না চাওয়াÑ পারস্পরিক সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটিয়েছে। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের বরফ কবে গলবে তা কেউ জানে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয়ার পর রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরির চেষ্টা করছে তুরস্ক।

মস্কোর দিকে আঙ্কারার ঝুঁকে পড়ার কারণ হিসেবে অনেকে মনে করছেনÑ তুর্কি প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান পশ্চিমা দেশগুলো বিশেষ করে আমেরিকার প্রতি হতাশ হয়ে পড়েছেন। ফলে সম্পর্কের এই নয়া মেরুকরণ ঘটছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আঞ্চলিক প্রাধান্য বজায় রাখতে তৎপর থাকা তুরস্ক-রাশিয়া বাড়াচ্ছে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ন্যাটো জোটের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেনাবাহিনী থাকা তুরস্কের রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয় মস্কোর একটি বিজয় হিসেবেই দেখা হচ্ছে। রাশিয়ার জাহাজের ভূমধ্যসাগরে প্রবেশের পথ হচ্ছে তুর্কি প্রণালী। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর দণিাঞ্চলীয় রাকবচও তুরস্ক। কাজেই তুরস্ক ও তার মিত্রদের জন্য এটি বিব্রতকর হলেও এমন একটি দেশের কাছে পেণাস্ত্র বিক্রি বা সামরিক সমঝোতা মস্কোর জন্য অবশ্যই একটি বড় বিজয়।

যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ন্যাটো জোটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়েও দিন দিন রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়ছে তুরস্ক। বাড়াচ্ছে সামরিক সম্পর্ক, কিনছে এস-৪০০ মডেলের অত্যাধুনিক বিমানবিধ্বংসী পেণাস্ত্র ব্যবস্থা। ৩০০ কোটি ডলার অর্থমূল্যের এই পেণাস্ত্রগুলো ৪০০ কিলোমিটার দূরের ল্যবস্তুতে আঘাত হানতে সম। এই পেণাস্ত্র ক্রয় চুক্তিকে প্রথমত, ওয়াশিংটনের কাছ থেকে আরো বেশি ছাড় পাওয়ার ক্ষেত্রে দরকষাকষির অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে আঙ্কারা। দ্বিতীয়ত, নিজস্ব নিরাপত্তার বিষয়ে মার্কিন সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে স্বাধীনভাবে পদপে নেয়ার সামর্থ্য বাড়াচ্ছে। তুরস্ক-রাশিয়া সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও বাহচেশির সাইপ্রাস ইউনিভার্সিটির ডিন নুরসিন গনি বলেন, ‘তুরস্ক অনেক দিন ধরেই চাইছে প্রযুক্তি আমদানি করা এবং তাদের চূড়ান্ত ল্য হচ্ছে নিজস্ব উৎপাদন। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া, তাই এস-৪০০ পেণাস্ত্র দিয়ে আপাতত নিরাপত্তা প্রয়োজন মেটাতে চাইছে। আঙ্কারা কখনোই তার পশ্চিমা মিত্রদের বাদ দিয়ে রাশিয়ার দিকে ঝুঁকতে চায়নি। তুরস্ককে প্রযুক্তি দিতে তাদের অনীহার কারণেই রাশিয়ার সাথে এই চুক্তি করেছে দেশটি।’

রাশিয়ায় নিযুক্ত তুর্কি রাষ্ট্রদূত উমিত ইয়াদিম বলেছেন, তুরস্ক কোন্ দেশের সঙ্গে সম্পর্ক করবে সে ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়ার অধিকার ন্যাটোর নেই। ওয়াশিংটনের সাথে সম্পর্কের অবনতির পর ইরান ও রাশিয়ার সাথে তেল-গ্যাস খাতে যৌথ বিনিয়োগের জন্য প্রথম ত্রিপীয় একটি চুক্তিতে সই করেছে তুরস্ক। এরদোগান বলেছিলেন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ)-র সদস্যপদ না পেলেও তি নেই। তার পরিবর্তে যদি চিন, রাশিয়া এবং পশ্চিম এশীয় দেশগুলোর জোটে নাম লেখাতে পারলেই তুরস্কের কাছে তা বড়। তুরস্ক এসসিও- এর সদস্য হতেও চেষ্টা করছে।

আসলে তুরস্ক মস্কো-ওয়াশিংটন দুই পরে কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। তুরস্কে মার্কিন সেনা রয়েছে এবং একাধিক বিমানঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র ব্যবহার করে। এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের যে কৌশলগত স্বার্থ রয়েছে, তাতে তুরস্ক অন্যতম একটি ফ্যাক্টর এবং তুরস্কের ব্যাপারে রাশিয়ারও স্বার্থ রয়েছে। রাশিয়াকে তার অবস্থান শক্তিশালী করতে হলে তুরস্ককে তার আস্থায় নেয়া প্রয়োজন। এরই মধ্যে ইরানের সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্কের কারণে এ অঞ্চলের রাজনীতিতে রাশিয়ার অবস্থান শক্তিশালী হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলে যদি রাশিয়া-ইরান-তুরস্কের মধ্যে একটি ঐক্য গড়ে ওঠে, তাহলে তা বিশ্ব রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। ওয়াশিংটন এই পরিবর্তনকে কিভাবে সামাল দেবে সেটাই এখন দেখার বিষয়।


পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন