উত্তর কোরিয়ার পর ট্রাম্পের চ্যালেঞ্জ কি পাকিস্তান?

  21-09-2017 03:12PM


পিএনএস ডেস্ক: মনে হচ্ছে অতি বিশাল মার্কিন কূটনৈতিক ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করতে আগ্রহী নয় ট্রাম্প প্রশাসন। উত্তর কোরিয়ার পরমাণু ধাঁধা মোকাবিলায় ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান হলো সে পিয়ংইয়ংয়ের নিরাপত্তা উদ্বেগ উপলব্ধি করতে অনিচ্ছুক এবং এর পরিণতিতে দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের যে নিরাপত্তা সঙ্কট তৈরি হচ্ছে সেটিও বুঝতে রাজি নয়। এখানে দুটি ইস্যু কাজ করছে।

প্রথমত, উত্তর কোরিয়া যেহেতু আইসিবিএম উদ্ভাবন এবং সফলভাবে পরীক্ষা করেই ফেলেছে এ অবস্থায় কি সিউলের জন্য সান ফ্রান্সিসকোকে ঝুঁকিতে ফেলতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত? মনে হচ্ছে, ভীতি সৃষ্টিকারী তত্ত্ব এখন কিতাবে ঠাঁই পেয়েছে, বাস্তবে তা অচল।

দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপান কি এখনো মনে করে, উত্তর কোরিয়ার হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপরই নির্ভর করে বসে থাকতে পারবে? তাদের কাছে সম্ভবত অন্য কোনো বিকল্প ভেবে দেখার ফুসরত নেই। তাছাড়া এর কোনো সহজ জবাবও নেই।

উত্তর কোরিয়ার আইসিবিএম পরীক্ষার পর ট্রাম্প দক্ষিণ কোরিয়া ও চীন উভয়কেই তিরস্কার করেছেন। উত্তর কোরিয়ার সাথে অব্যাহত ব্যবসা করলে অবরোধ আরোপের হুমকি দিয়েছেন চীনকে। ট্রাম্প এবং তার সামরিক উপদেষ্টারা যে বিপুল সামরিক শক্তি ব্যবহার করার হুমকি দিয়েছেন তেমনটি পৃথিবী এখনো দেখেনি।

এর ফলে প্রশ্ন উঠেছে: ট্রাম্প কি পরমাণু ট্যাবু ভাঙবেন? সম্ভবত তিনি তা করবেন। সেক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র কে প্রথমে হামলা চালালো তা কোনো ব্যাপার নয়। গত ৭২ বছর ধরে পরমাণু অস্ত্র অব্যবহৃত রয়ে গেছে। একবার যদি তার ব্যবহার আবার শুরু হয়, তবে শত্রুকে সমুচিত শিক্ষা প্রদানের জন্য পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োগ যৌক্তিক হয়ে পড়বে। ফলে সম্ভাব্য ধারণা হিসেবে সম্পূর্ণ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটানোকে গ্রহণযোগ্য করে তুলবে।

ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি বিবেচনা করলে তা একটি প্রশ্নের সৃষ্টি করে: পরবর্তী চ্যালেঞ্জ হিসেবে ট্রাম্প কোনটিকে বিবেচনা করবেন? সেটা কি পাকিস্তান হতে পারে? যুক্তরাষ্ট্র যদি উত্তর কোরিয়া ও পাকিস্তানকে চীনের প্রক্সি বিবেচনা করে তবে তা হতেই পারে।

পাকিস্তানের দ্যা এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের এক নিবন্ধে ড. রাবিয়া আখতার এ অশঙ্কার কথা প্রকাশ করেছেন।

পাকিস্তান ও উত্তর কোরিয়া নিশ্চিতভাবেই দুটি ভিন্ন বিষয়। পিয়ংইয়ংয়ের কাছে আইসিবিএম, থার্মোনিউক্লিয়ার অস্ত্র এবং যুক্তরাষ্ট্রকে ভয় দেখানোর মতো আরো অনেক যন্ত্রপাতি আছে, কিন্তু পাকিস্তানের কাছে নেই। কিন্তু তা সত্ত্বেও এটা কি অচিন্তনীয় নয় যে, একদিন পাকিস্তানও তালিকায় চলে আসবে? না। পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র কি মার্কিন প্রচলিত বা পরমাণু হামলা থেকে দেশটিকে রক্ষা করতে পারবে? না। তাহলে পাকিস্তানের কি উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত? হ্যাঁ। ট্রাম্প এবং তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের কাছে পরমাণু যুদ্ধ চিন্তাযোগ্য এবং জয়যোগ্য।

হাত নিশপিশ করতে থাকা ট্রাম্প হয়তো তার নেতৃত্বাধীন অবশিষ্ট বিশ্বকে বিশেষ সঙ্কেত দিতে উত্তর কোরিয়া-পরবর্তী দৃশ্যপটে তার অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য যেকোনো কিছু করতে পারেন। এই যে কোনো কিছু করা থেকে তাকে বিরত রাখার কেউ কি আছে? এটা কি বিপজ্জনক কাজ? অবশ্যই। ফলাফল কি ভয়াবহ হবে? অবশ্যই। এখনো তা তা চিন্তাযোগ্য? সম্ভবত।

ট্রাম্প তার দক্ষিণ এশিয়া নীতি ঘোষণা করার পর পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড হ্যালে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়ার সাথে সাক্ষাত করেছেন। এ সময় জেনারেল বাজওয়া বলেছেন, পাকিস্তানের সাহায্যের দরকার নেই, দরকার সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সে যে অপরিমেয় আত্মত্যাগ করেছে, যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, তার স্বীকৃতি দেয়ার। পাকিস্তানের যে সাহায্যের দরকার নেই, তা এই প্রথম পাকিস্তানের কেউ বললেন, এমন নয়।

১৯৮০ সলে জেনারেল জিয়াউল হক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের ৪০০ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কার্টারের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা জবিনিউ ব্রেজিনস্কি এবং সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়ারেন ক্রিস্টোফারকে বলেছিলেন, পাকিস্তানের মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যের প্রয়োজন নেই যদি যুক্তরাষ্ট্র তাকে তিনটি দিকে নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চয়তা না দেয়।

এই তিনটি দিক হলো: ক. পাকিস্তানে সোভিয়েত হামলা, খ. পাকিস্তানে সোভিয়েত-ভারত যৌথ হামলা এবং গ. এমন পরিস্থিতি যেখানে পাকিস্তানে হামলা চালাতে ভারতকে উৎসাহিত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। ভারতের ব্যাপারে পাকিস্তানের নিরাপত্তাহীনতার অনুভূতি প্রকাশে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন ওই দুই মার্কিন কর্মকর্তা। তারা বিস্মিত হয়েছিলেন, ভারত এবং সোভিয়েত হামলার বিরুদ্ধে অতি তুচ্ছ নিরাপত্তা নিশ্চয়তার বিনিময়ে পাকিস্তান সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা পায়ে ঠেলে দিচ্ছে। পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্র তৈরির সময়টাতে মার্কিন প্রশাসন অবাক হয়েছিল, ভারতের সম্ভাব্য হামলা নিয়ে পাকিস্তান কেন এতোটা ভাবছে। এই অবাক হওয়া থেকেই পাকিস্তানের পরমাণু অস্ত্রের প্রয়োজনীয়তাকে খাটো করে দেখেছিল যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চয়তার অভাবের ফলেই পাকিস্তান পরমাণু শক্তিধর দেশে পরিণত হয়েছিল।

বর্তমানে হেনরি কিসিঞ্জারের ওই তত্ত্বটির কথা মনে করা যেতে পারে: ‘যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিরাপত্তার চেয়ে কোনো দেশের নিরাপত্তা ওই দেশের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’

ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচনের সময় কিসিঞ্জার তার পাশে থাকলেও এখন সম্ভবত মার্কিন প্রশাসনে তার কথা শোনার মতো কেউ নেই। আফগানিস্তানে ভূমিকা পালনের জন্য ভারতকে আমন্ত্রণ জানিয়ে দিল্লির ব্যাপারে পাকিস্তানের নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয়টি ধরতে না পেরে আবারো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক বড় একটি ভুল করে ফেলল।

আফগানিস্তানের মাটিতে ভারতের পা ফেলা মাত্র, এমনকি তা যদি প্রতীকীও হয়, পাকিস্তানকে সাথে সাথে যৌথ হামলার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত যেকোনো এলাকায় হানা দেয়ার সম্ভাবনার বিরুদ্ধে কৌশল তৈরি করে ফেলতে হবে। যেকোনো ধরনের হামলা, সীমান্তের অপর প্রান্ত থেকে দ্রুত অতিক্রম কিংবা অনুসন্ধান ও ধ্বংস মিশন বানচাল করার জন্য এবং প্রতিশোধমূলক হামলার জন্য তৈরি হয়ে থাকার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে পাকিস্তানের প্রচলিত বাহিনীকে আধুনিকায়ন করা এবং অ-পরমাণু শক্তিকে শক্তিশালী করা এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।

পাকিস্তানকে অবশ্যই এখন ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্রকে ভয় দেখানোর পন্থা নিয়ে ভাবতে হবে। কুশলী কূটনীতি অপরিহার্য, তবে আমাদেরকে অচিন্তনীয় কিছুর জন্যও চিন্তা-ভাবনা করতে হবে।

পিএনএস/আনোয়ার

@PNSNews24.com

আপনার মন্তব্য প্রকাশ করুন